ইশেরশিয়া কোলাই বা ই. কোলাই হলো অণুজীব জগতের সেলিব্রেটি। যারা অন্তত একটা অণুজীবের নাম জানেন তাদের ক্ষেত্রে এ অণুজীবটির নাম হয় ই কোলাই। ১৮৮৫ সালে জার্মান-অস্ট্রিয়ান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ থিওডোর ইশেরিখ মানুষের মলে ই. কোলাই আবিষ্কার করেন। তিনি দেখেন অনেক শিশু ডায়েরিয়ায় মারা যাচ্ছে। জার্ম থিওরি তখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কিন্তু এশেরিখ ধারণা করলেন জার্ম থিওরির মাধ্যমেই এই রোগের কারণ বের করা যাবে। জার্ম থিওরিই প্রথম বলেছিলো যে অণুজীবের কারণের রোগের সৃষ্টি হয়। তিনি শিশুদের মল সংগ্রহ করে তা কালচার করলেন এবং তাতে রড আকারের এক ধরণের অণুজীব দেখলেন। তিনি তার নাম দিলেন Bacillus communis coli. এশেরিখের মৃত্যুর পর তার সম্মানে অণুজীবটির নাম রাখা হলো Escherichia Coli
ই কোলাই রড আকারের একটি গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া। এরা fecultative anaerobic. কথাটার মানে হলো এরা অক্সিজেনের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি উভয় অবস্থাতেই টিকে থাকতে পারে। এটি উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর অন্ত্রে বাস করে। ই কোলাই মাত্র বিশ মিনিটে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলো এদের জন্যে অনুকূল তাপমাত্রা। ই কোলাই মূলত কোলিফর্ম (Coliform) গোত্রের অণুজীব। কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া তারাই যারা ল্যাকটোজকে ফার্মেন্ট করতে পারে।
আমাদের শরীরে কিছু অণুজীব এমনিতেই থাকে। এরা আমদের কোন ক্ষতি করে না। উলটো আমাদের শরীরবৃত্তীয় নানা কাজে সাহায্য করে। এদেরকে বলা হয় Normal Microbiota. ই কোলাই এই নরমাল মাইক্রোবায়োটার অংশ। কিন্তু আমাদের জন্মগ্রহণের সময় আমাদের দেহে কোন মাইক্রোবায়োটা থাকে না। মার দুধ থেকে, নার্স কিংবা অন্যান্য আশেপাশের মানুষ থেকে প্রায় হাজার ধরণের অণুজীব শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। ওই এক হাজারের মধ্যে একটি হলো ই কোলাই। ই কোলাই আমাদের অন্ত্রে ক্ষতিকর কোন অণুজীবের বাসা বাঁধতে বাধা দেয় না।
জেনেটিক্স এবং অণুজীববিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে ই কোলাইকে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। কোহেন এবং হারবার্ট বয়ের ই কোলাইকে ব্যবহার করে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ তৈরি করেন। এভাবে ই কোলাইকে জেনেটিকাল পরিবর্তন করে ভেক্সিন তৈরি, নানা ধরণের এনজাইম তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হলো ই কোলাই ব্যবহার করে ইনসুলিন তৈরি। যা লাখ লাখ ডায়েবেটিস রোগীর জীবনকে সহজ করেছে।
নানাবিধ সুবিধা থাকার কারণে ই কোলাইকে মডেল অর্গানিজম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। Joshoua Lederberg এবং Edward Tatum ১৯৪৬ সালে ই কোলাই ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়ার কনজুগেশন আবিষ্কার করেন। T2 ফাজ ভাইরাসের জেনেটিক্স বুঝার জন্যেও ই কোলাই বিশাল বড় ভূমিকা রেখেছে। Carl Zimmer এক ইন্টার্ভিউতে বলছিলেন, তিনি জানতে চাচ্ছিলেন জীবন কি? জীবনের প্রকৃতি কি? তিনি একটা বই লিখতে চাইলেন এ বিষয়ে। তিনি দেখলেন এ বিষয় নিয়ে বই লিখতে গেলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেগে যাবে। তিনি জীবনকে ই কোলাইয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার জন্যে লিখলেন “Microcosm: E. Coli and the New Science of Life” যেখানে তিনি একই বিষয় নিয়েই লিখেছেন কিন্তু তা ই কোলাই এর উপরে।
