“আকাশ ভরা, সূর্য তারা
বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান…….”
সত্যি তাই। আকাশ জুড়ে অনন্ত নক্ষত্রের মেলা, যুগপৎ ভাবেই মহাবিশ্বে প্রতিটি জীবের অবস্থান কি অনন্ত বিস্ময়ের আর কি অপরিসীম তাৎপর্যের ! ভাবতেও অবাক লাগে। ভাবনার সাথেই মনের কোণে জেগে ওঠে অসংখ্য প্রশ্ন, শত ধারায় উৎসারিত হয় অফুরন্ত আবেগ। হৃদয়ের গভীরতম সেই তৃষ্ণার্ত প্রশ্ন গুলিকে জীববিজ্ঞান দেখাচ্ছে আলোর পথ। অপরিসীম সৌন্দর্যে ভরপুর বিজ্ঞানের এই শাখাটির চর্চার বদান্যতায়ই বিশ্বকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নতুন রূপে। মহাবিশ্বে সকল জীবকে উপলব্ধি করছি এক নতুন চেতনার সংমিশ্রণে!
রবিঠাকুরের “আবেদন”……
১৩০২ বংগাব্দের কথা। বাইশে অগ্রহায়ণ শিলাইদহ অভিমুখে যাত্রা অভিমুখে লিখেছিলেন তাঁর আবেদন কবিতাখানি । যার কিছুটা এরকম-
“ভৃত্যঃ নানা কর্ম নানা পদ নিল তোর কাছে
নানা জনে; এক কর্ম কেহ চাহে নাই,
ভৃত্য-‘পরে দয়া করে দেহো মোরে তাই–
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
রাণীঃ মালাকর?
ভৃত্যঃ ক্ষুদ্র মালাকর………………………
রাণীঃ …….কি কাজে লাগিবি?
ভৃত্যঃ …….শত শত আনন্দের আয়োজন
………রচি সে বিচিত্র মালা
রাণীঃ ……….আবেদন তব করিনু গ্রহণ…….
তুই মোর মালঞ্চের হবি মালাকর। “
প্রকৃতপক্ষে জীবনের অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও সজ্জিত হয়ে আছে এরকম একটি দ্বিসূত্রক মালায়। এক চক্র আর দ্বি চক্রের বিভিন্ন পুঁতির সন্নিবেশে মালার গঠন। কিন্তু তাতেই কি অকল্পনীয় সুন্দর এটি ! কি অপরিসীম বৈচিত্র্যের ধারক!
পুরোনো সেই দিনের কথা…….
সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরের কথা। জোহান ফ্রেডেরিখ মিশ্চেয়ার (১৮৪৪-১৮৯৫) ২৪ বছর বয়সে যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ডিগ্রিটি যখন নিলেন তখন তাঁর মামা উইলহেলম হিজ উপদেশ দিলেন জৈবরসায়নের উপর শিক্ষা গ্রহণ করতে। মামার কথামতো মিশ্চেয়ার ভর্তি হলেন জার্মানির টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় এ । গবেষণা করতে লাগলেন বিখ্যাত জার্মান জীব রসায়নবিদ ফেলিক্স হপে সেলারের গবেষণাগারে। আমরা অনেকেই কিন্তু জানিনা যে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জীবরসায়ন গবেষণাগারটি ছিল জার্মানির নেকার নদীর তীরে এক বিশাল দুর্গে! দুর্গের প্রশস্ত দেয়ালে ছোট একটু জানালার সামান্য আলোয় প্রায়ন্ধকার উঁচু ছাদবিশিষ্ট স্যাঁতস্যাঁতে বিরাট ঘরে ফ্রাংকো প্রুশিয়ান যুদ্ধে আহত সৈনিকদের পুঁজ মাখা ব্যান্ডেজ নিয়ে কাজ করতে করতে একদিন মিশ্চেয়ার আবিষ্কার করলেন এমন এক জৈব রাসায়নিক বস্তু যাকে তিনি আখ্যায়িত করলেন Sui-Generis নামে। যার অর্থ অনেকটা -” এর কোন দ্বিতীয় রূপ নেই”। আসলে এটিই পরবর্তীতে আত্মপ্রকাশ করে নিউক্লিক এসিড নামে। এর সেই সূত্র ধরে প্রায় দেড় যুগ পরে আলব্রেখসৎ কোজেল নামে একজন বিজ্ঞানী অর্জন করেন নোবেল পুরস্কার । তিনি নোবেল পান “in recognition of the contributions to our knowledge of cell chemistry made through work on proteins, including the nucleic substances”.আসলে এই পথ ধরেই উন্মোচিত হতে থাকে মানব জীবনের রহস্য প্রকাশের রঙ্গমঞ্চের পর্দার । আর এভাবেই জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা।
ফ্রেডরিখ মিয়েশ্চার হয়তো জানতেনই না যে তিনি সেই আলো আঁধারি স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে যে আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন সেই আলোকে আলোকজ্জ্বল হয়ে থাকবে পরবর্তী জীব রাসায়নিক গবেষণার প্রতিটি ক্ষেত্র!
