বায়োসেন্সর হচ্ছে এক ধরনের অ্যানালাইটিক্যাল ডিভাইস বা বিল্লেশ্নধর্মী যন্ত্র। এই যন্ত্রে রয়েছে একটি জৈবিক উপাদান। আর এর সাথে রয়েছে একটি পিজিকোডিটেক্টর। এই যন্ত্র চিহ্নিত ধরতে পারে স্পর্শকাতর সব জৈব উপাদান যা জৈব পদার্থের (যেমন- এনজাইম, অ্যান্টিবডি, কোষ অঙ্গাণু, হরমোন, নিউক্লিক এসিড অথবা সম্পুর্ণ কোষ) স্থিতিশীল আস্তরণের অন্তরঙ্গ সংস্পর্শে রুপান্তরক (transducer- একটি ভৌত উপাদান) নিয়ে গঠিত, যেখানে রুপান্তরক জৈব সংকেত (Biological signal) বিশ্লেষণ করে উহাকে বৈদ্যুতিক সংকেত ( Electrical signal) পরিবর্তন করে।
একটি সেন্সর হতে পারে একটি কার্বন ইলেকট্রোড (a signal carbon electrode), একটি আয়ন সংবেদী ইলেকট্রোড (an ion-sensitive electrode), অক্সিজেন ইলেকট্রোড, একটি আলোক কোষ (a photocell) অথবা একটি থার্মিস্টার (Thermistor)। একটি বায়োসেন্সর রিডার ডিভাইসে থাকে ইলেকট্রনিকস বা সিগন্যাল প্রসেসর। এগুলোই প্রাথমিকভাবে পরীক্ষার ফলাফল ব্যবহাকারী বান্ধর উপায়ে দিয়ে থাকে। সুপরিচিত একটি বাণিজ্যিক বায়োসেন্সর হচ্ছে ব্লাড গ্লুকোজ বায়োসেন্সর। অপরদিকে তা ইলেকট্রোডের মাধ্যমে অক্সিডাইজ হয় (ইলেকট্রোড থেকে দু’টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে) কয়েকটি ধাপে। এর ফলে যে তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি হয়, তা থেকে মাপা যায় গ্লুকোজের ঘনত্ব্। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রোড হচ্ছে ট্রান্সডুসার আর এনজাইম হচ্ছে জৈবিকভাবে সক্রিয় উপাদান।
বায়োসেন্সরের কার্যাবলী অতি সাধারণ বললেও ভুল হবে না। কারন বলতে পারেন বর্তমানে জৈব পদার্থের স্থিতিশীলকরণ অবল্বনে (Immobilizationsupport, ভেদ্য পর্দা) সেন্সরের সরাসরি কাছাকাছি স্থিতিশীল (Immobilized) করা যায়। যে পর্দাকে পরিমাপ করা হবে, তাকে পর্দার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করানো হয়। এর ফলে ইহা স্থিতিশীল পদার্থের সাথে ত্রিয়া করে উৎপাদ (Products) পরিণত হয়। আর উৎপাদ হতে পারে তাপ,গ্যাস (অক্সিজেন), ইলেক্ট্রন, হাইড্রোজেন আয়ন অথবা অ্যামোনিয়াম আয়নের উৎপাদ। এরপর উৎপন্ন উৎপাদ অন্য একটি পর্দার ভিতর দিয়ে পার করে রূপান্তর ( Transducer) করা যায়। এবংরূপান্তরিত উৎপাদকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীতে সংকেত প্রস্তুতকারী যন্ত্র (Signal processing equipment) সম্প্রসারিত সংকেতকে প্রদর্শন করে যা পড়া যায় কিংবা রেকর্ড করা যায়।টেফিলন পর্দা (Teflon membrane) দ্বারা পৃথককরে পলিঅ্যাক্রাইল অ্যামাইড জেলের চতুরংশেপ্লাটিনাম অক্সিজেন ইলেকট্রোডে ইমমবিলাইজিং গ্লুকোজ অক্সিজেন দ্বারা এই গ্লুকোজ ইলেকট্রোড তৈরি হতে পারে। পটাশিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ প্লাটিনাম অক্সিজেন ইলেকট্রোডের চারদিকে রাখা হয়। এবং তা উপরের পৃষ্ঠ থেকে গ্লুকোজ অক্সিজেজ সেলুলোজ এসিটেড আবরণ দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে আবৃত হয়।যখন গ্লুকোজ দ্রবণকে পর্দা বা আবরণের সংস্পর্শে আনা হয় তখন গ্লুকোজ ও অক্সিজেন পর্দা অতিক্রম করে হয়। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Yellow Springs Instruments co. সর্বপ্রথম রক্তের প্লাজমার গ্লুকোজ নির্ণেয়ের জন্য বায়োসেন্সর আবিষ্কার করে। এতে করে বায়োসেন্সরের মাধ্যমে রক্তের প্লাজমার ছয়টি উপাদানের পরিমান নির্ধারণে ব্যাবহার হয় এবং অতি সহজেই হাতে বহন করা যায়। এর উপাদানসমূহ হচ্ছে গ্লুকোজ, ইউরিয়া, নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং ক্লোরাইড।
বায়োসেন্সরের প্রকারভেদ (Types of Biosensor)
