আজকাল প্রোবায়োটিক সম্পর্কে এত বেশী প্রচার-প্রচারণা হয়, তাতে অনেকের মনেই এমন ধারণা হতে পারে যে এটা বুঝি ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম থেকে শুরু করে ক্যান্সার সব কিছুই নিরাময় করার যাদুকরী ওষুধ। প্রোবায়োটিক শব্দের অর্থ জীবনের জন্য। আমাদের শরীরের ভিতরে নানারকম জীবাণু বাস করে। এদের প্রোবায়োটিক বলা হয়। এরা ব্যাকটেরিয়া কিংবা ইস্ট। শরীরের ভিতরে যে সকল জীবাণু থাকে, তাদের সবাই কিন্তু আমাদের ক্ষতি করে না। কিছু জীবাণু আমাদের বন্ধু। সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের শরীরে এসব জীবাণুর উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। কিছু প্রোবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়ার তালিকা Lactobacillus bulgaricus, Lactobacillus plantarum, Lactobacillus rhamnosus, Lactobacillus casei, Bifidobacterium, Bacillus infantis, Streptococcus thermophillus, Enterococcus faecium।
মূলত পরিপাক নালীতে এসব জীবাণু থাকলে আমাদের নানারকম উপকার হয়। বাস্তবতা হচ্ছে খুব কম মানুষই বলতে পারে তার খাওয়া দাওয়া এবং জীবনাচরণ সঠিক মতো চলছে। সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ব্যায়াম করে এবং উপযুক্ত প্রোবায়োটিক গ্রহণ করে সঠিক জীবনাচরণ পালন করার চেষ্টা করতে পারি। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের বন্ধু জীবাণুসমূহ অনেকসময় আমাদের ভুলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমনঃ অতিরিক্ত মদ্যপান, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণ করা, বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান গ্রহণ করা, অন্ত্রের নানাধরনের জীবাণু সংক্রমণ, এবং অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার।
প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলা সাধারনত দুই ট্র্যাকে আমাদের উপকার করে থাকে প্রথমত এই ব্যাকটেরিয়া গুলা ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে কাজ করে, আমাদের সুস্থ দেহে সাধারনত উপকারী ও অপকারী ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে একটা ব্যালেন্স বজায় থাকে। অপকারী ব্যাক্টেরিয়া গুলো প্রভাব বিস্তার করে তখনেই যখন আমরা অপুষ্টিকর খাবার, ঘুমের অনিয়ম, মানসিক চাপ, অতিমাত্রায় এন্টিবায়োটিক সেবন করি। এই অপকারী ব্যাক্টেরিয়া গুলো যখন আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার চেয়েও বেশি পরিমানে থাকে তখন ডায়েরিয়া, দূর্বলতা, ইউনারি ইনফেকশন সহ নানান জটিলতার সৃস্টি হয়। আমরা যদি পরিমিত এই প্রোবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়া সমৃদ্ধ খাবার খাই তাহলে ডাইজেস্টিভ ট্র্যাকের অনেক অসুখ থেকেই আমরা রেহাই পেতে পারি। দ্বিতীয়ত হলো এরা আমাদের ইমুনো সিস্টেম শক্তিশালী করনের গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে, বিশেষ করে ন্যাচারাল কিলার সেলের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে এই সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলে ফলে অটোইমুনো ডিজিজ থেকে হোস্ট খুব সহজে রক্ষা পায়।