নিউক্লিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ তখন সবে শুরু। নিউক্লিক অ্যাসিডের গঠন নিয়ে এর পরে কাজ করলেন ফিবাস লেভেন ,নিউ ইয়র্কে রকফেলার ইন্সটিটিউটে। ইনি কোষে পাওয়া নিউক্লিক অ্যাসিডের রাসায়নিক উপাদানগুলোকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিউক্লিক অ্যাসিডের চার উপদান – অ্যাডেনিন(A), থিয়ামিন(T), সাইটোসিন(C) আর গুয়ামিন(G)। কিন্তু তিনি ক্রোমোজমের নিউক্লিক অ্যাসিডের সঠিক কাঠামো বলতে পারেন নি। ১৯২৯ সালে ডি-এন-এ বা ডি-ওক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড আবিষ্কার করার পরে উনি দাবী করেন যে এটি মাত্র চারটি নিউক্লিওটাইড নিয়ে গঠিত (ছবিতে লিভানের প্রস্তাবিত গঠন)। লেভেনের এই আবিষ্কার ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা ব্যাপার তখন বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে বংশগতির বাহক যাহেতু খুবই জটিল বার্তা বহন করে তাই তার রাসায়নিক গঠনও জটিল হবে । লেভেনের আবিষ্কারের পরে বোঝা গেল ডি-এন-এ এর কাঠামো এই জটিল বার্তা ধারণের পক্ষে উপযোগী হবে না। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করতে থাকলেন প্রোটিনই হবে সেই বার্তাবাহক। ২০ রকমের বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরী বলে প্রোটিনের বিভিন্ন রূপ ধারণ করা সম্ভব আর বার্তা বহনের কাজও করা সহজ। অপরদিকে, মাত্র চারটে ভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দিয়ে তৈরী চার শৃঙ্খলার অণু কিছুতেই অত জটিল বার্তা বহন করতে পারে না।
এই ভুল ধারণা আরো অনেক দিন রয়ে যেত, যদি না আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পরীক্ষাগারে এক অঘটন না ঘটিয়ে ফেলতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টায় ফ্রেডেরিক গ্রিফিথ গবেষণা করছিলেন নিউমোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। এই ব্যাকটেরিয়া দুধরণের – একটা মারাত্মক ধরণের আরেকটা নির্বিষ। প্রথম ধরণের ব্যাকটেরিয়াকে বলা হত S(Smooth) আর দ্বিতীয়টিকে R(Rough)। এই S ব্যাকটেরিয়া ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করালে তার দ্রুত মৃত্যু হত। কিন্তু R ব্যাকটেরিয়া কোনো ক্ষতিই করতে পারত না। দেখা গেল, S ব্যাকটেরিয়ার কোষের বাইরের দিকে উপস্থিত একটি বিশেষ পদার্থের আচ্ছাদন কোষকে রক্ষা করত, R ব্যাকটেরিয়ার কোষে এরকম কিছু ছিল না। এবার উনি কিছু মৃত S ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেখলেন ইঁদুর মরে না। সবশেষে মৃত S ব্যাকটেরিয়ার সাথে সাথে R ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দিয়ে দেখা হল। কিন্তু গ্রিফিথকে অবাক করে দিয়ে ইঁদুরটা মরে গেল (ছবিতে)। কি ভাবে