পুরো নাম ইয়োহান কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস ।
জন্ম : ৩০ এপ্রিল ১৭৭৭, জার্মানির ব্রাউনশভিগে ।
সাধারণ এক পরিবারেই জন্ম হয় এই অসামান্য প্রতিভাবানের। অনেকের বিচারে সর্বকালের সেরা গনিতবিদও। গণিতে তাঁর প্রতিভা আর অবদানই তাঁকে করেছে ‘Prince of Mathematics’ …
গাউসের প্রতিভা বেশ ছোটবেলাতেই আঁচ করা গিয়েছিল। মাত্র তিন বছর বয়সে ছোট্ট গাউস তাঁর বাবার হিসাবের খাতার ভুল ধরে ফেলেন! প্রখর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিশুব্যক্তিত্বকে ইংরেজিতে বলে prodigy. গাউসও ছোটবেলায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কী জিনিস!
গাউসের সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত গল্পটি এরকম : একদা তাঁর শিক্ষক গাউসকে ব্যস্ত রাখতে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো যোগ করে ফল বের করতে বললেন। কিন্তু গাউস শিক্ষককে অবাক করে দেন প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবে যোগফল বলে দিয়ে।
১+১০০ , ২+৯৯ ,৩+৯৮ … এরকম ফর্মেটের ৫০টা ১০১ কল্পনা করে টুপ করে ফল বের করে ফেললেন ৫০৫০।
এটা তাঁর ৯বছর বয়সের ঘটনা! অতএব, শিক্ষক হোক আর আপনিই হোন অবাক না হয়ে থাকার জো নেই।
বয়স যখন ১৫, মৌলিক সংখ্যার সংখ্যা বের করার সূত্র বের করে ফেললেন !
কোনো সংখ্যা n হলে ঐ পর্যন্ত কতগুলো মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যাবে তার একটা আসন্ন মান বলে দিবে এই সূত্রটি ।
Π(n) ≈ n/ln(n) ; যেখানে n হচ্ছে কতো’র ভেতরে মৌলিক সংখ্যার হিসেবটা জানতে চাই আর Π(n) হচ্ছে আসন্ন মান ।
তথ্য মোতাবেকে Π(100)=25 , Π(500)=95 , Π(1000)=168 .
সূত্রে n=100 বসালে মান পাওয়া যায় 21.71 , n=1000 বসালে 144.76 ।
আমরা জানি ১০০এর ভিতর মৌলিক সঙ্খ্যা ২৫টি আর ১০০০ এর ভিতর ১৬৮টি। অর্থাৎ বেশ কাছাকাছি একটা হিসেব সূত্র দিয়ে পাওয়া গেল : ২১ আর ১৪৪। আসলে মৌলিক সংখ্যার ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব বের করে ফেলার সূত্র আজ পর্যন্ত বেরোয়নি! আমরা নাহয় ১০০ , ১০০০ , ১০০০০ … এরকম ছোট লিমিটের ক্ষেত্রে মৌলিক সঙ্খ্যা কতগুলো তা গুণে বের করে ফেলতে পারব কিন্তু সীমা বিশাল হলে তো আর পারবো না ! এইখানটাতেই , গাউসের সূত্রটির মাঝে পিকিউলিয়ার একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে। n এর মান যত বড় দেয়া হবে সূত্রটিও তত বেশি কার্যকারিতা দেখাতে থাকবে, ভুলের হার আরো আরো কমতে থাকবে ।
আর এই ছোট্ট সূত্রটির প্রমাণ পেতে পৃথিবীকে গুনতে হয়েছে প্রায় ১০০ বছর !
[নিবন্ধের শেষে আগ্রহী পাঠকদের জন্য একটি টেবিল জুড়ে দেয়া হয়েছে । তাতে দেয়া আছে কত পর্যন্ত গেলে ঠিক কতগুলো মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যাবে যাতে গাউসের সূত্রটির সাথে হিসেবের পার্থক্যটা বের করে দেখতে পারেন । n এর মান বৃদ্ধির সাথে সূত্র আর পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখুন ভুলের শতকরা হার কী আচরণ করে ]গাউসের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ব্রাউনশভিগের ডিউকের নজরে আসে। তিনি পেয়ে গেলেন শিক্ষাবৃত্তি মাত্র ১৪বছর বয়সে। কলেজিয়াম ক্যারোলিনামে পড়ালেখা করবার সুযোগ পেলেন। তিনি ১৭৯২ থেকে ১৭৯৫ পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করেন। তারপর ১৭৯৫তে গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। কিন্তু গ্রাজুয়েশন শেষ না করেই ১৭৯৮ তে গটিনজেন ছেড়ে দেন।
ততদিনে গাউস আরো আরো ব্রিলিয়ান্ট হয়ে গিয়েছিলেন !
