ছবিতে যে জলবিহারী প্রাণিটিকে দেখছেন, তার নাম বিশির মাছ। সৌখিন মৎসপ্রেমীদের কাছে অবশ্য ড্রাগন ফিন নামেই বেশি পরিচিত। কিছু কিছু প্রজাতির বাহ্যিক সৌন্দর্যের কারনে অনেকে একুয়ারিয়ামে পুষে থাকেন। তবে এর স্বভাব খারাপ, মুখে আটাতে পারে এমন সব মাছ কিংবা জলজ জীবকেই সাবাড় করতে সক্ষম। শুধু অন্যান্য মাছের তুলনায় এর সাঁতারের গতি কম বলেই এর সাথে একুয়ারিয়ামে অন্যান্য মাছ টিকতে পারে। যাই হোক, মজার বিষয় হল এর বায়ুথলির পরিবর্তে রয়েছে একজোড়া আদিম ফুসফুস, এবং এর সাহায্যে ডাঙ্গায় উঠে এসে নিঃশ্বাসও নিতে পারে। সামনের পাখনাগুলো বিশেষ ভঙ্গীতে নাড়িয়ে কিলবিল করে হাটতেও পারে। এই মাছটি নিয়ে সাম্প্রতিক একটি এক্সপেরিমেন্ট এর কথা বলব, তবে তার আগে ‘তিকতালিক’ সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া প্রাসংগিক মনে করি।
তিকতালিক কে ফিশাপড(ফিশ+টেট্রাপড[মানে চার পেয়ে জন্তু]) বলেও অনেকে চিনে থাকেন। এটা আসলে ৩৭৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো একটা ফসিল, যেটা ২০০৪ সালে ক্যানাডার আর্কটিক অঞ্চলে পাওয়া যায়। এর আবিষ্কার পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ন অধ্যায়ের সাক্ষ্য দেয়, যখন একটি জলজ প্রাণি স্থলে উঠে আসা শুরু করেছিলো। তিকতালিকের রয়েছে মাছের ন্যায় পাখনা, আঁশ, ফুলকা আবার স্থলজ প্রাণির ন্যায় ঘাড়, পাজর এবং কানের খাঁজ রয়েছে। এর মাথার আকৃতি অনেকটা কুমিরের মাথার মত, চ্যাপ্টা এবং উপরের দিকে চোখ। এর ঘাড় খুলির সাথে যুক্ত না থাকায়, এদিক ওদিক নাড়াতে পারে। যা অন্যান্য মাছ পারেনা।
ফিরে আসি বিশিরের প্রসংগে। ইউনিভার্সিটি অব অটাওয়ার প্রফেসর, এমিলি স্টানডেন বিশির মাছ নিয়ে গবেষনা করেন। তার একবার দেখার সাধ হয়, যেহেতু এই মাছ বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পারে, তাহলে পানি ছাড়া টিকতে পারে কিনা। তিনি তার পরীক্ষামুলক একুয়ারিয়ামটিতে কম বয়সী বিশির মাছ রেখে প্রায় সম্পুর্ন পানিশুন্য করে ফেলেন। আর ফলাফল? আশার চেয়েও বেশি কিছু। মাছগুলো শুধু টিকেই যায়নি, বরং ভালোভাবে বাঁচার জন্য নিজেদের অভিযোজিত করে ফেলেছে। তারা তাদের পাখনাগুলো দেহের কাছাকাছি এনে ধীরে ধীরে আরো সাবলীলভাবে হাটা শুরু করলো, ভূমি থেকে মাথা আরো উচুতে উঠানো শিখলো। পানিতে বড় হওয়া স্বজাতিদের তুলনায় কম হোচট খেলো। এমনিকি তাদের কংকালতন্ত্রেও কিছু পরিবর্তন আসে। তাদের ঘাড়ের হাড় লম্বা হয়ে পাখনার সাথে দৃঢ় সংযোগ তৈরি হয়। ফলে এদের পক্ষে পাখনায় ভর দিয়ে মাথা উচু করা সহজ হয়ে যায়। ঘাড়ের সাথে খুলির সংযোগ ঢিলা হয়ে যাওয়ার ফলে মাথা এদিক ওদিক ঘুরাতে পারার সক্ষমতা আসে। এবং এই পরিবর্তন গুলো কিন্তু স্থলজ প্রাণিকূলের বিবর্তনীয় পূর্বপুরুষ ‘তিকতালিক’ এর সাথে চমৎকার সামঞ্জস্যপূর্ন!
