জলবায়ুর পরিবর্তন পরাস্ত করেছে মানুষের দাপট – মাত্র পঞ্চাশ কোটি পৃথিবীবাসী অবশিষ্ট উত্তরের জীবন-তরীতে। কিভাবে বেঁচে আছে তারা?
১.
অভেদ্য, নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ার সুউচ্চ বহুতল ভবনের ৩০০ তলায় ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকাই – মাটির আধামাইল উপরে আমার ফ্ল্যাট থেকে মনোমুগ্ধকর বীথিদৃশ্য চোখে পড়ে: বেশ কিছু বাংলো, ছিমছাম উঠান, পান্না-সবুজ রাঙা খেলার মাঠ, সূর্যের আলো ঝিলিক দেয়া সুইমিং পুল, আর দীর্ঘ বেলাভূমির ওপারে তৈরি কিছু প্রাসাদসম অট্টালিকা। দৃশ্যগুলো লস এঞ্জেলস শহরের স্মৃতি মনে করিয়ে আকুল করে দেয়। শহরটি এখন অস্তিত্বহীন, যেখানে শান্তিপূর্ণ সময়ে বড় হয়েছেলিন আমার দাদার-দাদা, যখন নবজাতকের জন্মদান কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো না, আর সাতশ’ কোটি মানুষ মুক্তভাবে ঘুরতেন পৃথিবী বুকে।
এখন পৃথিবীতে আমরা মাত্র পঞ্চাশ কোটি মানুষ বেঁচে আছি, জলবায়ুর পরিবর্তন কমিয়ে এনেছে এ গ্রহের ধারণ ক্ষমতা (carrying capacity)। ধারণ ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয় একটি পরিবেশে জনসংখ্যা সর্বোচ্চ কতোটুকু বাড়তে পারবে। বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস লাভলক যাকে বলেছিলেন জীবন-তরী, এখন তার মাঝেই উত্তরমেরুর দূরপ্রান্তে বসবাস করছে বেশিরভাগ মানুষ, এক সময় যেখানে ছিলো কানাডা, চীন, রাশিয়াসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। যেখানে জলবায়ুর পরিবর্তন একটু হলেও সহনশীল। এক সময় যেখানে কোটি কোটি মরিয়া উদ্বাস্তুকে স্থান দিতে নিমেষেই তৈরি করা হয়েছিলো বসবাস-অনুপযোগী শহর।
জানলার বাইরে যে দৃশ্য আমি ‘দেখছি’ তা আসলে বিভ্রম। এক সময় পৃথিবী যেমনটা ছিলো, আমার আবেগী মস্তিষ্কে তার একটি কোমল, অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু কঠোর বাস্তবতায় অবিচলিত থাকা যায় না। যতদূরে দৃষ্টি যায় চোখে পড়ে কাঁচ দিয়ে ঘেরা সভ্যতার উচ্ছ্বিষ্ট। বুলেট ট্রেনকে পারাপার করার জন্যে ফিতার মতো রাজপথ ঘিরে আছে এ প্রকান্ডপুরীকে, আকাশভেদী বহু-শত-তলা উঁচু ভবন, যেখানে ঠাঁসাঠাসি করে বসবাস করছে কোটি কোটি মানুষ; গ্রীনহাউসের ভেতর বিস্তৃত ক্ষেতে রাসায়নিক-পুষ্টিতে বাড়ছে ফল-মূল-সবজি, চরে বেড়ানো গবাদিপশু, কিংবা বসন্তের রৌদ্রজ্জ্বল দিনে হেঁটে বেড়ানোর জন্য কৃত্রিম গ্রামীণ-পরিবেশ।
ভীষণ-বিপর্যয়ের ভূকম্পীয় আঘাতের আগে মানুষের চলাচল ছিলো বন্ধনহীন, তারা নিঃশ্বাস নিতে পারতো মুক্তবায়ুতে, ঘুরে বেড়াতে পারতো জঙ্গলে, মাঠে বাচ্চাদের বল খেলা দেখতে পারতো। এখন বিস্তৃত ভূমিগুলো অরক্ষিত নিষিদ্ধ এলাকা, সে অঞ্চল বিভিন্ন রোগ-দূর্যোগের প্রভাবাধীন, ঝড়ো হাওয়া প্রবল বৃষ্টির উপদ্রব সাথে নিয়ে ঘন্টায় শত কিলোমিটার বেগে আর্তনাদ করে বেড়ায়, বৃষ্টি না থাকলে রূক্ষ ধুলি-ঝড় হামলে পড়ে। যেখানে এক সময় ছিলো যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মরুভূমি থেকে গম্ভীর গুড়গুড় শব্দে ভূমি-ৎসুনামি ঢেকে দেয় বিশাল অঞ্চল। বন্য-আবহাওয়া যখন খানিকটা বিরাম নেয়, তখন দাহক সূর্য অবিরত পুড়িয়ে দেয় বায়ুমন্ডলকে, দিনের মাঝভাগে তাপমাত্রা উঠে যায় ১৮০ ডিগ্রী ফারেনহাইটেরও ওপরে, বিশেষ-দেহবর্ম ও অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ছাড়া বাহিরে বের হওয়া তখন অসম্ভব হয় যায়।
আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাও বদলে গেছে। ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় ধর্মীয় ও সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ কেন্দ্রিক-ক্ষমতা কর্তৃত্ব করতো। এখন তা ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ, কারণ পৃথিবীতে ঐ অঞ্চলগুলো এখন আর নেই। চিন ও রাশিয়ার মতো স্বৈরাচারী দেশগুলো কঠোরভাবে নিয়মতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্যোগকে সবচেয়ে ভালোভাবে সইতে পেরেছিলো। তারা মরিয়া অভিবাসীদের জন্য সীমানা বন্ধ করে দিয়েছিলো, চালু করেছিলো খাবার ও পানির রেশন-ব্যবস্থা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাধ্য করেছিলো স্থানান্তরে। “যাদেরকে আক্রমণকারী বলে মনে করে তাদের বিরুদ্ধে দেশগুলো নিজেদের সুরক্ষিত করবে, সম্ভবত ব্যক্তিস্বাধীনতাহীন কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, চীনের মতোই, তারপর যাবতীয় নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে জয়লাভ করবে” — বলেন ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক আর The Collapse of Western Civilization: A View from the Future (২০১৪) এর সহলেখক এরিক কনওয়ে।
২.
উপরের কথা হয়তো কোন রোগীর জ্বরের ঘোরে দুঃস্বপ্নদুষ্ট প্রলাপ মনে হতে পারে। তবে এখন থেকে তিন হাজার বছর আগেও জলবায়ুর পরিবর্তন অগ্রসর সভ্যতা পতনের সূচনা হিসেবে কাজ করেছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে দেড়শ বছর ধরে ঘটে চলা ভূমিকম্প, খরা ও দূর্ভিক্ষের মতো দূর্যোগ-পরম্পরা নির্ধারণ করে দিয়েছিলো পূর্ব-ভূমধ্য অঞ্চলে শেষ ব্রোঞ্জ যুগে টিকে থাকা রাজ্যগুলোর ভাঙ্গনের গতিপথ – এখন যেখানে রয়েছে গ্রীস, ইসরায়েল, লেবানন, তুরস্ক ও সিরিয়া। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা নিদর্শন অনুযায়ী পৃথিবীর ঐ অঞ্চল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রয়োগিক উন্নতির স্পন্দনের মধ্য দিয়ে গেছে তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে। প্রাচীন মাইসেনিয়া, মিনোয়া থেকে হিট্টাইট, অসিরিয়া, সাইপ্রিয়ট ও মিশরীয়দের সমাজ ছিলো পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, তারা চিকিৎসক, সংগীতজ্ঞ ও কারিগরদের সেবা বিনিময় করতো। তারা বিকশিত-বাণিজ্যপথে ব্রোঞ্জ তৈরিতে দরকারী টিনের মতো পণ্যদ্রব্য, বিভিন্ন মালামাল ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিনিময় করতো।
তবে ২০১২ সালের একটি গবেষণায় উঠে আসে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে ভূমধ্য সাগরের পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা খুব দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার খবর। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বলছে এ ঘটনা তীব্র খরাকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে দেখা দেয় খাদ্য সঙ্কট, গণহারে দেশত্যাগ, কৃষক-বিদ্রোহ। পরিণামে একসময়ের জৌলুশপূর্ণ ব্রোঞ্জযুগীয় সমাজের কেন্দ্রীয় শহরগুলো বহিরাগত সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যে বাহিনীর সেনারা সম্ভবত নিজেরাই খরা-পিড়ীত স্বদেশ ছেড়ে পলাতক। বিনাশ হয় সংস্কৃতির, ভাষার, প্রযুক্তির। ফলাফল প্রথম অন্ধকার যুগ – শেষ ব্রোঞ্জ যুগের পতন। একসময়ের পরিশীলিত ও সূক্ষ্ম সমাজের অস্তিত্ব নাশ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার পুননির্মাণ ও পুনরুদ্ধারে করতে চলে যায় কয়েক শতাব্দী।