আপনি কোথায় বাস করছেন তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ভাবে আপনার বাড়িকে নিরাপদ করতে পারেন। গ্রাম গঞ্জের বাড়িগুলোর চারপাশ এখনো খোলামেলা ই থাকে, অনেকে বেড়া তুলে দেয় খুব বেশি হলে দেয়াল। শহুরে এপার্টমেন্ট গুলোতে থাকে দাড়োয়ান, সিসিটিভি ইত্যাদি। আপনার সামর্থ্য থাকলে ইলেক্ট্রনিক এলার্ম, লেজার, বায়োমেট্রিক সেন্সর এমনকি একজন এক্স-কমান্ডোকেও নিরাপত্তার জন্য ভাড়া পেতে পারেন। এসব কিছুর মূলেই রয়েছে আমাদের ঘর , ঘরের ভেতরের মূল্যবান জিনিসপত্র এবং প্রিয়জনদের অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রব থেকে দূরে রাখা।
আপনার দেহেরও এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে যা নানান বিপদ আপদ থেকে আপনাকে সুরক্ষা দেয়। আপনার হাড্ডি, চামড়া এসব দেহের ভেতরের গুরুত্বপূর্ন অংগকে পিছলে পড়ে গিয়ে পাওয়া আঘাত কিংবা আচমকা উড়ে আসা ঢিল থেকে বাঁচায় চোখের পাতা ধূলাবালি এবং দুষ্ট ছেলেদের আঙ্গুল থেকে রক্ষা করে ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে মূল্যবান নিরাপত্তার কাজটি হয়ে থাকে নিঃশব্দে, গোপনে। যা আপনি দেখেননা, অনুভব করেন না, কিন্তু যেটা আছে বলেই আপনি সুস্থ আছেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়লেও আবার সুস্থ হন। এইটাই আপনার অনাক্রম্য ব্যবস্থা(Immune System)।
শুধু এবং শুধু মাত্র একটা কারণেই আপনার দেহে অনাক্রম্য ব্যবস্থা রয়েছে। এর অনুপস্থিতি তে আপনার দেহ ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এবং বিভিন্ন পরজীবীর জন্য মনোরম জায়গায় পরিণত হত। আপনার দেহ উষ্ণ, সিক্ত, পুষ্টি উপাদানে ঠাসা এবং এদের অন্যান্য বাসস্থানের তুলনার হাজার গুন আরামদায়ক। তবে যারা আপনার দেহে আশ্রয় নিয়েছে, আপনারই খেয়ে পড়ে নিজেদের বংশ বিস্তার করে চলেছে তুমুল গতিতে তাদের থেকে কৃতজ্ঞতার আশা করাটা নিতান্তই মিছে। সত্যি বলতে এদের বেশিরভাগেরই কিছুই আসে যায়না আপনার কি হল না হল। অনেক জীবাণু আপনাকে অসুস্থ্য করে ফেলতে পারে। এমনকি আপনি মারাও যেতে পারেন যা অবশ্যই আপনাকে নিয়ে প্রকৃতির পরিকল্পনার পরিপন্থী।
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই জীবাণুরা ছিলো। সৃষ্টির শুরুর দিকে আসলে সব জীবসত্তাই ছিলো এককোষী। এখনও আপনার, আমার, তার মতো বহুকোষী প্রাণের মচ্ছবের মধ্যেও ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এরা এককোষী। অনেক অনেক আগে যখন এককোষী জীবসত্তাগুলো বহুকোষীতে বিবর্তিত হয়ে প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের অস্তিত্বের রূপ দান করলো তখন কিছু চতুর এককোষী তরুণ পৃথিবীর প্রতিকূল আবাসে কষ্ট করে থাকা বাদ দিয়ে এসব বহুকোষীর দেহে ঢুকে পড়লো। তারা হয়ে গেলো পরজীবী।
