আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরত্বপূর্ন দুই উপাদান টি কোষ এবং বি কোষ। এরা উভয়েই শ্বেত রক্তকণিকার অংশ। এদের কাজের উদ্দেশ্য এক হলেও ধরণ ভিন্ন। মজার বিষয় হলো এদের উভয়েরই জন্ম হয় অস্থিমজ্জায়। বি কোষ অস্থিমজ্জায় বড় হলেও, জন্মের কিছুদিন পরই টি কোষ আলাদা হয়ে চলে যায় থাইমাসে। এই দুজনার দুটি পথ সে মুহূর্তে দুটি দিকে বেঁকে গেলেও পরিণত হবার পর কিন্তু এরা একসাথেই অনেক অভিজানে অংশ নেয়।
টি কোষ এবং বি কোষ একে অপরের থেকে আলাদা হবার পরপরই টি কোষ গুলো নিজেদের মধ্যে আবার দুই ভাগ হয়ে যায়। এক দল সহায়ক টি কোষ(Helper T Cell), অপর ভাগ ঘাতক টি কোষ(Killer T Cell)। সাহায্যকারী টি কোষের গায়ে প্রচুর সংখ্যক CD4 প্রোটিন থাকে, আর ঘাতক টি কোষের গায়ে থাকে প্রচুর সংখ্যক CD8 প্রোটিন। উভয় ধরণের টি কোষের গায়েই আবার এক ধরনের রিসেপ্টর থাকে যার সাথে অ্যান্টিবডির রিসেপ্টরের মিল আছে আবার নেই। তরুণ টি কোষ অস্থিমজ্জা থেকে থাইমাসে আসার পরপরই কিন্তু সে সহায়ক বা ঘাতক তকমা পায়না। থাইমাসে বড় হবার সময় যখন সে আপন এবং পর কে শিখতে থাকে সে সময়ই কিভাবে যেন এই তকমা জুটে যায় যা এখনো ঠিকভাবে জানা যায়নি।
CD4 কোষগুলো অভিযোজিত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার(Adaptive Immune System) জন্য খুব জরুরী। যার দেহে কম সংখ্যক CD4 কোষ থাকে তারা যথেষ্ট সংখ্যক অ্যান্টিবডি এবং ঘাতক টি কোষ তৈরি করতে পারেনা। আসলে তাদের কোন অভিযোজিত প্রতিরোধই থাকেনা। টি কোষ এবং বি কোষ মিলে ঝিলেই অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চলমান রাখে।
যখন বি কোষ অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে আসে তখনই কিন্তু সে পুরোপুরি সক্রিয় হয়না। আংশিক সক্রিয় বি কোষ পুরো-দমে সক্রিয় হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু করতে তার প্রয়োজন হয় টি কোষের সহায়তা। সহায়তা পাওয়ার পরই বি কোষ পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা লসিকাতন্ত্র হয়ে রক্তপ্রবাহে চলে আসে।
ঘাতক টি কোষের পরিণত হবার জন্যেও সহায়ক টি কোষের ভূমিকা আছে। তবে ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত ঘাতক টি কোষ সম্পর্কে কেউ জানতোনা। সে বছর একটা কুকুরের দেহে আরেকটি জিনগত দূরবর্তী কুকুরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই গ্রহীতা কুকুরের দেহে নতুন কিডনিটি বিকল হয়ে যায়। এক তরুণ চিকিৎসক গ্রহীতা কুকুরের দেহ থেকে লিম্ফোসাইট সংগ্রহ করেন আর দাতা কুকুরের দেহ থেকে কিছু কোষ নিয়ে সেগুলো ল্যাবে সংখ্যাবৃদ্ধি করেন। এরপর এদের একসাথে করলে দেখতে পেলেন লিম্ফোসাইটগুলো দাতা কুকুরের কোষগুলোকে মেরে ফেলছে। অন্যের দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলে অ্যান্টিবডির কারণে তা বিকল হওয়ার নজির থাকলেও লিম্ফোসাইটেও এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাওয়ার সবদিকে সাড়া পড়ে যায়।
এই আমদানিকৃত অঙ্গ বিকল করে দিতে টি কোষের ভূমিকা উদঘাটনের পর তারা যতটা খুশি হলে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে গেলেন। আপনার দেহে একটা অঙ্গ ঠিকমত কাজ করছেনা, তা অন্য একটা কার্যকর অঙ্গ এনে ঠিকভাবে বসিয়ে দিলে যদি সে কাজ করতে পারে তাহলে টি কোষের এখানে বাগড়া দিতে হবে কেন? আসলে, বড় পরিসরে চিন্তা করতে গেলে টি কোষের এমন আচরণ কিন্তু মানুষ ছাড়া কারো জন্যই ক্ষতির কারণ নয়। কেননা অঙ্গ প্রতিস্থাপন কোন প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। তাহলে টি কোষের আসল ভূমিকা কি? বেশ কয়েক বছর লেগে গেলো এটা বুঝতে যে বাস্তবে টি কোষ ভাইরাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধেও কাজ করে। ভাইরাস দেহের কোষের মধ্যে প্রবেশ করে তাদেরকে বদলে দেয়। আর টি কোষের কাজ হল এই বদলে যাওয়া কোষগুলো থেকে প্রাণীকে রক্ষা করা। ইমিউন সিস্টেম এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যাতে জন্মের একদম শুরু থেকেই বদলে যাওয়া কোষগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া না পাওয়ার সাথে জীবন-মৃত্যু জড়িত।