এমিলি স্ট্যানডেনের এই এক্সপেরিমেন্টের সবচেয়ে আশ্চর্য দিক এটাই যে, এই হন্টনবিদ মাছের বিকাশ কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম চাষ করে শুধুমাত্র অপেক্ষাকৃত ভালো হাটার ক্ষমতাধর সদস্যদের মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে ঘটেনি। এই ঈষৎ নাটকীয় পরিবর্তন গুলো একটা মাছের জীবদ্দশাতেই সম্পন্ন হয়েছে শুধুমাত্র আটটি মাস জোড় করে ডাঙ্গায় রাখার কারনে।
আমরা হয়তো জানি যে আমাদের শরীরের বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার একটা প্রবনতা আছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যার বিজ্ঞানীদের ধারনা এই মানিয়ে নেয়ার প্রবনতা বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। আগে মিউটেশন পরে অভিযোজনের ধারনার বদলে, তারা দাবী করেন প্রাণিদের মধ্যে অভিযোজিত হবার পরে মিউটেশন ঘটে। স্ট্যান্ডেনের করা বিশির মাছের এক্সপেরিমেন্টও এটাই বলে, এই ধরনের নমনীয়তা(Plasticity) বিবর্তনীয় পালাবদল যেমন মাছের ডাঙ্গায় উঠে আসা, প্রাইমেটের সোজা হয়ে হাটতে শুরু করার পেছনে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে পারে।
এই যে প্রজাতির বিকাশে নমনীয়তার প্রভাবের ধারনা, এটা কিন্তু নতুন নয়। একশ বছর আগেও লা মার্ক এই ধারনাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ডারউইন তো রীতিমত একটা মেকানিজম প্রস্তাব করেছিলেন যে কিভাবে জীবের জীবদ্দশায় পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সন্তানের মাঝে প্রবাহিত হয়। তার কথা ছিল, নমনীয়তার কারনে সংঘটিত পরিবর্তনের তথ্যগুলো সন্তানদের দেহে সঞ্চারিত হবার মাধ্যমে যে বংশানুক্রমিক বৈচিত্র্য তৈরি করে, তার ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচন তার জাদুর ছড়ি ঘুরায়। তবে আধুনিক জিনতত্বের উৎকর্ষের সাথে সাথে আমরা জানতে পারি একটা প্রাণি জ্যান্ত অবস্থায় কি করেছে তা তার বংশাবলীর মধ্যে পৌছানোর কোন রাস্তা নাই(কিছু ব্যাতিক্রম রয়েছে)। যার ফলে বিবর্তনের ক্রিয়াকৌশলের ওপর নমনীয়তার প্রভাব নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্চ্য আর হয়নি। বরং বিজ্ঞানীমহলের মনযোগ গিয়ে পড়ে পরিব্যাপ্তি বা মিউটেশনের ওপর। এখন পর্যন্ত বিবর্তনীয় জীববিদ্যার প্রভাবশালী ধারনা হচ্ছে, আগে মিউটেশন পরে অভিযোজন। শুক্রানুতে মিউটেশনের ফলে সন্তানাদিতে যে বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয় তা উপকারী হলে টিকে থাকে এবং ছড়িয়ে যায়, অপকারী হলে লোপ পায়। অর্থাৎ, জিনের মধ্যে দৈবপরিব্যাপ্তির মাধ্যমে যে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তার মধ্যেই প্রাকৃতিক নির্বাচন খেলা দেখায়।
তবে নমনীয়তার নাটকীয় প্রভাবের কথা একেবারেই ভুলেনি মানুষ। ১৯৪০ সালে ওলন্দাজ প্রানিবিজ্ঞানী এভারহার্ড জোহান্স স্লিপার একটি ছাগল নিয়ে গবেষনা করেন যার জন্মের সময় সামনের দুটি পা ছিলোনা। ফলে সেটি পেছনের পায়ে ভর করে ক্যাঙ্গারুর মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলতো। ছাগলটি মারা যাওয়ার পর তিনি দেখেন যে এর পেশি এবং কংকালের আকৃতি চতুষ্পদির তুলনায় দ্বিপদির সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ন। কিছু কিছু জীববিজ্ঞানী এই ধরনের প্রভাবকে বিবর্তনের নিয়ামক ধরলেও বৈশিষ্ট্যগুলোর স্থায়ীত্বের অভাব এই ধারনাকে নাকচ করে দেয়। যদি স্ট্যানডেনের হাটতে সক্ষম মাছগুলোর প্রজননের ফলে পাওয়া পোনাগুলো স্বাভাবিক জলজ পরিবেশে বড় করা হত, তাহলে তাদের সাথে এর অন্যান্য জ্ঞাতিগোষ্ঠির কোন পার্থক্যই আর পাওয়া সম্ভব হতোনা।
তবে ঘটনা যদি অন্যরকম হয়? যদি যেই পারিপার্শ্বিকতার কারনে বিভিন্ন নমনীয় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সেটাই স্থায়ী হয়ে যায়। যেমন কোন বাস্তুসংস্থানে শিকারী প্রাণি বা পরিবেশের বিশেষ কোন স্থায়ী পরিবর্তন। এই পরিবর্তন যদি প্রজন্মান্তরেও বিদ্যমান থাকে তবে প্রজাতির বিভিন্ন প্রজন্মের সদস্যের মধ্যেও এর প্রভাব দেখা যাবে। এর মাধ্যমে বিবর্তিত না হয়েও বিবর্তনের একটা স্বাদ তারা পেতে পারে। এখন প্রশ্ন হল, এই ব্যাপারটা কি সত্যিকারের বিবর্তনের দিকে ধাবিত করতে পারে? আশ্চর্য হলেও এর উত্তর হ্যা বোধক। ১৯৫০ সালে বৃটিশ জীববিজ্ঞানী কনরাড হল ফ্রুটফ্লাইদের নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেন। তিনি দেখেন যে পিউপা থাকা অবস্থায় এদের সামান্য তাপ প্রদান করা হলে জন্মানোর পর কোন কোন ফ্রুটফ্লাইয়ের শিরায় ক্রসভেইন অনুপস্থিত থাকে। ক্রসভেইন বিহীন ফ্রুটফ্লাইদের আলাদা করে এদের মধ্যে প্রজনন ঘটান তিনি। এভাবে দেখা যায় ১৪ প্রজন্মের পর কিছু কিছু পিউপাকে তাপ না দেয়া সত্বেও ক্রসভেইন নাই। পরিবেশের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট একটি দৈহিক প্রতিক্রিয়া বংশগত হয়ে গেছে!
