আমাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অন্তর্নিহিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বিবর্তনীয় সময়রেখায় আগে আসা অন্তর্নিহিত প্রতিরোধের ব্যাপ্তি গায়ের চামড়া, চোখের পানি, পেটের এসিড, নাকের মিউকাস এবং নানান রকম শ্বেতরক্তকণিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকে অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডি, টি কোষ, বি কোষ সহ আরো সূক্ষ্ণ জিনিসপাতি। যদিও মানুষের মত বড়সর একটি প্রাণি যার আবার বংশবৃদ্ধির হার অতটা দ্রুত নয়, তাকে রক্ষা করার জন্য শুধু অন্তর্নিহিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা যথেষ্ট না হলেও যেকোন সংক্রমনে টি কোষ, অ্যান্টিবডি এদের কসরত শুরু হবার আগ পর্যন্ত অন্তর্নিহিত প্রতিরোধই আমাদের ভরসা।
ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমনে অন্তর্নিহিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুইটা ধাপে কাজ করে। প্রথমে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়া কি না তা শনাক্ত করে। তারপর শরীরে প্রদাহ তৈরি করে ব্যাক্টেরিয়ার বিস্তার ও অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রন করে।
আমরা জানি ব্যাক্টেরিয়ার বংশবৃদ্ধির হার খুব বেশি, সেকারণে এদের মধ্যে পরিবর্তনও দ্রুত আসে। তাহলে সদা পরিবর্তনশীল শত শত ব্যাক্টেরিয়াকে কিভাবে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা চিনতে পারে? স্বস্তির বিষয় হচ্ছে সব ধরণের অণুজীবেরই এমন কিছু গাঠনিক উপাদান আছে, যেগুলোর পরিবর্তন হলে তার টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। এই গাঠনিক উপাদানগুলো হতে পারে বিশেষ কোন প্রোটিন, ডিএনএ অথবা আরএনএর বিশেষ কোন সিকোয়েন্স, এমনকি ফ্যাট অথবা কার্বোহাইড্রেটও হতে পারে। আর এগুলোই ব্যাক্টেরিয়াকে শনাক্ত করার কাজে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মুখ্য টার্গেট। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অনুজীবের নমুনা শনাক্তকরন(Microbial pattern recognition)। এই পদ্ধতি এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে, সে শুধু সে সকল প্যাটার্নকেই শনাক্ত করে যেগুলো অনুজীবের গুরুত্বপূর্ন গাঠনিক উপাদান এবং আমাদের নিজেদের দেহে সেসবের কাছাকাছি কিছু নেই। অনুজীবের দেহের এসব জিনিসকে বলা হয় Pathogen Associated Molecular Pattern তথা প্যাম্প। প্যাম্পের সাথে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার যেসব রিসেপ্টর যুক্ত হয় তাদের নাম Pattern Recognition Receptors(PRR)।
কাজের দিক থেকে অ্যান্টিবডি আর অ্যান্টিজেনের মধ্যে যা হয়, PRR ও PAMP এর মধ্যেও তা-ই হয়। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, PRR এর প্রোটিনের সকল জেনেটিক কোড এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পরিবর্তন ছাড়াই সঞ্চারিত হয়। কিন্তু জিনগত বিন্যাস সমাবেশের মাধ্যমে যেসব কার্যকর টি কোষ কিংবা বি কোষের রিসেপ্টর তৈরি হয়, এরা কিন্তু সঞ্চারিত হয়না বরং প্রত্যেকের দেহে নতুন নতুন ভাবে তৈরি হয়। তবে এই ক্ষেত্রে বিন্যাস সমাবেশের পদ্ধতিটাই সঞ্চারিত হয়, ফলাফল নয়।
