এক্স ম্যান মুভি দেখেনি এমন মানুষ খুব কমই! কেমন হত যদি পর্দার সেই এক্স ম্যানরা আমাদের বাস্তব জগতে এসে ঘুরে বেড়াত!! সেই মিউটেন্ট ম্যান তৈরি হওয়া মনে হয় আর খুব দূরে না !! !! !!
সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৯০ মানব ইতিহাসের এক নতুন অভ্যুদয় বললে ভুল হবে না দিনটিকে। Ashi DeSilva নামে এক রোগী সর্বপ্রথম ADA-SCID রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই রোগটি মূলত দেহে এডেনোসাইন ডিএমিনেজ নামক এনজাইমের অভাবে হয়ে থাকে যার ফলশ্রুতিতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। Ashi DeSilva –র চিকিৎসা হয়েছিল জীন থেরাপির মাধ্যমেই।
তারই পদাংক অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালে প্রথম ভ্রুণ কোষে জীন থেরাপী প্রয়োগ করা হয়। জুলাই ২১, ১৯৯৭ তারিখে একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করে যার ভ্রূণের কোষে একজন দাতার ডিম্বাণু প্রবেশ করানো হয়েছিল(মাইটোকন্ড্রিয়া সহ) তা থেকে নিউক্লিয়ার ডিএনএ টাকে আলাদা করে সে জায়গায় শিশুর সত্যিকার মাতার নিউক্লিয়ার ডিএনএ প্রবেশ করিয়ে। জীন থেরাপি বলতে মোটা দাগে বোঝায় যে কোন ধরনের জীনগত রোগের চিকিৎসা করা। এ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ন জীন গুলোকে একদম ডিএনএ পর্যায়ে গিয়ে শোধরানো হয়। সাধারন ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা করানো হলে কেবল রোগের লক্ষণ দেখে চিকিৎসা করা হয়। এতে করে আসলে রোগের পিছনে দায়ী ত্রুটিপূর্ন ডিএনএর জীন পর্যায়ে কোন পরিবর্তন ঘটে না যার ফলে বংশানুক্রমে রোগটি বাহিত হবার সুযোগ থেকেই যায়। মানব দেহ গঠনের পুরোটাই আসলে নানান প্রোটিনের কারসাজি যেই প্রোটিন গুলো তৈরি করে আমাদের ডিএনএ। এখন এই ডিএনএর বিশাল সিকোয়েন্সের ক্ষুদ্র কোন এক জায়গায় ভুল হলেও সেই প্রোটিন তৈরি ব্যাহত হবে। এখন কোষের কোন এক জায়গার ভুল ডিএনএ সিকোয়েন্স সঠিক ডিএনএ সিকোয়েন্স দিয়ে ঠিক করতে হলে সঠিক ডিএনএ সিকোয়েন্সটিকে কোষের যথাযথ স্থানে নিয়ে যেতে হলে নিশ্চইয়ই একটি বাহকের দরকার পড়বে। গাড়ি ছাড়া বৌ বাপের বাড়ি যাবে কি করে? এই জীন বহনকারি গাড়ির ভূমিকায় বেশিরভাগ সময়ই অবতীর্ণ হয় ভাইরাস।ভাইরাস টা একবার সঠিক কোষের সঠিক স্থানে পৌছালেই কেল্লা ফতে! কোষে তখন ভাইরাস বাহী জীন এর সিকোয়েন্স মোতাবেক RNA তৈরি করে যেই RNA পরবর্তিতে সঠিক প্রোটিন তৈরি করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা থেকে যায় কারণ ভাইরাস নিজেই জীবের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে আক্রমণ করে আর হয়তো সঠিক কোষের সঠিক স্থানে জীন সিকোয়েন্স নিয়ে নাও যেতে পারে।
এই সমস্যার সমাধানে আসে ক্রিস্পার(CRISPR) জীন থেরাপি পদ্ধতির মাধ্যমে, যার গাল ভরা নাম Clustered regularly interspaced short palindromic repeats, যা আসলে ছোট প্রোক্যারিওটিক ডিএনএ সিকোয়েন্স যেই সিকোয়েন্সে পুনঃপুনঃ বার একই বেস সিকোয়েন্স থাকে। এই পুনরাবৃত্তি ঘটা ডিএনএ বেস সিকোয়েন্সের পরেই থাকে পূর্বে কোন ব্যাকটেরিয়াল ভাইরাস কিংবা প্লাস্মিড হতে প্রাপ্ত সিকোয়েন্স যা “Spacer Sequence” নামে পরিচিত। যা আসলে পরবর্তিতে ওই ভাইরাস দ্বারা ব্যাকটেরিয়াটি আক্রান্ত হলে ঠিক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থার মত কাজ করে ভাইরাস টাকে সনাক্ত করে ব্যাক্টেরিয়াটিকে রক্ষা করে। এই ক্রিস্পার এক প্রাচীন রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা যা অনেক ব্যাকটেরিয়াতেই দেখা
যায়।
বিবর্তনের খুব ভালো একটা প্রমাণ এই ঘটনাটা। এক কোষী প্রাণীর দেহেও কিভাবে এমন “Immune System”(রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা) গড়ে উঠেছিল যা পরবর্তিতে বহুকোষীতেও প্রকাশিত হয়।
Fig: Diagram of the CRISPR prokaryotic viral defense mechanism.