পরিবর্তনশীল প্রতিক্রিয়ায়(Plastic response) আসলে কি ঘটে? পরিবেশের প্রভাবে কোন একটা বিকাশ পথ(Developmental pathway) প্রভাবিত হয়। এটা হতে পারে কোন একটা হরমোনের মাত্রা, নিঃসরনের সময় কিংবা কার্যকারীতার পরিবর্তন। হয়তো এক বা একাধিক জিনের সক্রিয় কিংবা নিস্ক্রিয় করনের মাধ্যমে… অথবা অন্য কিছু। কথা হল, দৈবপরিব্যাপ্তির ফলে একই ঘটনা ঘটতে পারে। তাই কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে উদ্ভুত পরিবর্তনশীল প্রতিক্রিয়া যা শুধুমাত্র পরিব্যাপ্তির মাধ্যমেই ঘটতে পারে, অথবা পরিব্যাপ্তির ফলে অন্তত বাধা না পেয়ে থাকলে, তা- প্রজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কখনো কখনো এই পরিবর্তিত বিকাশ পথ ক্রোমোজোমের মধ্যে পরিবর্তনের দ্বারা এমনভাবে স্থায়ী হয়ে যাবে, যার দরুন পরিবেশের প্রভাব ছাড়াও এটা হয়ে যাবে একটা বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য।
এই ব্যাপারটাকে কনরাড হল নাম দিয়েছিলেন জিনগত আত্তীকরন(Genetic Assimilation)। তার কাজ যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক হলেও সেই সময় খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে এখন জিনের কার্যকারীতাতেও নমনীয়তার ধারনাকে বিজ্ঞানীমহল গুরুত্বের সাথে দেখেন। যার থেকে বুঝতে পারি পরিবেশ একটি প্রাণির দেহ ও আচরনে কতটা গভীর প্রভাব রাখে। কোন কোন জীববিজ্ঞানীর মতে বিকাশ পথের পরিবর্তনশীলতা বিবর্তনে ভালোই প্রভাব রাখে। অন্তত যে জিনগত আত্তীকরন নামক ঘটিনার মাধ্যমে এটা ঘটে থাকে, তা কিন্তু বিবর্তনের কোন মৌলিক ধারনাকে নাকচ করেনা। শেষ পর্যন্ত আসলে বিবর্তন হচ্ছে লাভজনক পরিবর্তনের ছড়িয়ে পড়া, প্লাস্টিসিটি এর সাথে জড়িত থাকুক আর না থাকুক। তবে ভাবার বিষয় এটাই যে, প্লাস্টিসিটি নির্ধারন করতে পারে কোন মিউটেশন ছড়াবে কোনটি না। তাই বিবর্তনে প্লাস্টিসিটির ভূমিকাকে এর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া উচিত। অনেকে প্রশ্ন করেন, জিনগত আত্তীকরন হয়তো ঘটে- কিন্তু প্রকৃতিতে এর ভুমিকা কি? এখানে আবার বিশির মাছের পরীক্ষাটির কথা বলা যায়, যেটা প্রমাণ করে বিবর্তনীয় পালা বদলের গুরুত্বপূর্ন একটি ধাপঃ মাছ থেকে চার পেয়ে জন্তুতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্লাস্টিসিটি কতটা নিবিঢ়ভাবে জড়িত ছিল।
তথ্যসূত্রঃ
- Mutate First, Adapt Later by Collin Baras, New Scientist Magazine, issue 3004
- http://tiktaalik.uchicago.edu/
Leave a Reply