বলতে গেলে বিভিন্ন জৈব পদার্থ ও সেন্সর যন্ত্রের (Sensor device) উপর ভিত্তি করে বায়োসেন্সরসমূহবিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। নিম্নে এদের কয়েকটি আলোচনা করা হল।
বিদ্যুৎ রাসায়নিক বায়োসেন্সর (Electo-Chemical Boisenson)
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এ ধরনের বায়োসেন্সর ইলেক্ট্রিক যন্ত্র যেমন ফিল্ডইফেক্ট ট্রান্সমিটার (field effect transmition) অথবা ইমেটিং ডায়োড (light emitting diode) ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের প্রথমটি ব্যবহৃত হলে উহা তার জমানো চার্জের পরিমাণ নির্ণয় করে আর দ্বিতীয়টি ব্যবহার হলে উহা পর্যায়বৃত্ত বিদ্যুৎ হিসাবে সিলিকা নির্ভর চিপে আলোকসাড়া রুপান্তর হয়ে আলোক বিকিরণ প্রদান করে। সুতারাং প্রথমটি পৃষ্ঠে প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করে।
অ্যামপেরোম্যাট্রিক বায়োসেন্সর (Amperometric Biosensor)
অ্যামপেরোম্যাট্রিক বায়োসেন্সর হচ্ছে একটি জৈব প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ সেন্সর এবং সেই সমস্ত বায়োসেন্সর যেগুলো বিশ্লেষকে (analyte) এনজাইম দ্বারা সংগঠিত বিক্রিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করে এবং সরাসরি কিংবা কোন মাধ্যমের মাধ্যমে ইলেক্ট্রন উৎপাদন করে। অ্যামপেরোম্যাট্রিক বায়োসেন্সর হয় এনজাইম ইলেকট্রোড অথবা ইমেডিয়েট ছাড়া বা রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তিত ইলেকট্রোড সমন্বয় গঠিত। অক্সিজেন এবং পারঅক্সাইড নির্ভর বায়োসেন্সর হচ্ছে এনজাইম ইলেকট্রোড বায়োসেন্সর। ইমেডিয়েট ব্যবহার এ ধরনের বায়োসেন্সরের কিছু উপযোগিতা বৃদ্ধি করে। এ ধরনের বায়োসেন্সরে এনজাইম এবং জারণ-বিজারণ মেডিয়েটরের মাধ্যমে ইলেকট্রনসাবস্টেট থেকে ইলেকট্রোডে বাহিত হয়।
থার্মিস্টার ধারণকারী বায়োসেন্সর (Thermistor Containing Biosensor)
বহুল প্রচলিত পদ্ধতি যেমন ইনভার্টজ (Invertase), টাইরোসিনেজ (Tyrosinase)- এর মত এনজাইম সুশোভিত করার মাধ্যমে থার্মিস্টারের সূচনা ঘটে। এছাড়া আরো কিছু থার্মোস্ট্রিক সংযুক্ত ইমিউনো অ্যাবজরবেন্ট অ্যাসে (Enzyme Linked Immuno Absorbant Assay, ELISA)-এর ক্ষেত্রে অতি উচ্চ সংবেদনশীল (১০¯১৩ মোল ডিএম¯৩ ) অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি গবেষণার জন্য থার্মিস্টর ব্যবহার করা হয়।
বায়োঅ্যাফিনিটি সেন্সর (Bioaffinity Sensor)
বায়োঅ্যাফিনিটিসেন্সর সদ্য বিকশিত হয়েছে। ইহা নির্ণয়কের (Determinant) ঘনত্বপরিমাপ করে। এ ছাড়াও বিস্তৃত প্রকৃতির কারণ হতে রেডিও লেবেল্ড (Radio Labelled), এনজাইম লেবেল্ড (Enzyme Labelled) অথবা ফ্লোরোসেন্স লেবেল্ড (Fluorescence Labelled) বস্তু ব্যবহার হয়।
সম্পূর্ণ কোষ বায়োসেন্সর বা অণুজৈবিক বায়োসেন্সর (Whole Cell Biosensor or Microbial Biosensor)
এ বায়োসেন্সরের অক্সিজেন ইলেকট্রোড ধারণকারী অণুজৈবিক সুশোভিত সম্পূর্ণ কোষ অথবা এদের কোষ অঙ্গাণু ব্যবহার করা হয়। এদের বিপুল সংখ্যক বস্তুর সাথে বিক্রিয়া করে এবং তুলনামূলকভাবে ধীরে সাড়া প্রদর্শন করে। অ্যামোনিয়া ইলেকট্রোডের সাথে ইমমবিলাইজড Azorobacter vinelandii এর সংবেদনশীলতা পল্লা বা সীমা ১০~৫ থেকে ৮*১০ মোল ডিএম-৩। এহা ৫-১০ মিনিট -২ এর মধ্যে নাইট্রেটের ঘনমাত্রা পরিমাপ করে।
আলোক বৈদ্যুতিক বায়োসেন্সর (Opto-electronic Biosensor)
এ বায়োসেন্সর পর্দা বা আবরণী পৃষ্ঠে এনজাইম অথবা এন্টিবডি সুশোভিত করা হয়। রঙ পরিমাপের জন্য একটি আবরনীতে বায়োসেন্সরের সাথে এনজাইম এবং রঙ এমমবিলাইজড করা হয়। এক্ষেত্র সাবস্ট্রেট প্রভাবিত হয়ে উৎপাদেপরিণত হয়। এ সময় মাধ্যমের pH পরিবর্তিত ঘটে। ফলশ্রুতিতে রঙ আবরণী কমপ্রেক্সের পরিবর্তন ঘটে। ফটোডায়োড ও লাইট এমিনিং ডায়োডের মাধ্যমে এই রঙ পরিবর্তন করা হয়।
