জাপানে আসার আগে যেই একটা মাত্র জাপানিজ নাম জানতাম, তা ছিল ওকাজাকি। তিনি প্রথম রিপোর্ট করেন ওকাজাকি ফ্রেগমেন্ট। কিন্তু, দুঃখের ব্যাপার হল, উনি এই ধরনের মৌলিক কাজের জন্য নোবেল পান নি। উনি কেন নোবেল পান নি? কিংবা, কেন ওকাজাকি ফ্রেগমেন্ট নোবেলের নমিনেশনে আসে নি? কিংবা, নোবেলে মহিলা বিজ্ঞানীদের মনোনয়ন এতো কম কেন? কিংবা, স্যার জেমস ওয়াটসনের ব্যাপারে অতি সাম্প্রতিক আলোচনা নিয়ে আপনি কি ভাবছেন? – এই সব বিষয় গুলোকে একটা সামগ্রিক আলোচনায় এনে ব্যাখ্যা করছি।
ওকাজাকি কেন নোবেল পান নি?
ওকাজাকি প্রথম ছোট ছোট ফ্রেগমেন্ট রিপোর্ট করেন ১৯৬৮ সালে একটা কনফারেন্সে। তখন অনেকেই বলছিল যে, সম্ভবত ঐ সকল ছোট ফ্রেগমেন্ট গুলো বড় কোন ফ্রেগমেন্ট ভেঙ্গে তৈরি হচ্ছে। সুতরাং, ঐ সময় সবাই তার এই রিপোর্টে খুব একটা কনভিন্সড ছিল না। আর হিরোশিমার রেডিয়েশনের কারণে উনি ১৯৭৫ সালে মারা যান লিউকেমিয়াতে। আর মৃত ব্যাক্তিকে নোবেলের নমিনেশনে রাখা হয় না। এই কারণে, ওকাজাকি তার ফান্ডামেন্টাল কাজের জন্য মনোনীত হবার সুযোগ পান নি।
কেন ওকাজাকি ফ্রেগমেন্ট নোবেলের নমিনেশনে আসে নি?
এই প্রশ্নটার উত্তর আগের অংশেই শেষ হয়ে যেত, যদি না আরও কিছু তথ্য উপাত্ত না থাকতো। কারণ, ওকাজাকির পাশাপাশি একই প্রোজেক্টে কাজ করতেন তার স্ত্রী, সুনেকো। ওকাজাকির মৃত্যুর পর সুনেকো অনেক বছর ধরে কাজ চালিয়ে যান, আরও অনেক পরীক্ষা করে প্রমান করার জন্য। ধারণা করা হয়, যদি ওকাজাকি বেঁচে থাকতো, তাহলে তারা এই কাজের জন্য নোবেল পেত। কিন্তু, এই জায়গায় একটা বিশাল জিনিস রয়ে যায়, যা কখন সামনের সারিতে আসে না।
যদিও ওকাজাকি এবং সুনেকো একই সাথে একই গবেষণায় কাজ করতো, বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসতো ওকাজাকির কাছে। ওকাজাকি বেঁচে থাকা অবস্থায় কোন আমন্ত্রণেই সুনেকোর নাম তো থাকতোই না, এমনকি সুনেকো প্রোজেক্টের অংশ হিসেবেও উপস্থিত থাকতো না মিটিং গুলোতে, বরং সে অন্য দশ জন গৃহিণীর মতন বাসায় থাকতেন। ওকাজাকির এই বৈশিষ্ট্য সুনেকোর ভাষায় বললেঃ
সোজা কোথায় বলা যায়, ওকাজাকি নিজেই কখনো সুনেকোর অবদানকে সেভাবে মূল্যায়ন করতেন না। অনেক বছর পর যখন সুনেকোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো,
যদি ওকাজাকি বেঁচে থাকতো এবং নোবেলের নমিনেশনে তার নাম আসতো, আপনার কি মনে হয় সে আপনার কন্ট্রিবিউশনের কথা উল্লেখ করে আপনার নাম যোগ করতে বলত?
