নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যু (জামাল নজরুল ইসলাম)

লিখেছেন

লেখাটি , , বিভাগে প্রকাশিত

নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয় তা সঠিকভাবে এখনো জানা যায়নি। মহাকাশে বিভিন্ন নক্ষত্রের মাঝে যে জায়গা তা শূন্য মনে হলেও আসলে তা শূন্য নয়। বরং সেখানে পাতলা এবং হালকা বাষ্পীয় মেঘ থাকে যা বেশিরভাগ হাউড্রোজেন দিয়ে তৈরি। এই বাষ্পীয় পদার্থ সব জায়গায় একই পরিমাণে থাকে না। কোথাও এই ঘনত্ব কম কোথাও বেশি। অধিকাংশ জায়গায় তার ঘনত্ব খুব কম, প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ১০^-১৯ কিলোগ্রাম। এক ঘনমিটারে পানির ওজন প্রায় ১০^ বা ১০০০ হাজার কিলোগ্রাম। অন্যভাবে বলা যায় যে, মহাকাশে এক ঘনমিটারে প্রায় ১০ কোটি পরমাণু থাকে। আমরা জানি যে, দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল নির্ভর করে দূরত্বের ব্যস্তবর্গের উপর এবং দুটি ভরের গুণ ফলের উপর। সুতরাং কোনো বাষ্পীয় মেঘের ঘনত্ব যখন বেশি তখন মেঘের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অভিকর্ষ বলও বেশি হয়।

কখনো কখনো বাষ্পীয় মেঘের ঘনত্ব এত বেড়ে যায় যে মেঘের বস্তুগুলো আকর্ষণের ফলে পুঞ্জীভূত হয়ে যায়। মেঘের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আকর্ষণ বেড়ে গেলে ঘনত্ব আরো বাড়ে এবং ফলে মেঘের কণাগুলোর বিক্ষিপ্ত গতিও বেড়ে যায়। কিন্তু পদার্থের বিক্ষিপ্ত গতির জন্যই সৃষ্টি হয় তাপ। তাই ঐ মেঘের তাপ বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে নক্ষত্রের রূপ ধারণ করে ও মৃদু লাল রংয়ের আলো ছড়ায়। এই পর্যায়ে নক্ষত্রটি অভিকর্ষ শক্তির কারণে উজ্জ্বল দেখায় অর্থাৎ তার অভিকর্ষ শক্তি তাপ-আলোক শক্তিতে পরিণত হয়ে তাকে উজ্জ্বল করে। এই পর্যায়ে নক্ষত্রকে আদি নক্ষত্র বা প্রটোস্টার বলে। উদাহরণস্বরূপ কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলে একটি মেঘ দেখা যায়। অনুমান করা হয়েছে যে, সেখানে এইভাবে নক্ষত্রের সৃষ্টি হচ্ছে। এই মেঘ প্রায় ১৫০০ আলোক বৎসর দূরে এবং এর ভিতর বহু আদি নক্ষত্র আছে। আদি নক্ষত্রগুলো বেশির ভাগ অবলোহিত আলোক বিকিরণ করে। এই নক্ষত্রমণ্ডল থেকে অবলোহিত বিকিরণের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই অনুমান করা হয় যে, এখানে নক্ষত্রের সৃষ্টি হচ্ছে।

চিত্রঃ এই মেঘটা কালপুরুষ (orion) নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত এবং অনুমান করা গেছে যে এতে নক্ষত্রের সৃষ্টি হচ্ছে।

 

অভিকর্ষ শক্তি নক্ষত্রের তাপ-আলোক শক্তির একমাত্র উৎস হলে নক্ষত্রটি বেশি দিন উজ্জ্বল থাকতে পারতো না। যেমন সূর্যের উজ্জ্বলতা শুধুমাত্র অভিকর্ষ শক্তির জন্য হলে সূর্য মাত্র দুই কোটি বৎসর উজ্জ্বল থাকতো। কিন্তু ভূতত্ত্ব গবেষণায় জানা গেছে যে, পৃথিবীর বয়স সাড়ে চার কোটি বৎসর। সুতরাং সূর্যের বয়স এর কম হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে নক্ষত্র তার অধিকাংশ শক্তি পায় কেন্দ্রীণ জ্বলুনী বা সংশ্লেষণ থেকে। যখন কোনো একটি নক্ষত্রের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ লক্ষ ডিগ্রী কেলভিন হয় তখন সেখানে কেন্দ্রীণ মিথষ্ক্রিয়া বা নিউক্লিয়ার রি-একশন শুরু হয়।