এই অবস্থায় বহুকোষীদের ভবিতব্য ক্ষুদে ঘাতকপূর্ন পরিবেশের মধ্যেই বিবর্তিত হতে হয়েছে। সফল ভাবে বেঁচে থাকা এবং বংশবিস্তারের লক্ষ্যে তাদের তৈরি করতে হয়েছে এমন ব্যবস্থা যা তাদের সুরক্ষা দেবে। মানুষ, গরু, ছাগল, গাছপালা সহ এই পৃথিবীর সব বহুকোষীকেই এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং এদের সকলেরই অনাক্রম্য ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। বহুকোষীরা যখন জীবাণুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কৌশল বের করছিলো, জীবাণুরাও তো চুপচাপ বসে ছিলোনা। তারাও প্রত্যেকটা কৌশলকে ফাঁকি দেয়ার প্রতিকৌশল বের করেছে। এই মহাযুদ্ধ চলছে, চলবে…
জীবাণুদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এই মহাযুদ্ধে টিকে থাকতে তারা কিছু অসম সুবিধা ভোগ করে। একটি হচ্ছে বংশবৃদ্ধির গতি। বিবর্তনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় হল আকার। বিবর্তনীয় সময়ে প্রানীদের আকার সাধারণত বৃদ্ধি পায়। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, আপনি যত বড় হবেন অন্যের শিকার থেকে শিকারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। তবে এটাও সত্য, আপনি যত বড় আপনাকে বানাতে তত বেশি সময় লাগবে। একটা ব্যাক্টেরিয়া যদি উষ্ণ পরিবেশ এবং পানি-পুষ্টি পায় তবে এক ঘন্টার মধ্যে সে প্রজননক্ষম হয়ে যাবে, কিন্তু আপনার জন্য সেটা কয়েক বছর!
টিকে থাকার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা গুরুত্বপুর্ন কারণ, পরিবেশের প্রভাবে যে বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলো ঘটে সেগুলোর উৎপত্তি জীবের ডিএনএ তে পরিব্যক্তির(Mutation) ফলে। আর পরিব্যক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হলো প্রজনন। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ অনুলিপি তৈরি হয়। এই অনুলিপির প্রকৃয়াটা বেশ দক্ষ, কিন্তু ততটা নয় যে একেবারেই নির্ভুল অনুলিপি তৈরি হবে। যদিও বেশির ভাগ ভুলই ঠিক করে ফেলা হয়, কিন্তু এই ভুল ঠিক করে ফেলার কার্যকৌশলটাও কখনো কখন ভুল করে। তাই প্রতি প্রজন্মেই কিছু ভিন্নতা ডিএনএ তে ঢুকে পড়ে, এরাই বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাঁচামাল।
কিন্তু, এসবের সাথে এককোষী এবং বহুকোষীর টিকে থাকার যুদ্ধের সম্পর্ক কি? জীবাণুর ডিএনএ তে কি প্রজন্মান্তরে ভুল হয় না? তা হয়, কিন্তু জীবাণুরা তাদের বিবর্তনের জন্য দরকারী জিনগত পরিবর্তন আমাদের তুলনার ট্রিলিয়ন ভাগ দ্রুত তৈরি করতে পারে। মানুষের একটা নিষিক্ত ডিম্বানু আর একটা ব্যাক্টেরিয়াকে যদি উপযুক্ত পরিবেশে সংখ্যাবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নামতে দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে ২ দিন পরও ডিম্বানুর কোন খোজ নেই কিন্তু ব্যাক্টেরিয়াটি এতই সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে যে তার অস্তিত্ব বুঝতে আর মাইক্রোস্কোপ লাগছেনা, ঠিকই চারপাশ ভরিয়ে ফেলেছে।