বর্তমান সময়ে একটি প্রচলিত সমস্যা হচ্ছে স্থূলতা । প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বি বা মেদ শরীরে জমাকেই স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়া বলে। একে বিভিন্ন রোগের কেন্দ্রবিন্দু বলা হয়। বিভিন্ন কারণে মানুষের শরীর মেদবহুল হয়ে উঠে। যেমন- অধিক ক্যালরি গ্রহণ, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার যেমন, চকলেট, বার্গার, কোমল পানীয়, আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার অধিক পরিমাণে গ্রহণ, খেলাধুলা এবং শারীরিক ব্যায়ামের অভাব, হরমোন জনিত সমস্যা ও পারিবারিক ও বংশগত কারণ। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও স্থূলতার হার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ছেলেদের মধ্যে স্থূলতার হার ছিল ৩ শতাংশ আর মেয়েদের মধ্যে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। যা ১৯৭৫ সালে ছিল মাত্র ০ দশমিক ০৩ শতাংশ। স্থূলতা বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিশেষত হৃদরোগ, দ্বিতীয় পর্যায়ের ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, হাইপারইউরিসেমিয়া (Hyperuricemia), গেঁটে বাত সহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে স্থূলতা থেকে।
আমরা যদি দেহের চাহিদার থেকে বেশি পরিমাণে প্রোটিন খেয়ে থাকি বা খাবারে যদি এলকোহল জাতীয় খাবারের পরিমাণ বেশি থাকে, তা থেকে দেহে পিউরিন নামক নন এসেনসিয়াল এমাইনো এসিড তৈরি হয়। এই পিউরিনের শেষ উৎপাদন (এনডপ্রডাক্ট) হিসেবে ইউরিক এসিড তৈরি হয়। এই ইউরিক এসিড প্রথমে রক্তে চলে যায়। সেখান থেকে কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। রক্তে যদি ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায় এই অবস্থাকে বলা হয় হাইপারইউরিসেমিয়া। এই অতিরিক্ত ইউরিক এসিড সূক্ষ্ম স্ফটিক (ক্রিস্টাল) আকারে জয়েন্টের মধ্যে বিশেষ করে পায়ের আঙ্গুলে ব্যথা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া আমাদের দেহের শ্বেত কণিকা এই ইউরিক এসিড স্ফটিককে ফরেন বডি মনে করে আক্রমণ করে। ফলে বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হয় বা ফুলে যায়। এই অবস্থাকে টোফেস বলে। প্রথম অবস্থায় শুধু পায়ে ব্যথা হয়। আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পা ফোলা, হাঁটু ও হাঁটুর জয়েন্টে ব্যথা হয়। ফলে ইউরিক এসিড আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটতেও সমস্যা হয়। হাইপারইউরিসেমিয়ার কারণে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন : বাত, কিডনিতে পাথর, কিডনি অর্কাযকর হওয়া, উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে।
স্থূলতা হ্রাসের জন্য বাজারে প্রচলিত ঔষুধের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকায় বিকল্প সমাধান হিসাবে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। সম্প্রতি আমেরিকান কলেজ অফ নিউট্রিশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যে, তাইওয়ানের গ্রেপ কিং বায়োটেক কোম্পানির একদল গবেষক শরীরের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে Lactobacillum plantarum GKM3 প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে। তাদের প্রাথমিক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, Lactobacillum plantarum GKM3 কার্যকরীভাবে অতিস্থূলতা প্রানীর শরীরে ইউরিক এসিডের পরিমাণ কমিয়ে স্থূলতা হ্রাসে সাহায্য করে। যে ভাবে এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তাতে করে অনেক এন্টিবায়োটিক এক সময় অকার্যকর হয়ে যাবে, বিকল্প চিকিৎসা হিসাবে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা প্রোবায়োটিক ট্রিটমেন্টের উপর জোর দিচ্ছেন। নিয়মিত যেসকল খাবর খেয়ে খুব সহজে আমরা এই সকল ব্যাক্টেরিয়া গুলাকে পেতে পারি সেগুলো হলো যে কোন দুগ্ধ জাত পণ্য যেমন পনির, দধি, দুধ ইত্যাদি। আমরা চাইলে নির্দিষ্ট রোগের জন্য প্রকৃতি থেকে নির্দিষ্ট প্রোবায়োটিক আলাদা করে বাজারজাত করতে পারি, এতে করে দেশের চিকিৎসা ব্যায় অদূর ভবিষ্যতে অনেকাংশেই কমে যাবে।
Leave a Reply