এই ধরনের তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং হাইড্রোজেন গ্যাস ইলেকট্রন আর প্রোটন গ্যাসের রূপ ধারণ করে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীণ মিথস্ক্রিয়ার ফলে চারটি প্রোটন আর দুটি ইলেকট্রন মিলে হিলিয়াম কেন্দ্রীণ তৈরি করে। প্রথমত দুটি প্রোটন এবং দুটি ইলেকট্রন মিলে দুটি নিউট্রন এবং দুটি নিউট্রিনোর সৃষ্টি হয়। এই বিপরীত বিটাভঙ্গন প্রক্রিয়া নিচের সূত্র দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

 

P + e^ –> n + v

সাধারণ অবস্থায় এই বিক্রিয়া ঘটে না কিন্তু নক্ষত্রের অভ্যন্তরে অতন্ত্য বেশি তাপমাত্রায় তা ঘটতে পারে। অধিকাংশ নিউট্রিনো সৃষ্টি হবার পরেই নক্ষত্রের বাইরে চলে যায়। কারণ নিউট্রিনোর অন্য কোনো বস্তুকণার সঙ্গে বিক্রিয়া খুবই কম ঘটে। এরপর দুটি নিউট্রন অন্য দুটি প্রোটনের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিলিয়াম কেন্দ্রীণের সৃষ্টি করে-

Zp^4 + Zn –> He^4

 

অবশ্য এই বিক্রিয়া সরাসরিভাবে হয় না। এর কতগুলো মধ্যবর্তী পর্যায় আছে যেখানে ডিউটেরিয়াম, ট্রিটিয়াম এবং হিলিয়াম-৩ এই বস্তুকণাগুলির সৃষ্টি হয়। ডিউটেরিয়ামে একটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন থাকে। ট্রিটিয়ামে একটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রন থাকে। হিলিয়াম-৩ এ দুটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন থাকে। হিলিয়াম-৪ কেন্দ্রীণকে আলফা কণাও বলা হয়। আলফা কণা সৃষ্টি হলে নিউট্রনগুলো স্থায়ী হয়ে যায় অর্থাৎ তাদের আর বিটাভঙ্গন হয় না। সুতরাং চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলিত হয়ে একটি স্থায়ী হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি হয়।

এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু শক্তি উৎপাদন হয়। উৎপন্ন শক্তি কোথা থেকে আসে? একটি হিলিয়াম পরমাণুর ভর ৪টি হাইড্রোজেন পরমাণুর মোট ভরের চেয়ে কিছুটা কম। তাই ৪টি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে একটি হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি হলে অতিরিক্ত ভরটুকু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তি তাপ, আলোক এবং চুম্বক বিকিরণরূপে ছড়িয়ে পড়ে।

 

ভর ও শক্তির এই পরিবর্তন ঘটে আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী। যদি এক গ্রাম ভর এইভাবে শক্তিতে রুপান্তারিত হয় তাহলে আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে ১০^২১ আর্গ শক্তির সৃষ্টি হয়। ৪টি হাইড্রোজেনকে একত্রিত করে হিলিয়াম সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ফিউশন বলে। এই ফিউশন প্রক্রিয়া দিয়েই হাইড্রোজেন বোমায় প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হয়। আশা করা যায় যে, ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে এ প্রচণ্ড শক্তিকে মানুষের উপকারের জন্যই ব্যবহার করা হবে। নক্ষত্রগুলো তাদের প্রচণ্ড শক্তি বলে প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ করে।

অভিকর্ষ শক্তির রূপান্তর এবং পারমাণবিক কেন্দ্রীণের জ্বলুনির ফলে যে তাপ এবং অন্যান্য বিকিরণের সৃষ্টি হয় তা নক্ষত্রের মধ্যে একটি বহির্মুখী চাপের সৃষ্টি করে। এই চাপ এবং মাধ্যাকর্ষণ বল ভারসাম্য রক্ষা করে। এই তারা ভারসাম্যের জন্যই নক্ষত্র একটি স্থায়ী পর্যায়ে চলে আসে। এভাবে তারা কয়েক লক্ষ বছর থেকে কয়েক কোটি বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। এই পর্যায়ের স্থায়িত্ব নির্ভর করে নক্ষত্রের ভর এবং অন্যান্য গুণের উপর। এই পর্যায়ের তারাগুলোকে জ্যোতির্বিদ্যারর প্রধান ধারার তারা বলে। এই পর্যায়ই নক্ষত্রের দীর্ঘতম অংশ। সাধারণত বড় নক্ষত্রের শক্তি উৎপাদনের হার বেশি। আমাদের সূর্য অপেক্ষাকৃত ছোট নক্ষত্রের একটি। এই সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি গ্রাম ভরে দুই আর্গ শক্তি উৎপন্ন হয়। পক্ষান্তরে সূর্যের তুলনায় কোনো বড় নক্ষত্রে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি গ্রাম ভরে দুই হাজার আর্গ শক্তি সৃষ্টি হতে পারে। তাই অনেক বড় নক্ষত্রের বেলায় প্রধান ধারার পর্যায়টি মাত্র কয়েক লক্ষ বছর। সূর্যের বেলায় এই পর্যায়ের ৪৫০ কোটি বছর ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে এবং কয়েক শত কোটি বছর ধরে এই পর্যায় চলবে।