এই রিসেপ্টরগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কিছু রিসেপ্টরের কাজ একদম ডাইরেক্ট অ্যাকশন। এদের টার্গেট PAMP ধারণকারী ব্যাক্টেরিয়া পেলেই মেরে ফেলে। এদের পাওয়া যায় নিউট্রোফিল নামের এক ধরনের শ্বেতকণিকায় আর এদের কাজের ধরণ অনেকটা ম্যাক্রোফেজের মতো। ডিফেন্সিন এবং ক্যাথেলিসিডিন নামের আরো কিছু PRR আছে, যারা কাজ করে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের মতো। এরা ব্যাক্টেরিয়ার মেমব্রেন ফুটো করে দেয়, আর সেই ফুটো দিয়ে তার মাল মশলা বের হয়ে গিয়ে ব্যাক্টেরিয়া মারা যায়। ম্যানান বাইন্ডিং লেক্টিন নামের আরেক PRR আছে যারা অ্যান্টিবডির মতো করে ব্যাক্তেরিয়ার গায়ে লেক্টিনের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। আর যেসব ম্যাক্রোফেজে লেক্টিনের রিসেপ্টর আছে তারা এই সব ব্যাক্টেরিয়াকে গিলে ফেলে।
যেই প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়ার(Immune Response) এর সাথে আমরা বহুকাল ধরে পরিচিত তাকে বলা হয় প্রদাহ(Inflammation)। শরীরের কোথাও জ্বালাপোড়া করা, ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ব্যাথা করা এসবই প্রদাহের লক্ষন। আর এই প্রদাহের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখে যে রিসেপ্টর তার নাম TLR। এদের বসবাস বিভিন্ন শ্বেতকণিকার গায়ে। এই শ্বেতরক্তকণিকার মধ্যে আবার ম্যাক্রোফেজ কিংবা ডেনড্রাইটিক কোষে বিদ্যমান TLR গুলোই প্রদাহ শুরু করতে সবচেয়ে পটু। যখন এদের গায়ের TLR তার টার্গেট PAMP এর সাথে যুক্ত হয় তখন এরা Proinflammatory cytokines নিঃসরন ঘটায়। এরা নানা রকমের রাসায়নিক যেগুলো প্রদাহের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে। এদের মধ্যে আছে Prostaglandin এরা করে কি, আসেপাশের রক্তনালীগুলোর ব্যাস বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে আক্রান্ত স্থানে বেশি বেশি রক্ত পৌছাতে পারে। ফলে যায়গাটা লাল হয়ে যায়।
ম্যাক্রোফেজের TLR ব্যাক্টেরিয়াকে আটকে ফেলেলে সাইটোকাইন তো নিঃসৃত হয়ই, আবার সেই ম্যাক্রোফেজও কিন্তু ব্যাক্টেরিয়াক নিজগুণে ছিন্ন বিছিন্ন করে ফেলে। ব্যাক্টেরিয়ার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পেয়ে সক্রিয় হয় Mast cell. এরা সক্রিয় হলে নিঃসরণ ঘটায় histamine এর। এরা আবার আসেপাশের রক্তনালীকে ঝালরের মতো করে ফেলে যার কারণে আরো বেশি সংখ্যক শ্বেতকণিকা নালীর ফুটো গলে আক্রন্ত জায়গায় পৌছায়।
এত এত রকমের কোষের আগমনে আক্রান্ত জায়গাটা ফুলে ওঠে আর তাদের নি:সৃত তরলের প্রভাবে ব্যাথাও হতে পারে। কিছু কিছু সাইটোকাইন যেমন TNF-α স্থানীয় পেইন রিসেপ্টরকে সক্রিয় করলে মগজ বুঝতে পারে, এখানে কোন সমস্যা আছে। অন্যান্য সাইটোকাইন সরাসরি মগজে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে বলে, যাকে আমরা জ্বর বলি। এই বাড়তি তাপমাত্রায় আমাদের জন্য কষ্টকর হলেও তা ব্যাক্টেরিয়ার টিকে থাকায় ঝামেলা বাঁধায়। আমাদের কষ্টের আরো কারন হলো ম্যাক্রোফেজ আর নিউট্রোফিলের বদ স্বভাব। যদিও এদের কাজ ব্যাকটেরিয়া সহ যাবতীয় ক্ষতিকর কোষকে গলাধ:করণ করা তথা খাওয়া। এরা ঠিক ভদ্রলোকের মত খায়না। বরং খাওয়ার সময় এদের নিজেদের বিভিন্ন এনজাইম আসেপাশে ছড়িয়ে পড়ে সুস্থ কোষ গুলোকেও নষ্ট করে।
এই ঘটনাগুলো চলতে চলতেই কিছু ডেন্ড্রাইটিক কোষ গিলে ফেলা ব্যাক্টেরিয়া চিবুতে চিবুতে রওনা দেয় কাছাকাছি লসিকাগ্রন্থির দিকে। সেখানে অবস্থানরত টি কোষের কাছে ব্যাক্টেরিরার বিভিন্ন অংশ দেখিয়ে দেখিয়ে সক্রিয় করে দেয়। তার পর আবার টি কোষগুলো সেই ব্যাক্টেরিয়াকে খুজতে বের হয়, এর মাধ্যমে অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যাবস্থাও আমাদের প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়।