জীবাণুদের এই বেসম্ভব রকমের বংশবৃদ্ধি এবং পরিব্যক্তির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বহুকোষীদের নিরাপত্তার জন্যই অনাক্রম্য ব্যবস্থার মত চমৎকার জিনিসটির তৈরি হয়েছে। এটা শুধু বর্তমানে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানো জীবাণুদেরই চিনে ধ্বংস করতে পারে তা নয়, বরং অদূর ভবিষ্যতে যেসবের উদ্ভব হতে পারে তাদের বিরুদ্ধেও কাজ করতে সদা প্রস্তুত।
আপনার দেহে জীবাণুরা প্রবেশ করলে একে বলি সংক্রমন(Infection)। সাধারনত সংক্রমনের ফলে আপনার একটু জ্বর আসে, পেটে ঝামেলা করে। কিন্তু বিশ্রাম নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা সেরে যায়। এটার জন্য আপনার অনাক্রম্য ব্যবস্থাকে কে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারেন। কিন্তু, এতেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়না।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে সবারই একবার করে বসন্ত হয়, কিংবা প্রতি বছর এক-দুই বার করে স্বর্দি লাগে। কেন এসব বারবার হয়না? এই ব্যাপারটাই অনাক্রম্য ব্যবস্থার আরেকটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য। আপনি কোন জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার পরও অনাক্রম্য ব্যবস্থা তাকে মনে রাখতে পারে। যার ফলে পরে আবার ওই জীবাণুর দেখা পেলেই কট! সে আর রোগ সৃষ্টি করতে পারেনা।
বিজ্ঞানীরা একে বলেন অনাক্রম্যতা সংক্রান্ত স্মৃতি(Immunological memory)। যদিও এই স্মৃতি আপনাকে একই জীবাণুর বার বার আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে, কিন্তু নতুন জীবাণুর সময় সে আর সাহায্য করতে পারবেনা। প্রতিটা নতুন জীবাণুর আক্রমণে অনাক্রম্য ব্যবস্থা যেন একে মনে রাখতে পারে সেই প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিনই আমাদের শরীরে হাজার হাজার জীবাণু প্রবেশ করে। এভাবে আমরা বড় হয়ে গেলে আমাদের অনাক্রম্য ব্যবস্থা কোটি কোটি জীবাণুকে মুখস্থ করে ফেলে। আপনি নিশ্চয়ই ছোটবেলায় টীকা(Vaccine) নিয়েছেন? টীকা আসলে কিছুই না, যে রোগের টীকা সেই রোগেরই জীবাণু! কিন্তু সে দুর্বল। যেন আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একে চিনে নেবার সুযোগও পায় এবং এর ফলে কোন রোগও সৃষ্টি হয়না।
একটা বিল্ডিং এর সবচেয়ে ছোট একক হচ্ছে একটা ইট। তেমনি আমাদের দেহের সবচেয়ে ছোট একক হচ্ছে কোষ(Cell )। একটা কোষ এতই ছোট যে একে খালি চোখে দেখাই যায়না। সারা শরীরে রয়েছে নানান রকম কোষ করছে নানান রকম কাজ। আমাদের অনাক্রম্য ব্যবস্থাও আসলে বিশেষ বিশেষ ধরনের কিছু কোষ রয়েছে, যাকে বলা হয় অনাক্রম্য কোষ।
