ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের একটি দ্বীপরাষ্ট্র স্যান লরেঞ্জোর শাসক ‘পাপা মনজানো’র বাবা ছিলেন একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। তার একটি আবিষ্কার হল রহস্যময় আইস-নাইন। যার সংস্পর্শে এলে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিও জমে গিয়ে আইস-নাইনে পরিণত হয়। বহুকাল সেই আইস নাইন ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। একসময় পাপা মনজানো ক্যান্সারের যন্ত্রণা সইতে না পেরে আইস-নাইন খেয়ে আত্নহত্যা করেন। তার জমে যাওয়া দেহের স্পর্শে এসে তার ডাক্তারও জমে গিয়ে মারা যান। এ যেন ছোটবেলায় খেলা বরফ-পানির বাস্তব এবং ট্র্যাজিক সংস্করণ। এতটুকুই নয়, ঘটনাক্রমে পাপার দেহ গিয়ে পড়ে সমুদ্রে এবং সারা পৃথিবীর পৃষ্টে ও পেটে যত পানি আছে সব জমে গিয়ে বিশাল দূর্যোগ সৃষ্টি করে। বাকীটা জানতে হলে পড়তে হবে কার্ট ভনেগাট এর লেখা কল্পকাহিনী Cat’s Cradle।
আমাদের সৌভাগ্য যে আইস-নাইন কাল্পনিক, কিন্তু দূর্ভাগ্য এর জৈবিক প্রতিরূপ বাস্তব, যার নাম প্রিয়ন। ব্রায়ান কহে এবং পিটার ল্যান্সবারি ভেড়ার স্ক্র্যাপি রোগের বিষয়ে রচিত একটি নিবন্ধে কাল্পনিক আইস নাইনের সাথে প্রিয়নের তুলনা করেন।
প্রিয়ন কি? সেটা বুঝতে হলে আগে একটু বুঝতে হবে প্রোটিন কি, মূলত প্রোটিনের গঠন।
কুড়ি ধরনের অ্যামিনো এসিড আছে, যারা মিলে মিশে হাজার হাজার প্রোটিন তৈরি করে। কোষে যখন প্রোটিন সংশ্লেষিত হয় তখন প্রথমে বিভিন্ন অ্যামিনো এসিড একে অপরের সাথে চেইনের মত করে যুক্ত হয়। এই চেইন কিন্তু প্রোটিনের মত কাজ করেনা, এর জন্য চেইনটাকে নানান ভাবে ভাজ খেয়ে, প্যাঁচ খেয়ে কখনো কখনো অন্য আরেক চেইনের সাথে গিট্টু বেধে নির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক আকৃতি অর্জন করলে তবেই সেই প্রোটিন আমাদের উপকারে আসবে। সে এক বিশাল আয়োজন। তবে যাই হোক, এই যে প্যাঁচ গোচের ব্যাপার আছে প্রোটিনের গঠনে, তাতে যদি উল্টা-পাল্টা কোন ভুল হয়? হ্যা ভুলের সবসময়ই একটা মাশুল আছে যা সেই প্রোটিনকেই দিতে হয় অন্য আরেক প্রোটিনের ঘ্যাচ ঘোচের শিকার হয়ে। তবে কখনো কখনো, ভুল প্যাঁচের প্রোটিন ঠিকই ফাঁকি দিয়ে বেঁচে যায়। আর নানান অসুবিধার কারণ হয়, এদের মধ্যে যেগুলো ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়ার মত সংক্রামক রোগ সৃষ্টি করে সেগুলোই প্রিয়ন।
আচ্ছা তা বুঝলাম, তো প্রিয়ন কিভাবে রোগ সৃষ্টি করে?