 

নক্ষত্রগুলোতে পারমাণবিক কেন্দ্রীণ বিক্রিয়া শুধুমাত্র হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তর হয়ে শেষ হয়ে যায় না। বরং হিলিয়াম থেকে আরো ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণ তৈরি হয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আরো বেশি তাপমাত্রা। যখন নক্ষত্রের কেন্দ্রে সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় তখন সেখানে অন্তর্মুখী মাধ্যাকর্ষণ বলের টান সামলাবার জন্য যথেষ্ট বহির্মুখী চাপ থাকে না। তাই নক্ষত্রটি সংকুচিত হতে থাকে। সংকুচিত হলেই তার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আগে তাপমাত্রা বেড়েছিল পারমাণবিক কেন্দ্রীণ জ্বলুনির ফলে। কিন্তু এখন সংকুচিত হওয়ার জন্যই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাপশক্তিতে পরিবর্তিত হয়- নক্ষত্র সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তটির মতো। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এমন পরিমাণে পৌছায় যাতে পরবর্তী পারমাণবিক কেন্দ্রীণ বিক্রিয়া শুরু হয়। এই বিক্রিয়ার ফলেই হিলিয়াম কেন্দ্রীণ আরো ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণে পরিবর্তিত হয়। এইভাবে হিলিয়াম কার্বন কেন্দ্রীণে এবং কার্বন অক্সিজেন কেন্দ্রীণে রূপান্তরিত হয়। এমনকি অক্সিজেন নিয়ন বা আরো ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণে পরিণত হয়।

প্রত্যেক পর্যায়ে এইসব বিক্রিয়া ঘটে পারমাণবিক কেন্দ্রীণে একটি হিলিয়াম বা আলফা কণার সংযোজনের ফলে। প্রত্যেক পর্যায়ে পারমাণবিক কেন্দ্রীণ বিক্রিয়া মাধ্যাকর্ষণ সঙ্কোচনকে কিছুকালের জন্য বন্ধ রাখে। আরো বেশি তাপমাত্রায় অপেক্ষাকৃত ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণের সৃষ্টি হয়। যেমন দুটি কার্বন কেন্দ্রীণ একত্রিত হয়ে একটি ম্যাগনেশিয়াম কেন্দ্রীণের সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে অনেকটা শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু এই ধারাবাহিক বিক্রিয়াগুলো একসময় শেষ হয়ে যায় যখন পারমাণবিক কেন্দ্রীণ অন্যন্ত ভারী বলে আর স্থায়ী অবস্থায় থাকতে পারে না। এজন্যই আরো বেশি তাপমাত্রায় আরো ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণের সৃষ্টি হয় না এবং নতুন শক্তির উৎপাদন হয় না। এই সীমায় নক্ষত্র পৌঁছায় যখন লোহা, কোবাল্ট এবং নিকেল কেন্দ্রীণের সৃষ্টি হয়। লোহার কেন্দ্রীণে মোট ৫৬টি প্রোটন এবং নিউট্রন থাকে।

 

নক্ষত্রের কেন্দ্রে এইসব বিক্রিয়া ঘটার ফলে কেন্দ্রস্থলটি ক্রমেই সংকুচিত এবং উত্তপ্ত হয় আর বাইরের মোড়কটা সম্প্রসারিত এবং কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। বাইরের অংশের সম্প্রসারণের সঠিক কারণ সহজভাবে বলা শক্ত। কিন্তু এই পরিমাণটা পাওয়া যায় যখন নক্ষত্রের অবস্থা বর্ণনার জন্য প্রয়োজনীয় সমীকরণ সমাধান করা হয়। বাইরের দর্শকের কাছে মনে হয় যে নক্ষত্রটি আয়তনে বড় এবং লাল রংয়ের হয়ে গেছে। লাল হওয়ার কারণ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। এই অবস্থায় নক্ষত্রকে বলা হয় লাল দানব। এই বিক্রিয়াগুলো ঘটে সাধারণত ছোট নক্ষত্রের বেলায়। আমাদের সূর্য সম্ভবত লাল দানব হয়ে এখনকার তুলনায় অনেক বড় আয়তন বিশিষ্ট হবে যার ফলে পৃথিবীতে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