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ও 1177 BC: The Year Civilization Collapsed (২০১৪) বইয়ের লেখক এরিক এইচ ক্লিন বলেন, “তখনকার সময় সেটি ছিলো একটি বিশ্বায়িত সমাজ, প্রত্যেকেই অন্যের সাথে সংযুক্ত ছিলো, নির্ভর করতো একে অপরের ওপর। ফলে আপনারা একটা ডমিনো প্রভাব লক্ষ্য করবেন, একটি সংস্কৃতি দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে তা ধারাবাহিকভাবে বাকিদের ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে। মিশর টিকে যায় কারণ তারা প্রস্তুতী নিতে তুলনামুলক সক্ষম ছিলো। কিন্তু সে বিজয় ছিলো বহু বিপর্যয়ের, কারণ তাদের সকল বাণিজ্য-অংশীদার হারিয়ে গেছে। এক শতাব্দীর ভেতর তাদের সকল জানা বিশ্বের পতন হয়েছে”।
এর আগে সতের’শ শতাব্দীর দিকে পৃথিবীর বুকে যখন ৫০ কোটি মানুষ বসবাস করতো সে সময়ের দিকে ফিরে তাকালে শিক্ষণীয় কিছু পাওয়া যায়। কাকতালীয়ভাবে তখনও ছিলো জলবায়ু-প্ররোচিত ভীষণ অভ্যূত্থান-কাল। একইসাথে সময়টাকে ধরা হয় আধুনিক ইউরোপের ভোর – ভাবুন নিউটন, রেমব্রানৎস, গ্যালিলিও কিংবা ষোড়ষ লুইসের কথা। তখন যা ঘটেছিলো আর আজকে আমরা যেরকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তাদের মধ্যে মিল লক্ষ্যণীয়। ইতিহাসবিদরা সে সময়কে বলেন সর্বজনীন সংকটের যুগ, কারণ সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ছিলো ক্রমাগত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিশ বছরের যুদ্ধ, চীনে মিং রাজবংশ ও ইংল্যান্ডে স্টুয়ার্ট রাজতন্ত্রের পতন।
একই সাথে সময়টা ছিলো সেই শতাব্দী, যখন শিশু-তুষার যুগ সবচেয়ে তীব্র হয়ে এই গ্রহের শীতলীকরণে নের্তৃত্ব দিচ্ছিলো। এর প্রভাব উত্তর-গোলার্ধে বসবাসকারী মানুষজন টের পাচ্ছিলেন ভালো ভাবেই। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও ২০১৩ সালে প্রকাশিত Global Crisis: War, Climate Change and Catastrophe in the 17th Century বইয়ের লেখক জেফরি পার্কারের মতে সতেরশ শতাব্দীর বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক সংকটের পেছনে আবহাওয়ার ভীষণ পরিবর্তনকে পাওয়া যাবে: শীতল আবহাওয়া, সাথে সাথে ঝড় তৈরি করা এল নিনোর বাড়তি পর্যায়, যার পরিণাম বন্যা, কৃষি বিপর্যয়, খরা ও দূর্ভিক্ষ। যার পরিণাম সামাজিক অস্থিরতা, বিদ্রোহ ও যুদ্ধ। টানা সংকট স্পেন, রাশিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের মতো কর্তৃত্বশালী রাজ্যগুলোকে দূর্বল করে দেয়, মৃত্যু হয় এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার। পার্কার বলেন, “তখনকার বৈশ্বিক সংকট নিশ্চিতভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়, যেমন বর্তমানকালে একই ধরনের বিপর্যয় কোটি কোটি মানুষের অকাল মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হবে।”
ক্লাইন বলেন, “অতীতের সমাজের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো তারা টিকে থাকার জন্য প্রকৃতিমাতার দৈবানুগ্রহের উপর নির্ভরশীল ছিলো। (বিপরীতে) আমরা নিজেদের পতনের জন্য দায়ী হবো কি না সেটা দেখা এখনো বাকি আছে। আমাদের পূর্বে যেসব সভ্যতা এসেছিলো শেষ পর্যন্ত ধসে গেছে। আমরা কেন ভাবছি যে আমরা নিরাপদ?”
<!–nextpage–>
৩.