প্রতিস্থাপনের পর টি কোষের কাছে এই কোষগুলো নিজের কোষের মত লাগে, আবার লাগেও না। তারা তখন ধরে নেয় যে কোষগুলো ভাইরালি ইনফেক্টেড এবং ধরে খতম করে দেয়।
বি কোষ যেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে, অ্যান্টিজেনের গায়ে সেই অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখে তাকে অ্যান্টিজেন হিসেবে সনাক্ত করে। টি কোষ আবিষ্কার হবার পর পরই বিজ্ঞানীরা তাতে অ্যান্টিজেন সংগ্রাহক(Receptor) খুঁজতে থাকেন। যেহেতু টি কোষও বি কোষের মতই সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধেই কাজ করে তাই তার মধ্যেও কার্যত অ্যান্টিজেন সংগ্রাহক থাকা উচিত।
CD4 এবং CD8 কোষের অ্যান্টিজেন সংগ্রাহক পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে। এদের সংগ্রাহকের সাথে বি কোষের সংগ্রাহকের যথেষ্ট মিল রয়েছে। বি কোষের মতই টি কোষের সংগ্রাহকেরও ছোট ছোট জিনখন্ডের দৈব বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি হয়। এই জিনখন্ডগুলো বি কোষের মত হলেও আলাদা আর এদের বসবাসও একদম ভিন্ন ক্রোমোজোমে। তবে বি কোষের মত টি কোষের সংগ্রাহকও বিলিয়ন বিলিয়ন ধরণের হতে পারে। যেসব টি কোষ অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে পারে, তারা মেমরি সেল হিসেবে টিকে থাকে। কিন্তু যেসব টি কোষের সাথে তার পরিপূরক অ্যান্টিজেনের সাক্ষাৎ হয়না, তারা কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়।
তবে টি কোষের সংগ্রাহক শনাক্ত করা হলেও সবাই বুঝতে পারছিলো এখানে কিছু ঝামেলা আছে। অনেক অনেক বার চেষ্টা করা হলেও কেউই দেখাতে পারলোনা যে টি কোষ তার সুনির্দিষ্ট এন্টিবডির সাথে যুক্ত হয়েছে। যেমন, কোন প্রাণীকে যদি কোন অ্যান্টিজেনের জন্য প্রতিরোধ্য করা হয় তখন বি কোষ এবং সাহায্যকারী টি কোষ উভয়েই তৈরি হয়। পরে তার দেহ থেকে বি কোষ এবং টি কোষ সংগ্রহ করে যদি একই ধরনের ফ্লুরোসেন্ট এন্টিবডির সাথে রাখা করা হয় তাহলে দেখা যাবে বি কোষের সাথে এন্টিবডিগুলো যুক্ত হচ্ছে হলেও টি কোষের সাথে হচ্ছেনা।
এই ধাঁধার সমাধান করতে লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। সমাধানটি খুব সাধারণ। টি কোষ প্রকৃতপক্ষে সরাসরি অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হয়না। তখনই যুক্ত হয় যখন অ্যান্টিজেন উপস্থাপক কোষ তার কাছে অ্যান্টিজেনকে উপস্থাপন করে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে টি কোষ নিজের হাতে খেতে পারেনা, তার মুখে তুলে দিতে হয়। তুলে দেয় অ্যান্টিজেন উপস্থাপক কোষ, আর তুলে দেয়ার মাধ্যম হলো মেজর হিস্টোকম্পাটিবিলিটি কমপ্লেক্স সংক্ষেপে MHC। অ্যান্টিজেন উপস্থাপক কোষগুলো যদিও সারা দেহেই পাওয়া যায় কিন্তু এরা বেশি থাকে লিম্ফয়েড টিস্যুতে এবং দেহের যেই অংশগুলো সরাসরি পরিবেশে উন্মুক্ত থাকে সেসবে।