প্রত্যেক ধরনের নক্ষত্রের ক্রমবিবর্তন কীভাবে হয় তা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। আমাদের আলোচনার বিষয় হলো নক্ষত্রের জীবনের অন্তিম অবস্থা। এ সম্বন্ধে বেশ কিছু বলা যায়। কেননা পারমাণবিক কেন্দ্রীণের জ্বলুনী শেষ হয়ে গেলে সমস্ত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে এবং হিলিয়াম আরো ভারী মৌলিক পদার্থে পরিণত হয়। তখন নক্ষত্রের এমন শক্তি থাকে না যা মাধ্যাকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে কাজ করে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। তাই মাধ্যাকর্ষণের জন্য নক্ষত্রের কেন্দ্র আবার সংকুচিত হয়। ফলে নক্ষত্রের ঘনত্বও বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় পৌঁছায় যখন চাপের ফলে নক্ষত্রের পদার্থ যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত তা থেকে ইলেকট্রনসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় নক্ষত্রটি হিলিয়াম এবং আরো ভারী পারমাণবিক কেন্দ্রীণ দিয়ে গঠিত বলে মনে করা যায়। কারণ সমস্ত ইলেকট্রন বাইরে নক্ষটির সারাদেহে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। এই অবস্থা ইলেকট্রনগুলো মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীত দিকে একটি চাপের সৃষ্টি করে যাকে অধঃপতিত ইলেকট্রন চাপ বলে।

 

মৌলিক কণাসমূহকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। এক দলকে ফার্মিয়ন এবং অন্য দলকে বোসন বলা হয়। প্রথম নামটি ইতালীর পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং দ্বিতীয়টি বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম অনুসারে। এই দুই ধরনের বস্তুকণার আচরণ অত্যন্ত ঘনত্বের অবস্থায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার খুব নিচু তাপমাত্রায়ও তাদের আচরণ ভিন্ন।

ফার্মিয়নের উদাহরণ হলো ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন আর বোসনের উদাহরণ হলো ফোটন বা আলোক কণা। ফার্মিয়নের বস্তুকণা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। বোসনগুলো বসু-আইন্সটাইন পরিসংখ্যান অনুসরণ করে। এই দুই ধরনের কণার পার্থক্য আসে তাদের নিজস্ব ঘূর্ণনের জন্য। সাধারণভাবে বলা যায় যে, মৌলিক কণাগুলো অনেকটা লাটিমের মতো তাদের নিজস্ব অক্ষের উপরে ঘোরে। অবশ্য এই ছবি আক্ষরিক অর্থে নেয়া ঠিক নয়। বস্তুকণার ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং আপেক্ষিক তত্ত্ব জানতে হবে।

 

এই তত্ত্ব থেকে থেকে আমরা জানি যে, মৌলিক কণার নিজস্ব ঘূর্ণন পরিমাণ নির্দিষ্ট সংখ্যার হয়। এই নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলো হলো ৩, ১/২, ১, ৩/২, ২, ৫/২ ইত্যাদি। এখানে ঘূর্ণনের একক হলো  যেখানে  হলো প্ল্যাংকের ধ্রুবক এবং  হলো ২২/৭। যেহেতু প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান খুবই কম তাই মৌলিক কণাসমূহের ঘূর্ণনের পরিমাণ অতি সামান্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি লাটিমের ঘূর্ণনের পরিমাণ ১০^৩০ (ঐ একই এককে)।

ফার্মিয়নগুলোর ঘূর্ণন অর্ধেক সংখ্যক অর্থাৎ ১/২, ৩/২, ৫/২ ইত্যাদি এবং বোসন কণাগুলোর ঘূর্ণন পূর্ণসংখ্যক অর্থাৎ ০, ১, ২ ইত্যাদি। ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের ঘূর্ণন ১/২, তাই এগুলো ফার্মিয়ন। ফোটনের ঘূর্ণন ১, তাই এরা বোসন। ফার্মিয়নের একটি বৈশিষ্ট্য হলো দুটি বা তার বেশি ফার্মিয়ন একই ‘অবস্থায়’ থাকতে পারে না। এই তত্ত্বকে বলে পাউলীর বর্জন নীতি।

 

‘অবস্থা’ বলতে আমরা কী বুঝি তা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো কয়েকটি নির্দিষ্ট পৃথক কক্ষপথে ভ্রমণ করতে পারে। একটি ইলেকট্রনের যে নিজস্ব ঘূর্ণন আছে তার শুধু দুটি দিক বা দুটি অবস্থা থাকতে পারে। তাই পরমাণুর ইলেকট্রন অবস্থা বলতে বোঝা যায় যে, ইলেকট্রনের একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে আছে এবং তার ঘূর্ণনের অবস্থা দুটি সম্ভাব্য দিকের একটি। সুতরাং পাউলীর বর্জন নীতি অনুসারে একটি কক্ষপথে শুধুমাত্র দুটি ইলেকট্রন থাকতে পারে যাদের ঘূর্ণন পরস্পরের বিপরীত।

আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায় যদি আমরা ইলেকট্রন গ্যাসের কথা চিন্তা করি। একটি বদ্ধ বাক্সে কতগুলো ইলেকট্রন নিলে সেই ইলেকট্রনগুলো দিয়ে একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যা ব্যাখ্যা করার জন্য ইলেকট্রনগুলোর সামগ্রিক শক্তি, ভরবেগ এবং ঘূর্ণনের মান প্রয়োজন। অবশ্য ইলেকট্রনের শক্তির মান তার ভরবেগের উপর নির্ভর করে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে কতগুলো বস্তুকণা একটি বাক্সে আবদ্ধ করে রাখলে তাদের শক্তি ও ভরবেগের পরিমাণ কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট পৃথক পৃথক মানের হতে পারে। পাউলীর নীতি অনুসারে একটি অবস্থায় শুধুমাত্র একটি ইলেকট্রন থাকতে পারে বলে যখন অনেকগুলো ইলেকট্রনকে ছোট আয়তনে আবদ্ধ করা হয় তখন সংকোচনের বিরুদ্ধে একধরনের চাপের সৃষ্টি হয়। কারণ দুটি ইলেকট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকতে পারে না। এজন্যই ইলেকট্রনগুলো একটি বহির্মুখী চাপের সৃষ্টি করে। এই চাপকে ফার্মি চাপ বা অধঃপতিত ইলেকট্রনের চাপ বলে।

 

নক্ষত্রের কোনো অংশে যে কেন্দ্রাভিমুখী মাধ্যাকর্ষণ বল সক্রিয় তার পরিমাণ নক্ষত্রের সম্পূর্ণ ভরের উপর নির্ভর করে। সাধারণত নক্ষত্রটি যত বড়, মাধ্যাকর্ষণ বলও তত বেশি। অধঃপতিত ইলেকট্রনের বহির্মুখী চাপ মাধ্যাকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রাখতে পারে শুধুমাত্র সেসব নক্ষত্রের বেলায় যাদের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে ১.৪ গুণ বা তার কম। নক্ষত্র-ভরের এই সীমাকে চন্দ্রশেখর সীমা বলে। কারণ এটি ভারতীয় জোতির্বিজ্ঞানী সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর ১৯৩৫ সালে আবিষ্কার করেছিলেন।

যদি নক্ষত্রের ভর ১.৪ সূর্য ভরের কম হয় তাহলে ইলেকট্রনের ফার্মি চাপ মাধ্যাকর্ষণ বলকে সামলাতে পারে। এই অবস্থায় নক্ষত্রকে শ্বেত বামন নক্ষত্র বলে। এই ধরনের নক্ষত্র প্রায় সূর্যের মতোই ভারী কিন্তু তার আয়তন প্রায় পৃথিবীর আয়তনের সমান। উদাহরণস্বরুপ, ৪০-এরিডামি-বি একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র যার ভর হলো ০.৪৪ সূর্য ভর, কিন্তু তার ব্যাস সূর্যের ব্যাসের শতকরা ১.৫ মাত্র। এই নক্ষত্রগুলোর ঘনত্ব খুব বেশি, পানির ঘনত্বের তুলনায় দশ হাজার থেকে দশ লক্ষ গুণ বেশি। এই ধরনের নক্ষত্র ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়, উজ্জ্বলতা কমতে কমতে অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং সেই অবস্থায় তাদের কখনো কখনো তাদের ‘কৃষ্ণ বামন’ বলে।

 

যদিও শ্বেত বামন নক্ষত্রগুলো বেশি উজ্জ্বল নয় তবুও অনেকগুলো শ্বেত বামন আবিষ্কৃত হয়েছে। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত শ্বেত বামনগুলোর মধ্যে লুব্ধকের সঙ্গী অতি পরিচিত। এই নক্ষত্রটি লুব্ধক তারার সহচর যুগ্ম তারা। লুব্ধক তারা এবং তার সঙ্গীকে সিরিয়াস-‘এ’ এবং সিরিয়াস-‘বি’ বলা হয়। নক্ষত্রের ভর ১.৪ সূর্য ভরের বেশি হলে কেন্দ্রাভিমুখী মাধ্যাকর্ষণ ইলেকট্রনের বহির্মুখী ফার্মি চাপের চেয়ে বেশি হয় এবং ফলে নক্ষত্রটি আরো সংকুচিত হতে থাকে। নক্ষত্রের পর্দাথ শেষে এতো ঘন হয়- বিশেষ করে কেন্দ্রে যে ইলেকট্রন প্রোটনের উপর আপতিত হয়ে তাকে নিউট্রনে পরিবর্তিত করে দেয়।