আমরা পরিবেশ-প্রতিবেশের যে পরিমাণের ক্ষতি করবো, তার ফলে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বিজ্ঞানী লাভলকের কল্পিত জীবনতরীতে নিজেদেরকে যে কোনভাবে বাঁচাতে পারবো এমন চিন্তা করাটা এক ধরনের ঔদ্ধ্যত্য। জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন গাণিতিক মডেল অনুযায়ী চলতি শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাবে অন্তত চার ডিগ্রী সেলসিয়াস, কিংবা তার চেয়েও বেশি। এ অবস্থাকে যুক্তরাজ্যের টিনডাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের গবেষক কেভিন এন্ডারসন চিহ্নিত করেছেন “যেকোন সংগঠিত, ন্যায়নিষ্ঠ ও সভ্য বিশ্ব সমাজের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ”।
প্রিন্সটোনের এন.পি.ও. ক্লাইমেট সেন্টারের প্রধান বিজ্ঞানী ও ২০১০ সালে প্রকাশিত The Weather of the Future বইয়ের লেখক হেইডি কুলেন বলেন, “মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে কোন তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা আমরা পরিলক্ষিত করবো — যে তাপমাত্রার জন্য আমরা কোনভাবেই অভিযোজিত নই। প্রতি বছরই বর্ধিত গড় তাপমাত্রা আমাদের কাছে “নতুন মান” হিসেবে গণ্য হওয়ার সাথে সাথে তার মূল ধকল শতাব্দীর শেষের দিকে ধাক্কা দেয়ার জন্য জমা হচ্ছে”। লেখিকা আরো বলেন, “আমাদের জন্য কল্পনা করা কঠিন যে পৃথিবীর একটা বিশাল অঞ্চল মানব-বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।”
তাপমাত্রা চার ডিগ্রী বাড়লে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্র কিছু অঞ্চল থেকে গণদেশান্তর দেখতে পারবো — আমাজন, ভারতের কিছু অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চল। সাগরতল উচ্চতায় চার ফিট কিংবা তার চেয়েও বেশি বাড়বে। আর টোকিও থেকে মুম্বাইয়ের মতো উপকূলীয় শহর হিংস্র ঝড়ের বন্যায় ভেসে যাবে, বাংলাদেশ ও ফ্লোরিডার মতো নিচু অঞ্চলগুলো পানিতে অর্ধনিমজ্জিত হবে, লাখো লাখো মানুষ হবে বাস্তুচ্যুত। অন্যদিকে মধ্য চীন থেকে ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চল, আফ্রিকা, আস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ল্যাটিন আমেরিকার মতো পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এলাকা এ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশুষ্ক হয়ে পড়বে। সেসব এলাকায় ভূপৃষ্ঠের উপরিতলে যেটুকু পানি ছিলো তা শুষে নেবে। আর ধ্বংস হবে ফসল যার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে লাখো লাখো মানুষ। অজস্র গবেষণা-ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে পৃথিবীবাসীর অর্ধেক, অন্তত চার’শ কোটি মানুষ পানির দুঃসহসংকটে আর অনাহারে ভুগবে।
ঝলসে দেয়া তাপপ্রবাহ আর ভয়াবহ অগ্নিকান্ড খাদ্য-দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও গণদেশান্তর উসকে দেবে। দ্রুত বেড়ে গিযে কীট-পতঙ্গেরা টাইফাস, কলেরা, পীতজ্বর, ডেঙ্গু ও ম্যালিরিয়াসহ দীর্ঘদিন ধরে সুপ্ত থাকতে সক্ষম জীবাণু, এমনকি একেবারে নতুন জীবাণু দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে দেবে, বিস্তার ঘটবে অজস্র মহামারীর, যা পৃথিবীকে আবার ব্ল্যাক ডেথের কথা মনে করিয়ে দেবে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে প্লেগ-মহামারী ইউরোপের প্রায় ২০ কোটি মানুষ মেরে ফেলেছিলো। এক সময়ের জমজমাট মহানগরগুলো পরিণত হবে নিস্তেজ ভূতুড়ে শহরে। ভেবে দেখুন ম্যানহাটন, টোকিয়ো, সাও পাওলো পানির নিচে চলে গেছে। এলোমেলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো কলোনিতে বেঁচে থাকছে কয়জন টিকে যাওয়া কষ্টসহিষ্ণু মানুষ যারা অন্ধকারাচ্ছন্ন বদ্ধ জায়গায় খুব সাবধানে বেঁচে থাকছে গল্পের ভ্যাম্পায়ারের মত। কেবল রাত হলেই বাইরে আসছে যখন তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে, গড় তাপমাত্রা সাত ডিগ্রী বেড়ে গিয়েই স্থিতিশীল হবে না, ইতিমধ্যে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে নিঃসরিত