মৃত ব্যাকটিরিয়াগুলো বেঁচে উঠে ইঁদুরটাকে মেরে দিল? দুই ভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া কি ভাবে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলল ইঁদুরটাকে? মৃত ইঁদুরের শরীর থেকে সংগৃহীত ব্যাকটেরিয়াগুলো দেখা গেল সব S ব্যাকটেরিয়া। এর মানে জিনগত ভাবে বদলে গেছে ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু কি ভাবে এরকম হল? মানবসভ্যতার ইতিহাসে, চোখের সামনে প্রজাতির রূপ পরিবর্তন করা আগে দেখা যায় নি। গ্রিফিথই প্রথম সে সৌভাগ্য অর্জন করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কি ভাবে এটা ঘটে? মৃত ব্যাকটেরিয়া থেকে কি এমন উপাদান সংগ্রহ করে জীবন্ত ব্যাকটেরিয়াগুলো যাতে তারা রূপ পরিবর্তন করতে পারে?
সেই সূত্র উদ্ঘাটন করলেন অসওয়াল্ড আভেরী , অনেক পরে, ১৯৪৪ সালে সেই রকফেলার ইন্সটিটিউটেই (ছবিতে)। উনি বিজ্ঞানী ম্যাকলয়েড আর ম্যাককার্টির সাথে মিলে প্রমাণ করে দিলেন যে উপাদান সংগ্রহ করে এই রূপান্তর ঘটে তা হল ডিএনএ। গ্রিফিথ যে কাজটা মৃত S ব্যাকটেরিয়া দিয়ে করেই বিস্মিত হয়েছিলেন, সেটাকেই এই বিজ্ঞানীরা কয়েক ভাগে ভেঙে নিলেন। প্রথমে মৃত S ব্যাকটেরিয়াগুলোর বাইরের আচ্ছাদন সরানো হল আর তারপরে আগের প্রক্রিয়া চালানো হল – তাতেও রূপান্তর হল। তার মানে বাইরের আচ্ছাদনের কোনো ভূমিকা নেই রূপান্তরে। একই ভাবে উনি এর পরে একে একে মৃত S ব্যাকটেরিয়াগুলো থেকে প্রোটিন ও আর-এন-এ সরিয়ে দিয়ে দেখলেন রূপান্তর হচ্ছে। সবশেষে ডি-এন-এ কোষ থেকে সরিয়ে দিতেই দেখা গেল আর কোনো রূপান্তর হচ্ছে না। তার মানে গল্পটা এরকম দাঁড়ালো – মৃত S ব্যাকটেরিয়াগুলোর ডি-এন-এ জীবিত R ব্যাকটেরিয়াগুলো গ্রহণ করে পরিবর্তিত হচ্ছে – নতুন রূপ ধারণ করছে। তার মানে, ডি-এন-এই হল জীবের বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক – অন্য কথায় ডি-এন-এ জিনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আভেরীর মত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। আভেরী, ম্যাকলয়েড আর ম্যাককার্টি – কেউই কোনোদিনও নোবেল পুরষ্কার পেলেন না। (অনেক পরে বাংলাদেশে কলেরা নিয়ে গবেষণাকেন্দ্রের প্রধানরূপে নিযুক্ত হলেন ম্যাকলয়েড । বাংলাদেশের সেই কলেরা গবেষণা কেন্দ্র এখন পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়া ডিসিসেস রিসার্চ নামে।) ততদিনে প্রোটিন নিয়ে বংশগতির ধারণা বিজ্ঞানীদের মধ্যে এতটাই গেঁথে গেছে যে অনেক বিজ্ঞানীই তার মত পাত্তাই দিলেন না। এই পাত্তা না দেবার দলে ছিলেন সুইডিশ রসায়নবিদ এইনার হ্যামারস্টেনও। কিন্তু হ্যামারস্টেন আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে বসলেন (সূত্র – জেমস ওয়াটসনের ডি-এন-এ বইটি), নোবেল