আপনার রক্তের রং লাল, কারণ এতে থাকে প্রচুর লোহিত কণিকা(Erythrocytes)। লোহিত কণিকা ছাড়াও রক্তে থাকে শ্বেতকণিকা(Leucocytes)। এই শ্বেতকণিকা গুলো হচ্ছে অনাক্রম্য ব্যবস্থার অংশ। যেহেতু রক্ত সারা শরীরেই সঞ্চালিত করে, সেহেতু সারা শরীরেই শ্বেতকণিকা আছে, তেহেতু সারা শরীরেই অনাক্রম্য ব্যবস্থা ছড়ানো। তবে শরীরের কিছু কিছু অংশে অনাক্রম্য কোষের সংখ্যা একটু বেশিই থাকে। তা হচ্ছে লসিকা গ্রন্থি(Lymph node) , এবং প্লীহা(spleen) এরা খুবই গুরুত্বপুর্ন কারণ এখান থেকেই অনাক্রম্য ব্যবস্থার কর্মযজ্ঞ শুরু হয় যখন আপনি আক্রান্ত হন।
এবার অনাক্রম্য ব্যবস্থার বিভিন্ন কোষের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
নিউট্রোফিলঃ যদি আপনি চলার পথে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পান এবং কোথাও কেটে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তখন সেই জায়গা দিয়ে বিভিন্ন জীবাণু আপনার দেহে প্রবেশ করতে পারে। এই অবস্থায় রক্তের নিউট্রোফিল সেই ক্ষত স্থানে ছুটে গিয়ে জীবাণুদের ঠেকায়। এরা শ্বেতকণিকার অংশ।
ম্যাক্রোফাজঃ এরা আরেক ধরনে শ্বেত কণিকা। গ্রীক ভাষায় ম্যাক্রোফাজ অর্থ বড় খাদক। এর কাজও সেরকম, সরাসরি জীবাণুদের খেয়ে ফেলে তাদের ধংস করে। ফুসফুস, যকৃত, পেটের নাড়িভুড়ি এমনকি আপনার চামড়াতেও এদের খুঁজে পেতে পারেন।
ডেন্ড্রাইটিক কোষঃ গ্রীক ভাষায় ডেনড্রন শব্দের অর্থ হলো গাছ। এই কোষের গাছের মত ছড়ানো শাখা প্রশাখা থাকে বলেই এর এরকম নাম। এরাও অনাক্রম্য ব্যবস্থার খুব গুরুত্বপুর্ন একটি কোষ। এর কাজ হচ্ছে সারাদেহ থেকে সন্দেহজনক কোষগুলোকে ধরে লসিকা গ্রন্থিতে নিয়ে আসে এবং সেখানে অবস্থানরত অনাক্রম্য কোষগুলোকে বুঝতে সাহায্য করা অনুপ্রবেশকারী জীবাণুটা কি ধরনের, এবং কোন উপায়ে একে সহজে ধ্বংস করা যায়।
লিম্ফোসাইটঃ যত রকম শ্বেত কণিকা আছে লিম্ফোসাইট তাদের মধ্য সবচেয়ে ছোট। আপনি যদি মাইক্রোস্কোপে এদের দেখার চেষ্টা করেন, তাহলে সব লিম্ফোসাইটকে একই রকম মনে হতে পারে। কিন্তু যদি গভীরভাবে খেয়াল করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, এরা আসলে আলাদা। এদের একটি হচ্ছে বি লিম্ফোসাইট। এদের কাজ হচ্ছে বিশেষ একটি অস্ত্র এন্টিবডি তৈরি করা। আরেকটি লিম্ফোসাইট হলো টি লিম্ফোসাইট। টি লিম্ফোসাইট আবার দুই প্রকার, সাহায্যকারী টি লিম্ফোসাইট এবং হত্যাকারী টি লিম্ফোসাইট। সাহায্যকারী টি লিম্ফোসাইট- বি লিম্ফোসাইটকে এন্টি বডি তৈরির কাজে সাহায্য করে। অন্যদিকে হত্যাকারী টি লিম্ফোসাইট… নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে এর কাজ। আপনার দেহের আক্রান্ত কোষগুলোকে এরা মেরে ফেলে। টি লিম্ফোসাইট এবং বি লিম্ফোসাইট মিলে আপনার আমার মতো আধুনিক মেরুদন্ডী এবং প্রাচীন প্রাণিদের অনাক্রম্য ব্যাবস্থার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এদের কারণে আমাদের অনাক্রম্য ব্যাবস্থা এতটাই যথাযথ এবং সূক্ষ যে একটা কেঁচো তা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেনা।