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় গাউস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য নতুন করে আবিষ্কার করেন।
জানা যায়, ১৭৯৬ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে এত বেশি আর ঘন ঘন গাণিতিক ধারণা তাঁর মাথায় আসত যে সবগুলো লিখে রাখারও সময় হত না ! কিন্তু তিনি গবেষণাপত্র প্রচার ও প্রকাশের পেছনে তত মনোযোগী ছিলেন না ।
তাঁর কোন কিছু প্রকাশের মূলমন্ত্র ছিল “Pauca sed matura” অর্থাত্ “Few , but ripe” – কম হোক , কিন্তু তাত্পর্যপূর্ণ হওয়া চাই। ঠিক এই কারণে তাঁর মৃত্যুর পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র পাওয়া গিয়েছিল যেগুলো তিনি প্রকাশ করেন নি এই ভেবে, ওগুলো যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বা মানসম্পন্ন মনে হয় নি!
১৮০১ সালে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বই Disquisitiones Arithmeticae প্রকাশিত হয়। এটা লেখার কাজ আরো তিন বছর আগেই তিনি সম্পন্ন করেন। এটি গণিতের ইতিহাসে সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে এক অনবদ্য বই। এ বইয়ে তিনি কনগ্রুয়েন্স বা অনুসমতার জন্যে একটি নতুন চিহ্নের ব্যবহার প্রচলন করেন এবং এর মাধ্যমে ভাগশেষ পাটীগণিতের পরিষ্কার উপস্থাপনা করেন। আমরা যেটাকে বলি মডুলাস অ্যারিথমেটিক।
এর মধ্যেই তিনি এক প্রাচীন সমস্যা সমাধান করে ফেলেন কেবলমাত্র রুলার আর কম্পাসের সাহায্যে সুষম ১৭ভূজ এঁকে। এটা ছিল এক তুখোড় আবিষ্কার! কারণ, এই অঙ্কণের সমস্যাটি গণিতবিদদের প্রাচীন গ্রিক আমল থেকেই ভাবিয়ে আসছিল। আরো দেখিয়ে দিয়েছিলেন ফার্মা’র মৌলিক সংখ্যাগুলোর মানের সুষম বহুভূজও রুলার কম্পাস ব্যবহার করে আঁকা সম্ভব । ফার্মা’র মৌলিক সংখ্যা চারটি হল : 5 , 17 , 257 & 65537.
তাঁর একটি সহজ আর সুন্দর গাণিতিক প্রকাশ ∆ + ∆ + ∆ = N ; যেকোন স্বাভাবিক সংখ্যাকে ত্রিভুজ সংখ্যার সমষ্টি আকারে প্রকাশ করতে তিনটির বেশি ত্রিভুজসংখ্যা কখনোই লাগবে না! যেমন ,
35 = 28+6+1
39 = 36+3
96 = 78+15+3 ইত্যাদি …
আবার যেকোনো দুটি পরপর ত্রিভুজ সংখ্যার সমষ্টি একটি বর্গসংখ্যা ! যেমন ,
10+15 = 25
45+55 = 100 ; টুকটাক খাতার খেলা মাথার খেলা আরকি। 🙂
১৮০১এর ১লা জানুয়ারি ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওসেপ্পে পিয়াজ্জি গ্রহাণু সেরেস আবিষ্কার করেন। সেরেস হচ্ছে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝপথে অবস্থিত গ্রহাণুপুঞ্জের সবচেয়ে বড় বস্তু। কিন্তু তিনি মাত্র কয়েকদিন বামন গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হন। পিয়াজ্জির কথা কেন বললাম? কারণ, গাউস গ্রহটির অবস্থান সঠিকভাবে হিসাব করে পুনরায় একে খুঁজে পাওয়ার পথ বাতলে দেন এবং ৭ ডিসেম্বর ১৮০১ এ তাঁর হিসেব সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
পরে তিনি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণায় ডুব দেন। ১৮০৯সালে প্রকাশ করেন ব্যবহারিক জ্যোতির্বিদ্যার এক অসামান্য বই : Theoria Motvs Corporvm Coelestivm.
১৮০৭ এ গোটিংগেনের জ্যোতির্বিজ্ঞান অবজার্ভেটরির প্রফেসর অফ এস্ট্রনমি ও ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ চাকরিতে বহাল ছিলেন। ১৮২১ সালে তাকে রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর বিদেশী সভ্য নির্বাচন করা হয় ।
১৮২১ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত তিনি হ্যানোভারে জিওডেসিক জরিপের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন । এ সময় তিনি হেলিওট্রপি নামে এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন ।
আমরা অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির জনক বলে জেনাস বোলাই আর নিকোলাই লোবাচেভস্কির নাম জানি। জেনাসের বাবা ফারাকাস বোলাইও এই পথেরই ছিলেন এবং তিনি ছিলেন গাউসের বন্ধুও !