কমিটিতে আভেরীর নমিনেশনের বিরোধিতা করলেন। পঞ্চাশ বছর পরে নোবেল আর্কাইভ থেকে জানা গেল এই নির্মম সত্য। মজার কথা, হ্যামারস্টেন নিজেও কিন্তু ডি-এন-এ নিয়েই কাজ করতেন। অথচ তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এর কি মহিমা হতে পারে। উনি আর বেশীরভাগ বিজ্ঞানীর মত মনে করলেন প্রোটিনই হবে বোধহয় বংশগতির বাহক। আর এর ফলে নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হল একটি মৌলিক গবেষণা ও গবেষক। ডি-এন-এ-এর প্রকৃত কাঠামো জানা যাবার কয়েক বছরের মধ্যেই উনি মারা যান। জেমস ওয়াটসন তার বইতে লিখেছেন – হয়ত আর কয়েক বছর বাঁচলে উনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েই যেতেন। আরেক নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী আর্নে টিসেলিয়াসের মতে নোবেল না জেতা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আভেরীই ছিলেন সবথেকে যোগ্য বিজ্ঞানী।
অনেকসময়েই বিজ্ঞানের একাধিক শাখা একে অপরের সাথে জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু আজকের স্পেশালাইজেশনের যুগে দেখা যায় ক্রস-ডিসিপ্লিন নলেজ বা একাধিক শাখায় দক্ষ লোকের সংখ্যা কমেই চলেছে। তবে যখনকার কথা বলছি, তখন এই সমস্যাটা এত গভীর ছিল না। তাই জ্ঞান বিনিময়ের জন্য বিজ্ঞানীদের অভাব হত না। তাও কিছু কিছু বিজ্ঞানী এদের মধ্যে আলাদা করে জায়গা করে নিতে পারেন। আর কেউ কেউ পারেন এক শাখার বিজ্ঞানীদের অন্য শাখায় উৎসাহিত করে তুলতে। শেষোক্ত কাজটিই করেছিলেন অস্ট্রিয়ান নোবেলজয়ী পদার্থবিদ আরভিন শ্রোডিংয়ার ।
শ্রোডিংয়ার কিন্তু সম্পূর্ণরূপে একজন নিবেদিতপ্রাণ পদার্থবিদই ছিলেন। ১৯৪৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে উনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে জানালেন যে বিষয়বস্তু পদার্থবিদ-দের অতি পরিচিত গাণিতিক সমীকরণের খুব একটা ধার ধারে না। এই বক্তৃতাটিতেই উনি প্রথম জীবন ও তার অর্থ বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বলেন। এরপরে, ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত “হোয়াট ইজ লাইফ” নামক তার বইতে তিনি লিখেছিলেন যে জীবনের উদ্দেশ্য হল কিছু তথ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ আর প্রবাহ। এভাবে ক্রোমোসোম হল এই তথ্যের ধারক। বংশানুক্রমিক ভাবে আসা এই তথ্য ক্রোমোসোমের জটিল অণুদের বিন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাই জীবন কি সেটা বুঝতে গেলে আগে ওই বিন্যাস বুঝতে হবে। এটাই ছিল তার মূল বক্তব্য।