চিত্রঃ বি লিম্ফোসাইট এবং টি লিম্ফোসাইট
এখন পর্যন্ত আমরা অনাক্রম্য সিস্টেমের বিভিন্ন কোষ সম্পর্কে জানলাম। এরা সারা দেহে ছড়ানো থাকলেও কিছু কিছু অংগে এদের ঘনত্ব বেশি থাকে। এদের প্রত্যেকের কাজ আলাদা হলেও সকলে একসাথে আপনার দেহকে বিভিন্ন রোগ জীবাণু থেকে সুরক্ষা দিতে সবসময় সচেষ্ট।
যদিও অনাক্রম্যতা সংক্রান্ত বেশিরভাগ ঘটনাই আণুবীক্ষনিক দুনিয়ায় ঘটে তবে দেহের কিছু কিছু বড়সড় অংগের অবদান অস্বীকার করলে এই লেখাটি অপূর্নই রয়ে যাবে। এর মাঝে প্রথমেই আসে অস্থিমজ্জা। ফ্যাকাসে হলুদ সাদাটে এই বস্তুটি দেহের বেশিরভাগ হাড়ের ভেতরে পাওয়া যায়। অস্থিমজ্জা মূলত সব রকম রক্তকণিকার আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করে। এখানেই তৈরি হয় লোহিত কণিকা ও শ্বেতকণিকা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ন অংগ হচ্ছে থাইমাস। এই অবস্থান হৃদপিন্ডের ঠিক উপরের দিকে। আপনার দেহের টি লিম্ফোসাইটগুলো এখানেই বড় হয়। অস্থিমজ্জায় তরুণ টি লিম্ফোসাইট তৈরি হবার পর তারা চলে আসে থাইমাসে। এখানেই এদের যোগ্য করে তোলা হয় দেহের নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ন দ্বায়িত্ব পালনের জন্য এবং এই প্রক্রিয়ার প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ টি লিম্ফোসাইটকে ছাটাই হতে হয়। থাইমাসে টি লিম্ফোসাইট এবং অস্থিমজ্জায় বি লিম্ফোসাইট যখন পরিপক্ক হয়, তখন তারা চলে আসে লসিকা গ্রন্থি এবং প্লীহায়। আপনার দেহে শুধুমাত্র একটি প্লীহা রয়েছে, যার অবস্থান পাকস্থলির পাশে। তবে লসিকাগ্রন্থি আছে হাজার হাজার যা ছড়িয়ে আছে সারা শরীরে। লসিকাগ্রন্থির বাহিরের দিকে থাকে বি লিম্ফোসাইট আর ভেতরের দিকে টি লিম্ফোসাইট। এর ভেতর দিয়ে যখন রক্ত এবং লসিকা চলাচল করে তখন তারা কি বহন করছে তা বি লিম্ফোসাইট এবং টি লিম্ফোসাইট ভালোভাবে পরীক্ষা করে। ঠিক চেকপোস্টের মতো। আর ডেনড্রাইটিক কোষগুলো সন্দেহজনক জিনিসপত্র পরীক্ষার জন্যও এখানেই ধরে আনে। কোন বহিরাগত শনাক্ত হলেই এলার্ম বাজতে থাকে এবং শুরু হয়ে যায় অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া(Immune response)। বি লিম্ফোসাইটগুলো এন্টিবডি তৈরি শুরু করে, টি লিম্ফোসাইটগুলো খুঁজতে বের হয়ে যায় সমস্যার উৎস কি। প্লীহার মূল কাজ আসলে মৃত এবং মৃতপ্রায় লোহিতকণিকাগুলো থেকে আয়রন সংগ্রহ করে এদের রক্ত থেকে সরিয়ে ফেলা। তবে এরা বিশালাকার লসিকাগ্রন্থির মতও কাজ করে। এর মধ্যেও রক্ত ও লসিকার বহনকারী জিনিসগুলো টি এবং বি লিম্ফোসাইটের পর্যবেক্ষনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