বিভিন্ন রকম অ্যান্টিজেন উপস্থাপক কোষের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ডেন্ড্রাইটিক কোষ। ডেন্ড্রাইটিক কোষ দেখতে স্নায়ুকোষের খুব কাছাকাছি। এদের শরীরের সবখানেই ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া যায়। ডেনড্রাইটিক কোষ তার আশপাশ থেকে নানা রকম জিনিস টুকে নিয়ে সেসবের কিছু কিছু পেপটাইড কে টি কোষের সামনে তুলে ধরে। CD4 এবং CD8 কোষ এসব পেপটাইডের টুকরাকে ক্রমাগত পরীক্ষা করতে থাকে যে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কি না। ডেনড্রাইটিক কোষ CD4 এবং CD8 কোষের কাছে ভিন্ন উপায়ে অ্যান্টিজেনকে উপস্থাপন করে।
CD4 এর জন্য ডেনড্রাইটিক কোষ আশপাশে ভাসমান বিভিন্ন সম্ভাব্য অ্যান্টিজেনকে এন্ডোসাইটোসিসের মাধ্যমে ভেতরে টেনে নেয়। অ্যান্টিজেনকে এরপর তার প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটে ভেঙ্গে ফেলে। প্রোটিনকে আরও ছোট করে একদম সরল পেপটাইডে পরিণত করার পর এসবের কিছু কিছু ডেনড্রাইটিক কোষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আর কিছু অংশ MHC এর সাথে যুক্ত করে বাইরে ঝুলিয়ে দেয় যেগুলো CD4 কোষ পরীক্ষা করে দেখে।
CD8 এর জন্য বাইরের নয়, যেসব প্রোটিন ডেনড্রাইটিক কোষের ভেতরেই তৈরি হয় সেগুলোকে নজরবন্দি করে। নতুন তৈরি ছোট ছোট প্রোটিন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে এসে সন্নিবিষ্ট হয়ে কার্যকর রূপ পায়। নতুন তৈরি হওয়া প্রোটিনগুলোর কিছু স্যাম্পল আবার পেপটাইডে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং MHC এর সাথে জুড়ে দিয়ে কোষের বাইরে লটকে দেয়া হয়, আর এদের যাচাই করে CD8 কোষ। কোষ যদি ভাইরাসে আক্রমণের শিকার হয়, তখন সে আক্রান্ত কোষের কলকব্জা ব্যবহার করে করে নিজের প্রোটিন তৈরি করে। এই অবস্থায় এসব ভাইরাল প্রোটিনের কিছু অংশ CD8 কোষ ধরে ফেললেই কেল্লা ফতে।তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেনড্রাইটিক কোষের ভেতরে এবং বাইরে যেসব প্রোটিন থাকে সেগুলা প্রাণীর নিজেরই প্রোটিন। তাই তাদের নিয়ে টি কোষ মাথা ঘামায়না।
MHC’র একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার বৈচিত্র্য। কত ভিন্ন ভিন্ন রূপে এরা থাকতে পারে। আমরা জানি অ্যান্টিবডিও প্রচুর বৈচিত্র্যময়। মিলিয়ন ধরনের অ্যান্টিবডি একই ব্যক্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু MHC প্রোটিনের বৈচিত্র্য বিরাজ করে প্রজাতির মধ্যে। প্রজাতির প্রতিটা সদস্যের মধ্যে কেবলমাত্র অল্প কয়েক ধরণের MHC থাকে। তাই MHC হলো এক রকম স্বকীয়তার মার্কার। আর এটাই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিশাল একটা সমস্যা।
টি কোষ আর বি কোষের একটা বড় পার্থক্য হলো অ্যান্টিজেন কর্তৃক সক্রিয়করণের পরবর্তী ঘটনা। বি কোষ যখন অ্যান্টিজেন দ্বারা সক্রিয় হয় তখন তখন তারা প্রচুর সংখ্যক অ্যান্টিবডি তৈরি করে। আর টি কোষ সক্রিয় হলে তারা অ্যান্টিজেনের উৎস খুঁজতে তৎপর হয়। উভয় রকম টি কোষ অ্যান্টিজেনের উৎস পেলে সাইটোকাইন নামের ছোট ছোট প্রোটিন ছেড়ে দেয় যেগুলো কোষের সাথে কোষের যোগাযোগে কাজ করে। সাইটোকাইনের মাধ্যমে অন্যান্য বিভিন্ন কোষের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া আরো জোরালো হয়।
বি কোষ এবং টি কোষের উভয়েই অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ। এদেরকে বুঝতে গত শতকে এত বেশি কাঠখড় আর সময় গেছে যে অনেকে প্রতিরোধ-ব্যবস্থা বলতে শুধু এদেরকেই বুঝেন। এটা সত্য আমরা অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি খুবই নির্ভরশীল, এটা ছাড়া বাঁচতে পারিনা। তবে প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থা খুব কমই প্রতিরক্ষা দিয়ে থাকে। বরং তা আমাদের অন্তর্নিহিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতাকেই আরো বিস্তৃত করে।
Leave a Reply