এদিকে একই সময়ে পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের মত জটিল তত্ত্ব দিয়ে পরমাণুর গঠন ও তাদের আচার আচরণ নিয়ে গবেষণা করছেন। অথচ, যা পরমাণুর চেয়েও অনেক বেশী জরুরী তা হল আমাদের জীবন-কে বোঝা। তা নিয়ে গবেষকের আকাল। ট্র্যাডিশনাল জীববিজ্ঞানীরা অধিকাংশই পর্যবেক্ষণ নিয়েই মগ্ন থাকেন, গাণিতিক হিসাবনিকেশ করে দেখেন না বা পরিসংখ্যানেও ততটা দক্ষ নন। শ্রোডিংয়ারের বই অনেক পদার্থবিদ ও রসায়ন-বিজ্ঞানীকেই এই জীবনের তথ্য উদ্ঘাটনের পথে আনতে সক্ষম হল। মজার কথা, ডি-এন-এ আবিষ্কারের নাটকের কুশীলবদের অধিকাংশই এই বই পড়েই জীবন নিয়ে গবেষণার পথে আসেন ।
যেমন ধরা যাক মরিস উইলিকন্সের কথা। এই পদার্থবিদ পরমাণু বোমা তৈরীতে ম্যানহাটান প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলেন। বোমার আসল রূপ হিরোশিমা-নাগাসাকিতে দেখে তার বোধোদয় হল। তিনি একরকম পাগল হয়েই প্যারিসে চলে যাবেন ভাবছিলেন চিত্রকর হবার শখে। এই সময়েই তার হাতে এসে পড়ে শ্রোডিংয়ারের বইটি। বই পড়ে উনি উৎসাহিত হন জীবন সংক্রান্ত গবেষণায় আসতে। তিনিই সর্বপ্রথম এক্স-রে ডিফ্রাকশন টেকনলজি ব্যবহার করে ডি-এন-এর গঠন পর্যবেক্ষণ করার কথা বলেন। একজন পদার্থবিদ ছাড়া এই চিন্তা মাথায় আসা সাধারণ জীববিজ্ঞানীদের কাছে অসম্ভব। আরেকজন ছিলেন ফ্রান্সিস ক্রিক। যিনি মূলত ছিলেন পদার্থবিদ্যার ছাত্র কিন্তু তার পদার্থবিদ্যার মত যুক্তিনির্ভর ও মডেল-ভিত্তিক গবেষণার অভ্যাসও এই ডি-এন-এর গঠন আবিষ্কারে বড় ভূমিকা রাখে।
এ তো গেল গত শতাব্দীর কথা। ডি এন এ আবিষ্কার, মালঞ্চের দ্বিসূত্রক মাল্যের আবিষ্কারের পেছন দিকের কথা! তো এখন আসা যাক ডি এন এ এর দ্বিসূত্রক গঠন সজ্জার বিস্তৃত কথায়-
মালঞ্চের দ্বি-সূত্রের মাল্যের গঠনের গল্প……..
হ্যারি পটারের জাদু কিংবা আলিফ লায়লার গল্পের চাইতেও অদ্ভুত কিছু আছে! এখন শুরু হবে তার কথা! যা হার মানাবে আলিফ লায়লার কল্পকাহিনীকে বা হ্যারি পটারের জাদুর কাহিনীকেও!
ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) একটি নিউক্লিক এসিড যা জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রনের জিনগত নির্দেশ ধারন করে। সকল জীবের ডিএনএ জিনোম থাকে। একটি সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হচ্ছে কিছু ভাইরাস গ্রুপ যাদের আরএনএ জিনোম রয়েছে, তবে ভাইরাসকে সাধারণত জীবন্ত প্রাণ হিসেবে ধরা হয় না। কোষে ডিএনএর প্রধান কাজ দীর্ঘকালের জন্য তথ্য সংরক্ষন। জিনোমকে কখনও নীলনকশার সাথে তুলনা করা হয় কারণ, এতে কোষের বিভিন্ন অংশে যেমনঃ প্রোটিন ও আরএনএ অণু, গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী থাকে। ডিএনএর যে অংশ বংশগতি তথ্য বহন করে তাদের বলে জিন, কিন্তু অন্যান্য ডিএনএ ক্রমের গঠনগত তাৎপর্য রয়েছে অথবা তারা জিনগত তথ্য নিয়ন্ত্রনে ব্যবহৃত হয়।