এই ঘটনাগুলো চলতে চলতেই কিছু ডেন্ড্রাইটিক কোষ গিলে ফেলা ব্যাক্টেরিয়া চিবুতে চিবুতে রওনা দেয় কাছাকাছি লসিকাগ্রন্থির দিকে। সেখানে অবস্থানরত টি কোষের কাছে ব্যাক্টেরিরার বিভিন্ন অংশ দেখিয়ে দেখিয়ে সক্রিয় করে দেয়। তার পর আবার টি কোষগুলো সেই ব্যাক্টেরিয়াকে খুজতে বের হয়, এর মাধ্যমে অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যাবস্থাও আমাদের প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়।
কিছু ব্যাতিক্রম বাদে বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়া আমাদের রক্তপ্রবাহে বসবাস করে এবং বংশবৃদ্ধি করে। তাই এদের বিরুদ্ধে অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যাবস্থা প্রধানত অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডিগুলো যখন ব্যাক্টেরিয়ার গায়ে লেগে থাকে তখন কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম তাদের মেরে ফেলে কিংবা ম্যাক্রোফেজ তাদের গিলে নেয়। নিউট্রোফিলও এই ব্যাক্টেরিয়া গুলোকে আমাদের শরীর থেকে বিতাড়িত করতে তৎপর থাকে। তবে কখনো কখনো ব্যাক্টেরিয়াগুলো আমাদের কোষের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করে। এই পরিস্থিতিতে দরকার একটু ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা।
কিছু ব্যাতিক্রম বাদে বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়া আমাদের রক্তপ্রবাহে বসবাস করে এবং বংশবৃদ্ধি করে। তাই এদের বিরুদ্ধে অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যাবস্থা প্রধানত অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডিগুলো যখন ব্যাক্টেরিয়ার গায়ে লেগে থাকে তখন কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম তাদের মেরে ফেলে কিংবা ম্যাক্রোফেজ তাদের গিলে নেয়। নিউট্রোফিলও এই ব্যাক্টেরিয়া গুলোকে আমাদের শরীর থেকে বিতাড়িত করতে তৎপর থাকে। তবে কখনো কখনো ব্যাক্টেরিয়াগুলো আমাদের কোষের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করে। এই পরিস্থিতিতে দরকার একটু ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা।
ব্যাক্টেরিয়া যখন কোষের ভেতর ঢুকে পরে তখন কোষের প্রোটিওসোম ব্যাক্টেরিয়ার এন্টিজেনস্বরূপ পেপটাইডগুলো ভেঙ্গে ফেলে। এরপর ট্যাপের মাধ্যমে এই ভাঙ্গা পেপটাইডের টুকরো গুলো চলে আসে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে। ট্যাপের(TAP) সম্পুর্ন অর্থ Transporter Associated antigen Protein কমপ্লেক্স। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে পেপটাইডগুলোর সাথে MHC নামের প্রোটিন যুক্ত হয় তারপর সেই কমপ্লেক্সটি চলে আসে কোষের মেমব্রেনে। সহজ ভাষায় ঘটনা যেটা ঘটলো, তা হলো আমার ঘরে ডাকাত এসেছে, আমি ডাকাতের মাথার ক্যাপটা আমার জানালা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম। যাতে বাইরে পুলিশ, গার্ড যারা ঘুরাঘুরি করে তারা সেটা দেখে বুঝতে পারে এবং ব্যবস্থা নেয়। এই যে ব্যাক্টেরিয়ার পেপটাইডটা কোষের বাইরে মেমব্রেনে ঝুলিয়ে দেয়া হলো এটাকে দেখে সাইটোটক্সিক টি লিম্ফোসাইট সক্রিয় হয়ে কোষটিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে, টি হেল্পার কোষ-১ সক্রিয় হয়ে সুপার অক্সাইড এনায়ন তৈরি করতে পারে যা কোষের ভেতরের ব্যাক্টেরিয়াকে মারে, আবার যদি টি হেল্পার কোষ-২ সক্রিয় হয়, তখন অনেক কিছুর সাথে অ্যান্টিবডিও তৈরি হতে পারে।
আশ্চর্যের বিষয় এই ব্যাক্টেরিয়া মানুষে টানাটানি সেই হাজার বছর ধরে চলছে, এমনকি এই মুহুর্তে আপনি যে লেখাটি পড়ছেন সেই সময়েও এমন কত রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আপনার শরীরের ভেতর, আপনি টেরও পাচ্ছেন না।
Leave a Reply