অনাক্রম্য ব্যাবস্থা যে কতটা দরকারী এবং একটি কার্যকর অনাক্রম্য ব্যবস্থা থাকার জন্য আপনার নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান অনুভব করা উচিত সেটা বুঝতে পারা কঠিন কর্ম নয়। শেষ করছি ডেভিড ফিলিপ ভেটার নামক এক দূর্ভাগার গল্প বলে। সে জন্মেছিল SCID(severe combined immunodeficiency) নিয়ে যেটা এখন Bubble Boy Disease হিসেবে পরিচিত। এটা এমনই এক জিনগত রোগ যেটার কারনে দেহে কোন কার্যকর বি এবং টি লিম্ফোসাইট তৈরি হয়না। ফলে অনাক্রম্য ব্যবস্থা একরকম নাই বললেই চলে। আক্রান্ত ব্যাক্তি অস্বাভাবিক রকমের নাজুক হয়ে পড়েন সংক্রমনের ব্যপারে। ডেভিড ভেটারকে জন্মের পরপরই জীবাণুমুক্ত প্লাস্টিক বেলুনের মতো চেম্বারের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছিলো। এর ভেতরেই তাকে খাবার দেয়া হত, ডায়পার বদলানো হতো, ওষুধ দেয়া হতো সবই বিশেষভাবে জীবাণুমুক্ত করে। ভেটারকে শুধুমাত্র স্পর্শ করা যেত চেম্বারের দেয়ালে স্থাপিত বিশেষ গ্লাভসের মাধ্যমে। চেম্বারটি কম্প্রেসার দিয়ে ফুলিয়ে রাখা হত যেটা প্রচুর শব্দ করত যার ফলে ভেটারের সাথে যোগাযোগ করা ছিলো দুরূহ ব্যাপার। তিন বছর বয়সে চিকিৎসা দল তাদের বাসায় আরো বড় একটা জীবাণুমুক্ত চেম্বার এবং একটি ট্রান্সপোর্ট চেম্বার তৈরি করে দেন যার ফলে সে হাসপাতাল এবং বাড়িতে যাতায়াত করতে পারতো। ভেটারের বয়স যখন ৪ বছর তখন সে আবিষ্কার করে চেম্বারের ভেতরে ভুলে রেখে যাওয়া একটা সিরিঞ্জ দিয়ে সে চেম্বারের গায়ে ফুটো করতে পারে! এই অবস্থায় তাকে বুঝানো হয় জীবাণু কি, এবং তার অবস্থা। সে আরো বড় হয়, এবং চেম্বারের বাহিরের রঙ্গিন পৃথিবী সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ৬ বছর বয়সে নাসার বিজ্ঞানীরা তাকে স্পেসস্যুটের আদলে একটা বিশেষ পোষাক বানিয়ে দেয় যেটা তার চেম্বারের সাথে যুক্ত এবং ওটার ভেতর ঢুকে সে বাহিরে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তবে সে মাত্র সাত বার সেই স্যুটটি ব্যবহার করেছিলো। কারণ দ্রুতই সে স্যুটের সাইজের তুলনায় বড় হয়ে যায়। ভেটারের চিকিৎসায় সেই আমলের ১.৩ মিলিয়ন ডলার খরচ হলেও শেষপর্যন্ত আরোগ্য মেলেনি। ১২ বছর বয়সে সে তার বোনের থেকে অস্থিমজ্জা ট্রান্সপ্ল্যান্ট গ্রহন করে। তার দেহ যদিও এর সাথে মানিয়ে নিয়েছিল কিন্তু কয়েকমাস পরে সে অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। তার মৃতদেহের অটোপ্সি থেকে জানা যায় দাতার অস্থিমজ্জায় লুকানো ছিলো এপস্টেইন বার ভাইরাসের বীজ, যেটা ট্রান্সপ্ল্যান্টের আগে শনাক্ত করা যায়নি। SCID নিয়ে অনেক শিশুই জন্মগ্রহন করে, কিন্তু সবাই তো ডেভিড ভেটার হতে পারেনা, তাই জন্মের পরপরই সংক্রমনে মারা যায়। যদিও ভেটার এই রোগ নিয়েও ১২ বছর বেঁচে ছিলো, কিন্তু সেটাকে কি বেঁচে থাকা বলে?
তথ্যসূত্রঃ
১। In defense of self; Willian R. Clark
২। Immunology; David Male, Jonathan Brostoff, David B. Roth, Ivan Roitt
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/David_Vetter
Leave a Reply