ইউক্যারিয়ট যেমন প্রাণী ও উদ্ভিদে , ডিএনএ নিউক্লিয়াসের ভিতরে থাকে, তবে প্রোক্যারিয়ট যেমন ব্যাকটেরিয়াতে, ডিএনএ কোষের সাইটোপ্লাজমে থাকে। উৎসেচকের মত ডিএনএ অধিকাংশ জৈবরসায়ন বিক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয় না; মূলত, বিভিন্ন উৎসেচক ডিএনএর উপর কাজ করে এর তথ্য নকল করে রেপ্লিকেশনের মাধ্যমে আরো ডিএনএ তৈরি করে। ক্রোমোজোমের ক্রোমাটিন প্রোটিন যেমন হিস্টোন ডিএনএকে ঘনসন্নিবেশিত ও সংগঠিত করে, যা নিউক্লিয়াসের অন্যান্য প্রোটিনের সাথে এর আচরণ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।ডিএনএ নিউক্লিওটাইড অণুর সমন্বয়ে গড়া একটি লম্বা পলিমার।জীবদেহে ডিএনএ একটি একক অনু হিসেবে থাকে না, বরং চাপাচাপি করে জোড়া-অণু হিসেবে থাকে। এই লম্বা সূত্র দুইটি আঙ্গুরের মত প্যাচানো থাকে, যা দ্বৈত হেলিক্সের মত হয়। একটি ডিএনএ সূত্রে থাকে নিউক্লিওটাইড যা ডিএনএ মেরুদন্ডকে ধরে রাখে, এবং একটি ক্ষার যা অন্য ডিএনএ সূত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এই নিউক্লিওটাইড ও ক্ষারের পুনরাবৃত্তিতেই ডিএনএ সূত্র গঠিত। সাধারনভাবে একটি ক্ষার যদি একটি চিনি অণুর সাথে যুক্ত থাকে তাকে বলে নিউক্লিওসাইড এবং একটি ক্ষার যদি একটি চিনি ও এক বা একাধিক ফসফেট অণুর সাথে যুক্ত থাকে তাকে বলে নিউক্লিওটাইড। যদি একাধিক নিউক্লিওটাইড একসাথে যুক্ত থাকে, যেমন ডিএনএতে, তবে এই পলিমার কে বলে পলিনিউক্লিওটাইড।
ডিএনএ সূত্রের মেরুদন্ড ফসফেট ও চিনি অণুর পুনরাবৃত্তিতে গঠিত। ডিএনএর চিনি হচ্ছে পেন্টোজ (পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট) ২-ডিঅক্সিরাইবোজ। এই চিনি ফসফেট গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে পাশাপাশি চিনির অণুর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম কার্বন পরমাণুর স্থানে ফসফোডিয়েসটার বন্ধন গঠন করে। এই অপ্রতিসম বন্ধন বোঝায় যে ডিএনএ অণুর মেরু বা দিক আছে। দ্বৈত হেলিক্সে এক সূত্রের নিউক্লিওটাইডের দিক অন্য সূত্রের ঠিক বিপরীত দিকে থাকে। ডিএনএ সূত্রের এই ধরনের বিন্যাসকে প্রতিসমান্তরাল বলে। ডিএনএর অপ্রতিসম প্রান্তকে বলে ৫’ (ফাইভ প্রাইম) এবং ৩’ (থ্রি প্রাইম) প্রান্ত। ডিএনএ ও আরএনএর মধ্যকার একটি প্রধান পার্থক্য হলো চিনিতে, যেখানে ডিএনএতে ২-ডিঅক্সিরাইবোজ ব্যবহৃত হয় সেখানে আরএনএতে আরেকটি পেন্টোজ চিনি রাইবোজ ব্যবহৃত হয়।
ডিএনএর দ্বৈত হেলিক্স হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে স্থির থাকে, যা দুটি সূত্রের মধ্যে সংযুক্ত থাকে। ডিএনএতে যে চারটি ক্ষার পাওয়া যায় তা হল এডেনিন (সংক্ষেপে A), সাইটোসিন (C), গুয়ানিন এবং থাইমিন (T)। নিম্নে এইচারটি ক্ষার দেখানো হয়েছে যারা চিনি/ফসফেটের সাথে যুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নিউক্লিওটাইড গঠন করে, যেমনঃ এডিনোসিন মনোফসফেট।