হয়েছে সেখানে জমানো তাপশক্তির কারণে জলবায়ু একশ বছরেও নতুন ভারসাম্যে পৌঁছাবে না। সম্প্রতি বিশিষ্ট জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইন্সটিটিউটের পরিচালক জেমস হ্যানসেন বলেন, “বায়ুমন্ডলে ইতিমধ্যে নিঃসরিত গ্যাসের জন্যে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হবে তার খুব সামন্যই আমরা অনুভব করছি। আরো গ্যাস বায়ুস্তরে ছড়াবে, কারণ পৃথিবীর জলবায়ুর বিশাল জাড়্যতা রয়েছে বলে তা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয় না”। মানব-সভ্যতার বেশির ভাগকে অংশকে বিদায়-চুম্বন জানানোর আগপর্যন্ত এই গ্রহ তাই ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকবে, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনে চক্রাকারে যোগাতে থাকবে আরো বেশি ইন্ধন।
দ্বিবিংশতম শতাব্দীতে যখন আমরা প্রবেশ করবো, পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত ক্রান্তীয় বাদলবন মরুআবৃত হয়ে পড়বে, আর আলপিন বন সমূহ দাবানলের রোষে রুষ্ট হবে। বৈজ্ঞানিক জার্নাল সায়েন্সে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জীববিজ্ঞানী রডলফ ডিরাজো ও সহকর্মীরা ভবিষ্যদ্বানী করেছেন যে আমরা এই পৃথিবীর ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির প্রান্তে আছি, যা পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতীর মাঝে ৯০ শতাংশকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। পৃথিবীর বিষুবীয় এলাকায় যে সব পশু-পাখিরা ঘুরে বেরায় তারা হারিয়ে যাবে। অস্ট্রেলিয়া পুনরায় মনুষ্যবিহীন গনগনে মরুভূমিতে পরিণত হবে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলি, হাওয়াই থেকে ফিজি, চলে যাবে সাগরতলে।
এতো কিছুর পরেও ইতিহাস আমাদের প্রজাতীর বেঁচে থাকার জন্য একটা পথ দেখায়। পার্কার তার তথ্যবহুল গবেষণার বিশ্লেষণে এক চমকপ্রদ উপসংহার টেনেছেন। সপ্তদশ-শতাব্দীর বঞ্চনা কল্যাণ-রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দেয়, যা উনবিংশ শতাব্দীতে সকল আধুনিক ও অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর রাষ্ট্রসমূহের মূল-বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। তিনি উল্লেখ করেন, “সপ্তদশ-শতাব্দীর মতোই একবিংশ-শতাব্দীতেও ব্যাপক মাত্রায় বিপর্যয় সামলাতে হলে যে সম্পদ লাগবে তা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারই ব্যবস্থা করতে পারবে। যদিও সপ্তদশ- ও একবিংশ-শতাব্দীর মাঝে পার্থক্য বহু, [তবে] শিশু তুষারযুগের সরকারসমূহ এখনকার মতো একই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছে … [শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পেরেছে] যে, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে সস্তা ও দক্ষতর (এবং বেশি মানবিক) কাজ হবে যারা বৃদ্ধ, বিধবা-বিপত্নীক, অসুস্থ, পঙ্গু কিংবা বেকার তাদেরকে সহায়তা করা, ফলাফলে পৃথিবীর প্রথম ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ উৎপত্তি।”
তাই আগামীর মহাবিপর্যয়ের চিত্র কল্পনা করে অনেকে যে শঙ্কিত, সে তুলনায় আমরা মানুষ প্রযুক্তিতে অনেক-উন্নত। আশা করা যায় সামাজিকভাবে পরিশীলিতও বটে। তাই জলবায়ু বিপর্যয় বর্বরদের মতো মোকাবেলা না করে মনুষ্যপ্রজাতির বেঁচে যাওয়া সদস্যরা কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত খাবার খেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ শহরের উঁচু ভবনের মাঝে ভিড় করবে, ভূমি থেকে বহু উপরে যেখানে তারা পূনর্বার তৈরি করবে পৃথিবীর নতুন সংস্কৃতি।
মূল লেখা: Scorched Earth, 2200AD by Linda Marsa. Published in Aeon (online magazine). 10 February 2015.
লেখক পরিচিতি: লিন্ডা মার্সা ডিসকভার ম্যাগাজিনের অবদানকারী-সম্পাদক, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলসের লেখক প্রোগ্রামের শিক্ষক ও ২০১৩ সালে প্রকাশিত Fevered: Why a Hotter Planet Will Hurt Our Health বইটির লেখক।
Leave a Reply