একই সঙ্গে যে নিউট্রিনোর সৃষ্টি হয় তা অবশ্য নক্ষত্রের বাইরে চলে যায়। এইভাবে পারমাণবিক কেন্দ্রীণগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে নক্ষত্রের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে একটি বিরাট কেন্দ্রীণের সৃষ্টি করে। এই বিরাট কেন্দ্রীণের নিউট্রনগুলো স্থায়ী অবস্থায় থাকে অথাৎ সেগুলো ভাঙ্গে না। যেহেতু নিউট্রন ফার্মিয়ান বস্তুকণা তাই এখন নিউট্রন-ফার্মি-চাপের সৃষ্টি হয়, যেমন পূর্বে ইলেকট্রনগুলো ইলেকট্রন-ফার্মি চাপ সৃষ্টি করেছিল। নিউট্রনগুলো শুধুমাত্র ফার্মি চাপই সৃষ্টি করে না বরং তাদের মধ্যে কেন্দ্রীণ বল থাকার জন্য আরো একটি চাপ প্রয়োগ করে। এ দ্বিতীয় চাপ সন্বন্ধে সঠিকভাবে এখনো কিছু বলা যায় না। কারণ ১০^-১৩ সেন্টিমিটারের কম দূরত্বে কেন্দ্রীণ বল কী ধরনের তা ভালো করে জানা নেই।

 

নিউট্রন ফার্মি চাপ অন্তর্মুখী মাধ্যাকর্ষণ বল সামলাতে পারে শুধুমাত্র সেইসব নক্ষত্রের বেলায় যাদের ভর সূর্যের ভরের তিন গুণের মতো। যখন নক্ষত্রের ভর তিন সূর্য ভরের কম হয় তখন আমরা পাই নিউট্রন নক্ষত্র যার কেন্দ্রস্থলে অধিকাংশ জায়গা জুড়ে একটি বিরাট জমাট নিউট্রন গঠিত কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। মহাশূন্যে এক ধরনের বস্তুর সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে যাদের পালসার বলা হয়। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ. হিউয়িস এবং তাঁর সহকর্মীরা এই পালসার আবিষ্কার করেছেন। এই পালসারগুলো দ্রুত এবং নিয়মিতভাবে (প্রায় প্রতি সেকেন্ডে একবার) বিকিরণ স্পন্দন ছড়িয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, পালসারগুলো দ্রুত চক্রাকারে ঘূর্ণনশীল নিউট্রন নক্ষত্র। কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টি. গোল্ড প্রথমে এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

এ যাবৎ তিনশ’রও বেশি পালসারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই পালসারগুলোর স্পন্দনের ব্যাপ্তিকাল কয়েক মিলি-সেকেন্ড থেকে চার সেকেন্ড পর্যন্ত হতে পারে। এ ব্যাপ্তিকাল অতি ধীরে ধীরে বাড়ে। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঘূণর্নশীল নিউট্রন নক্ষত্রগুলো শক্তি ক্ষয় করে ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। নিউট্রন নক্ষত্রের পর্দাথ অত্যন্ত ঘন, প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০^-১৩ থেকে ১০^-১৫ গ্রাম। পরমাণুর কেন্দ্রের ঘনত্ব এই ধরনের। নিউট্রন নক্ষত্রের এক চামচ পদার্থের ওজন পৃথিবীর হিসেবে প্রায় এক কোটি টন। নিউট্রন নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের সাথে তুলনীয় কিন্তু তার ব্যাস মাত্র ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার। পালসার আবিষ্কার আধুনিক বিজ্ঞানকে একটি উৎকৃষ্ট গবেষণাগার উপহার দিয়েছে যেখানে এমন সব ঘটনা পরীক্ষা করা যায় যা পৃথিবীতে সম্ভব নয়।

চিত্রঃ এক মাইল দূরবীণের (one mile telescope) দুটি অ্যান্টেনা (antennae), যেগুলো ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরে মালার্ড রেডিও এস্ট্রনমি অবজারভেটরিতে (Mullard Radio Astronomy Observetory) অবস্থিত। এই রেডিও দূরবীণ দিয়ে পালসারগুলোর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছিল। পালসারগুলো আবিষ্কৃত হয়েছিল কেমব্রিজের অন্য একটি রেডিও দূরবীণ দ্বারা।

নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৩২ সালে। চ্যাডউইকের এ আবিষ্কারের খবর যেদিন কোপেনহেগেনে পোঁছায় সেদিন সোভিয়েত পর্দাথ বিজ্ঞানী লেভ ডেভিডোডিচ ল্যান্ডাও এই আবিষ্কারের তাত্ত্বিক নানা সম্ভাবনার কথা সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম নিউট্রন দিয়ে তৈরি ঠাণ্ডা এবং ঘন নক্ষত্রের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করেন। স্বতন্ত্রভাবে ১৯৩৪ সালে ডব্লিউ বা’ডে এবং এফ. জুইকি নিউট্রন নক্ষত্রের ধারণাটি উপস্থাপন করেন। তাঁরা আরো বলেন যে, সুপারনোভা বিস্ফোরণে নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে পারে। কর্কট রাশির মেঘ একটা নিউট্রন নক্ষত্র হতে পারে এটাও জুইকির প্রস্তাব। এইসব প্রস্তাব সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

 

একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর ১.৪ সূর্য ভরের কমও হতে পারে, যদিও এই ভরের নক্ষত্র শ্বেত বামন। মাঝে মাঝে নক্ষত্রের কেন্দ্র আকস্মিক অন্তর্মুখী চাপ উপলব্ধি করে। এই চাপের সৃষ্টি হয় নক্ষত্রের বাইরের অংশে কোনো বিস্ফোরণের ফলে। এই আকস্মিক অন্তর্মুখী চাপের ফলে ইলেকট্রনের ফার্মি চাপ মাধ্যাকর্ষণ এবং বিস্ফোরণজনিত অন্তর্মুখী চাপ সামলাতে পারে না। তাই ইলেকট্রনগুলো প্রোটনের সঙ্গে মিলে নিউট্রনের সৃষ্টি করে এবং এইভাবে নক্ষত্রটির কেন্দ্র একটি নিউট্রন নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়। বাইরের অংশ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরের অংশের ভর ১.৪ সূর্য ভরের কম হলে আমরা একটি নিউট্রন নক্ষত্র পাই। এমনকি নিউট্রন নক্ষত্রের ভর ০.২ সূর্য ভর পর্যন্ত হতে পারে। যদি নক্ষত্রটির ভর ৩ সূর্য ভরের বেশি হয় তবে একটি কৃষ্ণবিবরের সৃষ্টি হয়।

উপরে যে বিস্ফোরণের কথা বলা হলো, তা সুপারনোভাতে দেখা যায়। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণে একটি নক্ষত্র হঠাৎ আগের চেয়ে হাজার কোটি গুণ উজ্জ্বল হয়ে যায়। চীনদেশের জ্যোতির্বিদরা ১০৫২ সালে এই ধরনের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখেছিলেন। তার অবিশিষ্টাংশই দেখা যায় কর্কট রাশির মেঘে যার মধ্যে একটি পালসার পাওয়া গেছে। এ আবিষ্কার থেকে এটাই মনে হয় যে, সুপারনোভার বিস্ফোরণে নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রত্যেক নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টি সুপারনোভায় নাও হতে পারে। আমাদের ছায়াপথ অথবা নীহারিকায় সুপারনোভার অন্য উদাহরণ হলো টাইকোর নোভা, কেপলারের নক্ষত্র এবং ইটাকারিণী। এগুলো যথাক্রমে ১৫৭২, ১৬০২ এবং ১৮৪৩ সালে দেখা গিয়েছে। বর্তমান শতাব্দীতে উজ্জ্বলতম সুপারনোভার উদ্ভব আই. সি. ৪১৮২ নীহারিকায়। যদিও এই নীহারিকাটি কোটি কোটি নক্ষত্র দিয়ে গঠিত, তবুও একটি সুপারনোভা নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা সমস্ত নীহারিকার শতগুণ বেশি হয়েছিল।

চিত্রঃ কর্কটরাশির (Crab Nebula) এই মেঘটা হলো ১০৫২ সনের সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ। এই সুপারনোভাটি চীনদেশের জ্যোতির্বিদরা দেখেছিলেন এবং লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই মেঘটার মধ্যে একটি পালসারের সন্ধান পাওয়া গেছে।

 

সুপারনোভা কয়েক ধরনের হয়। এখানে শুধু এক ধরনের সুপারনোভার কথা আলোচনা করা হলো। সুপারনোভার সঠিক উদ্ভবের কারণ এখনো জানা যায়নি। নক্ষত্রে কোনো গতিশীল তাপ এবং পারমাণবিক কেন্দ্রীণ বিক্রিয়ার ফলে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টির সময় যে অভিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তা থেকেও এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। যে তরঙ্গে মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যের আকস্মিক পরিবর্তন হয় তাকেই অভিঘাত তরঙ্গ [শক ওয়েভ] বলে। মাধ্যমের পদার্থের গতি শব্দের গতির বেশি হলে অভিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। নিউট্রন নক্ষত্রের সৃষ্টির সময় অসংখ্য নিউট্রিনো নক্ষত্রের বাইরে ছুটে আসার কারণেও সুপারনোভাতে বিস্ফোরণ হতে পারে। অভিঘাত তরঙ্গ অথবা নিউট্রিনোসমূহের গতি নক্ষত্রের মোড়কে অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রার সৃষ্টি করে। বাইরের মোড়কে থাকে সাধারণত হাইড্রোজেন। অভিঘাত তরঙ্গ এই হাইড্রোজেন মাধ্যমের উপর পড়লে উঁচু তাপমাত্রায় খুব দ্রুত কেন্দ্রীণ বিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই বিক্রিয়াকে বিস্ফোরিত কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণ বলে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা খুব অল্প সময়ের জন্য অত্যন্ত বেশি হয়ে যায় এবং সে জন্যই গতিশীল কেন্দ্রীণ বিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