উদাহরন হিসেবে ভেড়ার রোগ স্ক্র্যাপির কথাই ধরি, তার আগে বলে নিই স্ক্র্যাপি হলে ভেড়ার কি হয়। নিজেই নিজের হাত পা কামড়ায়, হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঝাকায়, মাতালের মত হাটাহাটি করে, কোন জিনিসে ক্রমাগতভাবে আঘাত করতে থাকে, সময়ে সময়ে খরগোসের মত সামনের দু পা তুলে লাফানোরও চেষ্টা করে। ভেড়ার সমাজে কোন গল্পকার থাকলে নিশ্চয়ই স্ক্র্যাপি আক্রান্ত ভেড়াদের নিয়ে ভয়ংকর সব গল্প লিখতে পারতেন। ভেড়ার মগজে প্রয়োজনীয় একটি প্রোটিনের ভুল প্যাঁচ খাওয়া রূপ স্ক্র্যাপির জন্য দায়ী একটি প্রিয়ন। এই প্রিয়নের সংস্পর্শে এলে ভালো প্রোটিনও নিজের আকৃতি বদলে প্রিয়ন হয়ে যায়, ঠিক যেমন আইস নাইনের সংস্পর্শে এসে পানি বদলে যায় আইস-নাইন এ। এবং এভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রিয়ন জমে, আর ভেড়ার নিউরন ধ্বংস করে। ভেড়ার দেহ থেকে নানা ভাবে এই প্রিয়ন পরিবেশে ছড়ায়। সুস্থ ভেড়া খাদ্যের সাথে কিংবা অন্য কোন ভাবে পরিবেশ থেকে এই প্রিয়ন গ্রহন করলে সেও স্ক্র্যাপিতে আক্রান্ত হয়। শুধু কি ভেড়া? গরুর বিখ্যাত “ম্যাড কাউ” রোগের কারণ প্রিয়ন। আফ্রিকার মানুষখেকো জংলী গোষ্ঠীতে ক্রাউতজফেলডট-জ্যাকবস ডিজিসের কারণ প্রিয়ন। এছাড়াও আলঝেইমার, পার্কিন্সন্স, হান্টিঙ্গটনে কিছু প্রোটিনের প্রিয়নের মত আচরণকে বিজ্ঞানীরা দায়ী করেন।
যদিও প্রিয়নে কোন ডিএনএ/আরএনএ থাকেনা কিন্তু তবুও এরা ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়ার মত নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং সেই তথ্য নিজেরা ধারন করে। এরা আবার রোগেরও সৃষ্টি করে, সে রোগ আবার সংক্রামকও হয়। কোন নিউক্লিক এসিডের সাথে যোগসাজস ছাড়াই শুধু প্রোটিন যে এসব করতে পারে, ১৯৮২ তে স্ট্যানলি প্রুজিনারের দেয়া সেই ধারনা বিজ্ঞানীমহলে আমন্ত্রিত হয় যথেষ্ট বিদ্রুপ এবং উপহাসের সাথে। তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা অহরহই ঘটে, সেকালের অপবাদ একালের মতবাদ হয়ে দাড়ায়। প্রিয়নের ব্যাপারটাও এমন। ধীরে ধীরে এর গ্রহনযোগ্যতা বাড়লো। তবে ২০১০ সালে ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির জিয়ান মা এর হাত ধরে প্রিয়ন তার অকাট্য প্রতিষ্টা লাভ করে। উনি তার সহকর্মীদের সাথে রিকম্বিন্যান্ট প্রোটিন থেকে একদম আনকোরা এক সংক্রামক প্রিয়ন তৈরি করে দেখান।
প্রিয়নের নামে অনেক বদনাম করা হলো, চলুন এবার কিছু ভালো কথা শোনা যাক।
ঈস্টের নির্দিষ্ট একটা বৈশিষ্ট্যের অমেন্ডেলীয় বংশগতি জিনতত্ববিদদের বহুদিন অন্ধকারে রেখেছিলো। নিম্নমানের পুষ্টিকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম সুপার ডুপার কোন ঈস্ট এবং অতি সাধারন কোন ঈস্টের সাথে যদি মিলন হয় তাহলে দেখা যায় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সবারই সেই সুপার ডুপার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু মেন্ডেলীয় জিনতত্ব অনুযায়ী অর্ধেকে এই বৈশিষ্ট্য সঞ্চারনের কথা। এই ধরণের বংশগতি এর আগে শুধু মাত্র নিউক্লিয়াসের বাহিরের থাকা জিন যেমন মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ তে লেখা বৈশিষ্ট্যের জন্য দেখা গেছে। ১৯৯৪ সালে রিড উইকনার এই ধাধার সমাধান প্রদান করেন। তিনি বলেন যেই প্রোটিনের(URE2) কারণে এই সুপার ডুপার বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, সেই প্রোটিনের গঠনে সামান্য একটু পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রিয়ন তৈরি হয়। এই প্রিয়ন আবার অন্যান্য URE2 কেও প্রিয়নে বদলে ফেলে এবং কোষ বিভাজনের সময় ঠিকই দুটি নতুন কোষে মাতৃ কোষ থেকে রয়ে যায়।