এই ক্ষারগুলো দুই ভাগে ভাগ করা যায়; এডেনিন ও গুয়ানিন হল পিউরিন নামক ৫- ও ৬- কার্বনচক্রের হেটারোসাইক্লিক যৌগ এবং সাইটোসিন ও থাইমিন হল পাইরিমিডিন নামক কার্বনচক্রের যৌগ। ইউরাসিল নামে পঞ্চম আরেকটি পাইরিমিডিন ক্ষার আছে যা সাধারণত আরএনএতে থাইমিনের বদলে থাকে। থাইমিনের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে কেবল একটি মিথাইল গ্রুপের অনুপস্থিতি।
ডিএনএর স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় রোজালিন্ড এক্সরে পরীক্ষা থেকে। উনি পরীক্ষায় দেখলেন ডিএনএ মূলত দুটো রূপে পাওয়া যায় – যাদের নাম দিলেন এ আর বি আকার। এ আকারের ডিএনএ হল আর্দ্র – লম্বা আর সরু সরু। বি আকারেরটি হল শুষ্ক, মোটা আর বেঁটে। রোজালিন্ড গবেষণা চালিয়ে গেলেন বি আকারের ডিএনএর ওপর,অসীম ধৈর্য নিয়ে দিনরাত খেটে রোজালিন্ড একের পর এক অসাধারণ এক্সরে ছবি বের করলেন ডিএনএর। এর জন্য তিনি দীর্ঘসময় টানা পর্যবেক্ষণে রেখে ডিএনএ ক্রিস্টালকে ধীরে ধীরে গরম বা ঠান্ডা, আর্দ্র বা শুষ্ক করতেন। ফলস্বরূপ উনি একটা এমন এক্সরে ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্নের ছবি পান যেটা এককথায় অতুলনীয়।
লিস মিটনারের মতই রোজালিন্ড বঞ্চিত এক বিজ্ঞান নায়িকা! তাঁর কথা না হয় আরেকদিন শুনব…
আজকের গল্পের ইতি …….
এই আমাদের মালঞ্চের মাল্যের গল্প! এই মাল্য প্রবহমান নদীর মতন, আমাদের বংশগতির বৈশিষ্ট্য নদীর মতই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তে বহন করে এই মাল্য! অসম্ভব কিছু প্রতিভাবান মানুষ ,কিছু অসাধারণ বিজ্ঞানীদের জন্যে আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয় এই মালঞ্চের মাল্যের গল্প, এই দ্বি সূত্রের গল্প। তাঁদের আজীবন পরিশ্রম আর গবেষণায় আমরা আজ জীবনের গল্প পড়তে পারছি নতুন ভাষায়। তাই তাঁদের প্রতি আমাদের একটি কথাই বলতে ইচ্ছা হয় – “আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর”
আজকে জীববিজ্ঞানের জন্যে ভালবাসার গল্প ,এই মালঞ্চের মাল্যের মালাকরের গল্প! সত্যিই অনেক বিচিত্র, অনেক অসাধারণ। জীববিজ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক ভূবনলোক। জীবনের জয় হোক, জীববিজ্ঞানের জয় হোক। বিজ্ঞানব্লগে আবার জীবনের গল্প,জীববিজ্ঞানের ভালবাসার গল্প শুনানোর প্রতীক্ষায় থাকলাম…..
Whole of This sequence is for Arpita who inspires me everytime
রেফারেন্স বুক-
১.ডারউইন থেকে ডি এন এ এবং সাড়ে চারশ কোটি বছর -ড. নারায়ণ সেন
২. দ্য ডাবল হেলিক্স- জেমস ডি ওয়াটসন
৩. জীবনের গল্প- ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী
৪. সেলফিশ জিন – রিচার্ড ডকিন্স
৫. হোয়াট ইজ লাইফ- আরভিন শ্রোডিংয়ার
Leave a Reply