সুপারনোভা বিস্ফোরণে যে অভিঘাত তরঙ্গ নক্ষত্রের ভেতর থেকে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে তা নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। আদি অবস্থায় নক্ষত্রের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় পদার্থের ঘনত্ব খুব কম। তাই মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে আদি নক্ষত্রের সৃষ্টি হয় না। নক্ষত্রের সৃষ্টি হয় যখন ঘনত্ব যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। অভিঘাত তরঙ্গ মহাকাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো কোনো জায়গায় বস্তুর ঘনত্ব নক্ষত্র সৃষ্টির উপযুক্ত পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়ে যায়।

 

সুপারনোভা বিস্ফোরণের জন্য নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের ৬ গুণ হওয়া দরকার। তাই আমাদের সূর্য সুপারনোভা হবে না। এটি প্রথমে লাল দানব হবে এবং পরে সম্ভবত শ্বেত বামনে পর্যবসিত হবে।

নক্ষত্রের কেন্দ্রের ভর ৩ সূর্যভরের বেশি হলে নিউট্রন ফার্মি চাপ এবং কেন্দ্রীণ বল জাতীয় চাপ মাধ্যাকর্ষণ বল সামলাতে পারে না। এভাবেই একটি কৃষ্ণ বিবরের সৃষ্টি হয়।

 

নক্ষত্র শ্বেত বামন, নিউট্রন-নক্ষত্র এবং কৃষ্ণ বিবর এ তিনটি অবস্থায় পৌঁছাতে পারে যদি তার ভর সূর্যের ভরের তুলনায় খুব কম না হয়। পদার্থের ভর খুব কম না হলে যেমন আমাদের পৃথিবী বা এক টুকরো পাথর তার মাধ্যাকর্ষণ বলকে পদার্থের সাধারণ চাপ ঠেকিয়ে রাখতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বস্তুসমূহের গঠনে মাধ্যাকর্ষণ বলের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। এই গঠন নির্ধারিত হয় মূলত পরমাণুগুলোর মধ্যে তড়িৎ-চুম্বক বলের দ্বারা। পৃথিবীর অথবা চাঁদের গঠনে মাধ্যাকর্ষণ বলের ভূমিকা আছে, যেমন এই বলের জন্যই এগুলো প্রায় গোলাকার। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অন্তর্মুখী মাধ্যাকর্ষণ বলকে পদার্থের সাধারণ বহির্মুখী চাপ সবসময় সামলিয়ে রাখতে পারে। তাই তাদের আকারে এবং আয়তনে অতি সামান্যই পরিবর্তন ঘটে- যতই না তারা ঠাণ্ডা হোক। বৃহস্পতি গ্রহের ভরের চেয়ে কোনো নক্ষত্রের ভর একটু বেশি হলে, মাধ্যাকর্ষণ বল তার গঠনে এবং তার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছাবার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


[বিঃ দ্রঃ এই লেখাটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের “কৃষ্ণবিবর” বইয়ের ২য় অধ্যায়ের টাইপকৃত রূপ। এই অধ্যায়টি টাইপ করে দিয়েছেন ‘রিপা দাস‘, ‘মোজাদ্দেদুল ইসলাম নূর‘, ‘অলোক অর্ক ‘ ও ‘নিয়াজ বিন সিরাজ‘। এই অংশটির কাগুজে রূপ দেখতে পারবেন এখান
 থেকে। টাইপকৃত বানানের সাথে মূল বানান মিলিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন ‘জিনিয়া জান্নাত জেমি’ ও ‘সিরাজাম মুনির শ্রাবণ‘। টাইপ করার জন্য স্ক্যান করে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ‘সিরাজাম মুনির শ্রাবণ’। জামাল নজরুল ইসলামের বইটি সহজলভ্য করতে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ  বই-ই পোস্ট করা হবে।]  

১ম অধ্যায় পড়ুন এখান থেকে।

লেখাটি 1,399-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Response

  1. এই বইটার খুব পুড়ানো একটা ভার্শন আমার কাছে আছে। কখনও পড়ে দেখা হয় নাই।

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 910 other subscribers