মজার ব্যাপার হচ্ছে , জেনাস তাঁর অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি প্রকাশের পর গাউস বলে বসেন তাঁর গত ত্রিশ বছরের চিন্তা-গবেষণার সাথে তা মিলে যায়। পরবর্তীতে জানা যায় , গাউস ব্যাপারটা চেপে রেখেছিলেন এজন্যে যে প্রথাবিরোধী সেই জ্যামিতি প্রকাশে না তাঁকে আবার বিপদে পড়তে হয় এই ভয়ে!
ঐ যে! সেই প্রকাশের পিছুটান!
তাঁর রয়েছে ১৫৫টি গবেষণাপত্র ! তিনিই সত্যিকার অর্থে সংখ্যাতত্ত্বের ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন । প্রমাণ করেছেন বীজগণিতের মৌলিক উপপাদ্য । কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তাঁর বাবা তাঁকে ডেকে বললেন , “কার্ল, তুমি সারাদিন কলেজে কী কর? তুমি ত ইতোমধ্যে যথেষ্ট জানো! তোমার এখন চাকরি খোঁজা উচিত।” আসলে গাউসের সহপাঠীরা প্রথম বর্ষেই বুঝে গিয়েছিল এই ছেলে অনেকে হাই লেভেলের! কারণ যা-ই করানো হতো গাউস দেখতেন সেগুলো তাঁর অচেনা কিছু নয়! তিনি আগেই জানেন!
বাবার প্রশ্নের জবাবে গাউস বলেছিলেন , “ বাবা, আমি গণিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনটা তা বোঝার চেষ্টা করছি !!! আমার সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়া দরকার !” বলা বাহুল্য তাঁর বাবা যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিলেন মেধাবী পুত্রের এমন নির্বোধ(!!!) সিধান্তে। পরবর্তীতে তাঁর বাবা তাঁর স্কুলশিক্ষক বাটনারের সাথে কথা বলে তাঁকে এ ব্যাপারে পড়াশোনা করানোয় সম্মত হন। বাটনার সাহেব হলেন সেই বাচ্চা গাউসের ১০০টি সংখ্যার তড়িত যোগফল শুনে চমকে যাওয়া লোকটি, যিনি গাউসের মেধার ব্যাপারে যথেষ্ঠ জ্ঞাত !
গাউস তাঁর এক জীবনে মানবজাতিকে অবিস্মরণীয় কত কিছু দিয়ে গেছেন সে হিসেবও অনেক । সংখ্যাতত্ত্ব, বিশ্লেষণী গণিত, ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতি, তাড়িতচৌম্বকত্ব, জিওডেসি, জ্যোতির্বিদ্যা এবং আলোকবিদ্যা- সব মিলে মহাযজ্ঞকর্ম সাধন করে গেছেন ।
গণিতের রাজপুত্রের জীবনাবসান ঘটে ১৮৫৫সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি , জার্মানির হ্যানোভারে । সেখানেই তাঁকে কবর দেয়া হয়।
“Mathematics is the queen of sciences and number theory is the queen of mathematics .” – গাউস ।
অন্যান্য মনীষীর মত গবেষণা মগ্নতার কারণে পাঠককে বিহবল করার মত ঘটনা গাউসেরও আছে ।
তাঁকে কেউ এসে জানিয়েছিল, আপনার স্ত্রী মারা যাচ্ছে, চলুন । কিন্তু মগ্ন গাউস বলেছিলেন,
“Ask her to wait a moment, I am almost done.” !!!
n for 10^n | Π(n) | |
1 | 4 | |
2 | 25 | |
3 | 168 | |
4 | 1229 | |
5 | 9592 | |
6 | 78498 | |
7 | 664579 | |
8 | 5761455 | |
9 | 50847534 | |
10 | 455052511 | |
11 | 4118054813 | |
12 | 37607912018 | |
13 | 346065536839 | |
14 | 3204941750802 | |
15 | 29844570422669 | |
16 | 279238341033925 | |
17 | 2623557157654233 | |
18 | 24739954287740860 | |
19 | 234057667276344607 | |
20 | 2220819602560918840 |
তথ্যসুত্রঃ
http://m.wikipedia.org
http://malini-math.blogspot.in/2009/10/gauss-child-prodigy.html
http://www-groups.dcs.st-and.ac.uk/~history/Quotations/Gauss.html
http://oeis.org/A006880/list
PDF: Biography of Carl Friedrich Gauss by Claudia von Collani
PDF: The Prince of Mathematics by M.B.W. Tent
[লেখাটি ইতিপূর্বে গণিত সাময়িকী পাই- জিরো টু ইনফিনিটিতে প্রকাশিত হয়েছে]
Leave a Reply