উইকনারের এই ধারণা দুটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের উন্মোচন করে। প্রথমত, প্রিয়ন স্তন্যপায়ী ছাড়াও প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্যে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত প্রিয়ন বংশগতিতে অবদান রাখতে পারে।
পরবর্তীতে গবেষনার মাধ্যমে ঈস্টে আরো ডজনখানেক প্রিয়ন পাওয়া গেছে যেগুলো নানান ভাবে ঈস্টের জন্য উপকারী। এর মধ্যে একটি হলো Flo11p। এই প্রিয়নগুলো ঈস্টকে প্রতিকূল পরিবেশে একে অন্যের সাথে জড়াজড়ি করে থাকতে, অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক পরিবেশের দিকে কলোনীর বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। Flo11p আবার আরেক গ্রুপ প্রিয়ন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এই গ্রুপের প্রিয়নগুলো এমনভাবে সমন্বিত যেন পরিবেশে খাদ্যের পরিমাণ, অম্লত্ব/ক্ষারত্বের পরিবর্তন- এসবের বিপরীতে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য শারীরিক প্রক্রিয়া গুলোকে ট্রিগার করে অর্থাৎ অনেকটা সুইচের মত কাজ করে।
কোষবিদ্যার নানা পর্যায়ে যেটা ঈস্টের জন্য সত্য, তার সত্যতা উচ্চতর প্রাণিদের মধ্যেও পাওয়া গেছে। প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে আমরাও কি প্রিয়ন সুইচের ব্যবহার করে আসছি অজান্তেই?
২০০৩ সালে কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এরিক ক্যানডেলের মনে হলো CPEB(Cytoplasmic Polyadenylation Element Binding protein) নামের একটি নিউরন প্রোটিনের সাথে ঈস্টের কিছু প্রিয়নের মিল আছে। সামুদ্রিক স্লাগের CPEB নিয়ে নাড়াচাড়া করে তারা বের করেন যে এই প্রোটিন দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি গঠনে কাজে লাগে। আরো দেখা যায় এরা বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারে সাড়া দিয়ে সিনাপ্সে শুধু নিজেদেরই সংখ্যাবৃদ্ধি করেনা, বরং দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি গঠনে প্রয়োজনীয় আরো কিছু প্রোটিন সংশ্লেষে ভূমিকা রাখে। তার মানে আমাদের নিউরনও প্রিয়নকে সুইচের সুবিধা নিচ্ছে কোন অঘটন ছাড়াই। আরেকটি গুরুত্বপুর্ন প্রিয়ন সুইচের কথা বলা যায়, যেটা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে সহায়তা করে। কোষ যদি ভাইরাস আক্রমনের শিকার হয় সেখানে MAVS প্রোটিনটি প্রিয়নের ন্যায় নিজেদের বহুসংখ্যক প্রতিলিপি তৈরি করে যার ফলে ইন্টারফেরন নিঃসরন আরো জোড়ালো হয় এবং দেহ দ্রুত ম্যাক্রোফাজের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে, যেটা কোষের জন্য ভয়ানক কিন্তু দেহের জন্য অপরিহার্য।
তো আমরা বুঝতে পারলাম ক্ষেত্রবিশেষে প্রিয়নের ভূমিকা কখনো ভালো, কখনো মন্দ। কখনো মগজে মগজে করে নিউরন ধ্বংস, কখনো আচরন যেন স্মৃতি ধারণের অংশ। আবার দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতেও প্রিয়নের হাত আছে। আর ঈস্টের ক্ষেত্রে তো দলবদ্ধভাবে প্রতিকূলতার মোকাবিলাতে প্রিয়নই সাহায্য করছে। আইস নাইন এর জৈবিক প্রতিরূপ এই প্রিয়ন। এরা কি ভালো না মন্দ? সে বিচার আপনার।
[লেখাটি জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনের আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত]তথ্যসূত্রঃ The bright side of prion by Randal Halfman, The Scientist
Leave a Reply