এই অংশ টুকু থেকে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ওকাজাকি নিজেও মহিলা বলে অথবা স্ত্রী বলে, যে কারনেই হোক, সুনেকোর অবদানকে খুব একটা সামনে আনতেন না।
নোবেলে মহিলা বিজ্ঞানীদের মনোনয়ন এতো কম কেন?
এখন পর্যন্ত নোবেল পাওয়া পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা যদি আলাদাভাবে দেখা হয়, তাহলে পুরুষ ৮৫৬ এবং মহিলা ৫২ (১৯০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত)। এর মাঝে যদি, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা এবং অর্থনীতি হিসেব করা হয়, তাহলে পুরুষ ৬৬৭ এবং মহিলা ২১। শতকরা হিসেবে মাত্র ৩%। আর এই ব্যাপারটা নিয়েই গত কয়েক বছর প্রতিবার নোবেল পুরষ্কারের সময়ে, আগে-পরে খুব আলোচনা-সমালোচনা চলে।
আবারো ওকাজাকির ঘটনাতে ফিরে আসি। ওকাজাকি তার সাথে একই গবেষণায় কাজ করা তার স্ত্রীর অবদান যদি মূল্যায়ন না করে, তাহলে খুব সহজেই বুঝা যায় যে, এটা একটা সামাজিক সমস্যা। এখানে মহিলা গবেষকদের বিজ্ঞানচর্চা অথবা তাদের অবদান কোন সমস্যা না। অনেকেই ধারণা করতে পারেন যে, ১৯৬০ এর দশকে সামাজিক প্রেক্ষাপট এমন ছিল। কিন্তু, আপনার কি মনে হয়, বর্তমান সময়ে এসে সামাজিক প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে? যদি পাল্টে যেতই, তাহলে নোবেলে পুরুষ এবং মহিলাদের এই সংখ্যার তারতম্য এতোটা প্রতীয়মান হতো না।
স্যার জেমস ওয়াটসনের ব্যাপারে সাম্প্রতিক বিতর্ক
অতি সাম্প্রতিক সময়ে জেমস ওয়াটসন আলোচনায় চলে আসে তার কিছু আপত্তিকর মন্তব্যর কারণে। সেই সূত্র ধরে, তার অনেক মন্তব্যই নিউজ ফিডে সামনের দিকে চলে আসে। মহিলা গবেষকদের ব্যাপারে উনার একটা মন্তব্য ছিল এমনঃ
“Female scientists, while making work “more fun for the men,” are “probably less effective.”
ওকাজাকি এবং ওয়াটসন যদি মহিলা সায়েন্টিস্টদের ব্যাপারে এই ভাবে চিন্তা করে, তাহলে এক বাক্যেই বলা যায়, এটা আমাদের মধ্যে এক বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা। এটা শুধু মাত্র নোবেল কমিটির সিলেকশন বায়াস না, এটা সর্বত্র বিরাজ করতেছে। আমাদের সামনে যখন কিছু দিন পর পর কোন ঘটনা দৃশ্যমান হয়, আমরা প্রতিবাদ করি, ভাবি এটা সামান্য ব্যাপার। ওকাজাকি ফ্রেগমেন্টের মতন ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা আমাদের বৈশ্বিক সমাজের উপর থেকে নিচে সামগ্রিক সমস্যা। এই ধরনের ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে, এমন বৈষম্যর শিকার হবে আপনার-আমার মা, বোন, বান্ধবী, স্ত্রী এবং আত্মীয় স্বজন।
রেফারেন্সঃ
ওকাজাকির ব্যাক্তিগত ঘটনাগুলোর জন্য
Okazaki fragments and the Nobel prize
নোবেল প্রাইজে নারী পুরুষের বৈষম্য বিষয়ক পরিসংখ্যান
Nobel prize awards by gender in each category
জেমস ওয়াটসনের সাম্প্রতিক ঘটনাসহ তার আগের কিছু মন্তব্য
DNA pioneer James Watson loses honorary titles over racist comments
Leave a Reply