প্রতিটি ই কোলাই এ প্রায় ৪০০০ হাজারের মত জিন আছে। যেখানে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ায় জিনের সংখ্যা মাত্র কয়েকশ। ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম ই কোলাই এর ডিএনএ সিকুয়েন্সিং করা হয়। দেখা গেছে ই কোলাই এর বিভিন্ন স্ট্রেইনের মধ্যে ২০% জিনের মিল আছে। বাকি ৮০ % মিল নেই। এই ৮০% মিউটেশন ও অন্য প্রজাতি থেকে জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে হয়েছে। ই কোলাই এর প্রতিটি জিনকে চারটি অক্ষর দ্বারা প্রকাশ করা হয়। রিকম্বিনেশনের জন্যে দায়ী জিনকে recA দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একইভাবে রয়েছে recB,recC,recD ইত্যাদি। আর প্রোটিনগুলোকে লেখা হয় বড় হাতের অক্ষর দিয়ে যেমনঃ RecA,RecB,RecC ইত্যাদি। জিন সিকুয়েন্সিং করার পর জিনগুলোকে সংখ্যা দ্বারা লেখা হয়। যেমনঃ b2819 দিয়ে recD জিনকে বোঝায়।
ই কোলাই আমাদের জন্যে ভিটামিন কে তৈরি করে। এটি আমাদের অন্ত্রের অক্সিজেন ব্যবহার করে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে যা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার জন্যে সহায়ক। ওসব ব্যাকটেরিয়া তখন আমাদের নানা ধরণের খাবার ভেঙ্গে দিয়ে হজমে সাহায্য করে।
ই কোলাই এর সব স্ট্রেইন রোগ সৃষ্টি করে না। কয়েকধরণের ই কোলাই রোগ সৃষ্টি করে। প্রত্যেকটা ধরণকে এক একটা ভিরোটাইপ (Virotype) বলে। নিচে ভিরোটাইপগুলো দেয়া হলো।
এর একটা হলো ETEC অর্থাৎ Enterotoxigenic E coli. নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এরা টক্সিন তৈরি অর্থাৎ বিষক্রিয়ার মাধ্যমে রোগ সৃষ্টি করে। এরা শিশুদের ডায়েরিয়া সৃষ্টি করে। সাথে তৈরি করে ট্র্যাভেলার্স ডায়েরিয়া।
EPEC মানে হলো Enteropathogenic E. Coli । এরা কোন বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে না। এদের রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনেকটা Shigella অণুজীবের মত। এরা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডায়েরিয়া সৃষ্টি করে।
EHEC বা Enterohemorrhagic E. coli. এদের কারণে রক্ত ডায়েরিয়া হয়।
EIEC বা Enteroinvasive E. coli এবং EAEC বা Enteroaggregative E. coli এই দুই ভিরোটাইপের জন্যেও ডায়েরিয়া হয়।
ই কোলাই দিয়ে আক্রান্ত হলে পেট ব্যথা , পাতলা পায়খানা, গ্যাস, ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব, জ্বর এই ধরণের উপসর্গ দেখা যায়। রোগ আরও খারাপ পর্যায়ে গেলে প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
ই কোলাই ঘটিত ডায়েরিয়ার জন্যে মূলত সালফোনামাইডস, এম্পিসিলিন, সেফালোসপরিন, ফ্লোরোকুইনোলোন্স, এমিনোগ্লাইকোসাইড ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার সাথে রোগীকে যথেষ্ট পরিমাণে পানি, সেলাইন খেতে হবে ও প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে। উপসর্গ যদি খারাপের দিকে যায় তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও দরকার হতে পারে।
এই ধরণের রোগ থেকে বাঁচার জন্যে খাবার ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। হসপিটালে যাতে ই কোলাই এর সংক্রমণ না হয় সে জন্যে হসপিটালে সবসময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
আগামী লেখায় টাইফয়েড রোগের জীবাণু Salmonella Typhi নিয়ে লিখবো। সে পর্যন্ত সবাই ই কোলাই সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকুন আর আপনার শরীরের উপকার করার জন্যে ই কোলাইকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন।
(লেখাটি মাসিক বিজ্ঞান ম্যাগাজিন জিরো টু ইনফিনিটির আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)
Leave a Reply