এই প্রতিরোধ ব্যাবস্থার দ্বিতীয় ধাপে আছে CAS নামে এক সেট এনজাইম যা আক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএকে কেটে টুকরা টুকরা করে। এই CAS এনজাইম তৈরি করার জীন গুলো CRISPR সিকোয়েন্সের কাছেই থাকে। আমরা যার “Prison Break” সিরিয়ালটি দেখেছই তারা হয়তো মাইকেল স্কোফিল্ড কে ভালো মতই চিনি যে কিনা FBI এর মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদের একজন। তাকে খুঁজে বের করতে নানা সময় FBI এজেন্ট মোহান স্কোফিল্ডের প্রেয়সী সারা কে অনুসরন করে। ঠিক খানিকটা তেমন কিছুই ঘটে আমারের CRISPR এর সাথে। যখন CRISPR region ভাইরাল নিউক্লিক এসিড এ পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখন সেটা হয়ে পরে একটা মোস্ট ওয়ান্টেড এরিয়া। আক্রান্ত্র ব্যাক্টেরিয়া তখন টের পায় তার দেহের কোথায় ভাইরাস আক্রমণ করেছে। ঠিক তখনই এই ক্রিস্পার সিকোয়েন্সে যায়গা করে নেয়া ভাইরাল নিউক্লিক এসিড এর বিপরিতে CAS এনজাইম টা সক্রিয় হয়ে পরে যা পরবর্তিতে ভাইরাল RNA গুলাকে কুচ কুচ করে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে! কোপা শামসু!! কোপা !! !!
এই CAS কোপা শামসুর মাঝে সব থেকে পরিচিত হল Steptococcus pyogenes এর CAS9 .
ক্রিস্পার জীন থেরাপি আসলে জীন থেরাপিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ক্রিস্পার জীন সিকোয়েন্স Prison Break এর নায়িকা সারার মত পথ দেখিয়ে CAS এনজাইমকে নিয়ে আসে যে তখন সহজেই একদম সঠিক জাইয়গায় নিউক্লিক এসিডকে খন্ডায়িত করে ফেলে। CRISPR সিকোয়েন্স CAS কে জানিয়ে দেয়
ঠিক কোন যায়গায় ডিএনএকে কাটতে হবে।
গতানুগতিক জীন প্রযুক্তি ব্যাবহার করে যেখানে বছর লেগে যায় কোন প্রাণির জীনগত পরিবর্তন ঘটাতে সেখানে মাত্র মাস খানেকেই CRISPR/CAS9 তা করে দিতে পারে আরো সঠিক ভাবে।
গতানুগতিকভাবে পরীক্ষাগারে ইদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে জীনগত পরিবর্তন ঘটাতে ভ্রুণীয় ‘Stem Cell’ ব্যাবহৃত হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় তৃতীয় প্রজন্মতে গিয়ে কাংগখিত পরিবর্তন (মিউটেশন) পাওয়া যায়। মিউটেটেড ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রথম প্রজন্মতে প্রবেশ করানোর পর তাদের সন্তান সন্ততিতে দেখা যাবে কিছু থাকবে যারা এই মিউটেটেড সিকোয়েন্স ধারণ করে আবার কিছু থাকবে যারা আগের জীনই ধারন করে। মিউটেটেড সিকোয়েন্স ধারণকারী প্রজন্মকে কোন সাধারণ প্রজন্মের সাথে প্রজনন ঘটালে যে প্রজন্ম পাওয়া যাবে তাতে কিছু সন্তান সন্ততির প্রতি কোষে এক কপি মিউটেশন বিহীন এবং এক কপি মিউটেশন ধারী জীন থাকবে। যাদেরকে হেটারোজাইগাস বলা হয়। এমন দুই হেটারোজাইগাস ক্রস করালে তার পরে গিয়ে হয়তো কাংখিত মিউটেন্ট প্রজন্ম পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে ক্রিস্পারের বেলায় কেবল ইঁদুরের স্টেম সেল এ CRISPR/CAS9 প্রবেশ করালেই হবে। তা এক বারেই জীনের উভয় কপিতে কাংখিত মিউটেন্ট জীন প্রবেশ করাতে সক্ষম হবে।
খুব সাম্প্রতিক কালে হিমোফিলিয়া বি রোগের চিকিৎসা সাফল্যের মুখ দেখেছে ক্রিস্পার জীন থেরাপির মাধ্যমেই।
এই প্রযুক্তির সব থেকে ভাল আরেকটা দিক হল যে মানুষ সহ প্রায় সব প্রাণীতেই এই পদ্ধতিতে জীন পরিবর্তন করা যায় অনেক নির্ভুল ভাবেই।
আমারা সবাই “X-Man” মুভি সিরিজের সাথে কম বেশি পরিচিত। মিউটেন্ট মানবদের এক নতুন প্রজাতি সেখানে দেখানো হয়। আমাদের ক্রিস্পার প্রযুক্তি ব্যাবহার করে হয়ত বা কোন এক কালে এমন কিছু করে ফেলা সম্ভপর হবে
যা ডেকে আনতে পারে মানবতার ধ্বংস। এখন সময়ই বলে দেবে ক্রিস্পার মানবতার আশীর্বাদ না ধ্বংসের শুরু।
Leave a Reply