বায়োসেন্সরের প্রয়োগ (Application of Biosensor)
গুরুত্বের দিক থেকে লক্ষ্য করলে বায়োসেন্সর ঔষধ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে ক্ষুদ্র আকার, দ্রুত ও সহজ পরিচালনা, সাশ্রয়ী দাম এবং অধিক সংবেদনশীলতার জন্য বায়োসেন্সরের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। নিচে কিছু ব্যবহার উল্লেখ না করলেই নয়।
ঔষধ ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বায়োসেন্সরের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যপক। ১৯৭৯ সালে রক্তের গ্লুকোজ পরিমানের জন্য সর্বপ্রথম গ্লুকোজ বিশ্লেষক (Glucose analyser) এর বাণিজ্যিকীকরন করা হয়। আর এই কাজটি করে যুক্তরাষ্ট্রের Yellow Springs Instruments Co.। ইন্সুলিনে পূর্ণ এক ধরনের ক্ষুদ্র পাম্প ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার উপর মির্ভর করে ইন্সুলিন প্রদান করে। ইহা বায়োসেন্সরের দ্বারা প্রদপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে যথার্থ পরিমাণ ইন্সুলিন রোগীকে দেয়। মাইটোমাইসিন (Mytomyci-এক ধরনের অ্যাফলাটক্সিন) সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ক্যান্সার সৃষ্টি করে। বায়োসেন্সরের মাধ্যমে ইহা নির্ণয় করা হয়। এইভাবে আরো বিভিন্ন রকম টক্সিকের উপস্থিতি বায়োসেন্সসের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।
দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার
বায়োসেন্সর পরিবেশকে তার পারিপার্শ্বিক দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম। বায়োসেন্সর উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে পানিতে ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি সনাক্ত করে পানিকে জীবাণুমুক্ত তথা দূষণমুক্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জাপানে জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা(Biological Oxygen Demand -BOD) পরিমাপের জন্য অক্সিজেন ইলেকট্রোডসহ বায়োসেন্সর এবং এমমবিলাইজড Trichosporon cutaneum ব্যবহৃত হয়।অক্সিজেন ইলেকট্রোডের সাথে ইমমবিলাজড Salamonella typhimurium ও Bacillus subtitis দ্বারা উৎপন্ন সম্পূর্ণ কোষ বায়োসেন্সর (Whole cell biosensor) বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ক্যান্সার সৃষ্টির ক্ষমতা নিরুপনে ব্যবহার হতে পারে।
শিল্পে বায়োসেন্সরের প্রয়োগ
সাধারণ ফার্মেন্টেশন ব্রুথে ব্যবহৃত পদার্থ ও উৎপন্ন পদার্থ পরিমাপের জন্য স্পেক্ট্রোফটোমিটার (Spectrophotometer) ও অটো এনালাইজার (Autoanalyzer) ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই বিশেষ ধরনের বায়োসেন্সর এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে এ কাজে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় না। বায়োসেন্সর ব্যবহার করে খাদ্যের ঘ্রাণ, সতেজতা ও স্বাদ মাপা সম্ভব। মাছের সজীবতা নির্ণয়ে ATPase, অ্যামিন অ্যামিনো অক্সিডেজ (Aminoxidase) অথবা পিউট্রেসিন অক্সিডেজ (Putrescine oxidase) ব্যবহার হয়। ATPase মাছের মাংস পেশীতে ATP-এর উপস্থিতি নির্ণয় করে।
সেনাবাহিনীতে বায়োসেন্সরের ব্যবহার
বায়োসেন্সর ব্যবহারের অন্ধকার দিক হচ্ছে সেনাবাহিনীতে এর প্রয়োগ। অন্ধকার দিকটার সাথে সাথে এর কিছু বিদ্যমান গুণও আছে বটে। দেশকে বহিঃ শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক যুদ্ধকালীন অবস্থায় বায়োসেন্সর ক্ষতিকর গ্যাস ছড়ায়।