মস্তিষ্কের চেতনা রহস্য

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মস্তিষ্ক। এটি স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় অঙ্গ যা সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে মিলে মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠন করেছে। মানব অস্তিত্বের অনেক কিছুই মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়।

মস্তিষ্ক এমন একটি বিস্ময়কর সত্তা যার বিষয়ে যত জানা যায় ততই অবাক হতে হয়। উদাহরণস্বরুপ,মানুষের এই মস্তিষ্ককে যদি অর্ধেক কেটে ফেলা হয় তাহলেও বাকি অংশটুকু কেটে ফেলা অংশের কাজ করার সামর্থ রাখে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ধরুন আপনার মস্তিষ্ক অর্ধেক কেটে ফেলা হলো এবং সেই অংশটুকু যদি অন্যকোন জায়গায় স্থাপন করা হয় তাহলে কোন অংশটুকুকে আপনি নিজেকে ধরবেন? আবার ধরুন,আপনি কোন ঘটনা দেখে কোন কিছু চিন্তা করলেন কিন্তু কি চিন্তা করলেন সেটা আপনি ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ জানতে পারবে না, এই যে নিজের আত্ম-অভিজ্ঞতা, যেটি শুধু আপনিই অনুধাবন করছেন সেটাই আপনার চেতনা। তবুও এই একটি জিনিসের উপর সকলের যথেষ্ট ধারণা এখনো অস্পষ্ট। সে বিষয়ে বিস্তারিত যাওয়ার আগে “চেতনা কি” সে বিষয় নিয়ে আরেকটু জানা যাক।

Consciousness - Wikipedia
চেতনা কী? সতেরশ’ দশকের চিত্রকর্ম (উইকিপিডিয়া)। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ নিয়ে বিস্তারিত: “মগজ-ঘরে বসত করে কয়জনা?

চেতনা হলো মস্তিষ্কের শত কোটি কোটি নিউরনের একত্রে কাজ করার ফলে উত্থিত সেই সব অভিজ্ঞতা, যা বিশ্ব সম্পর্কে জানতে এবং অন্যকে তা জানাতে সাহায্য করে। এর সরলতম উদাহরণ হিসেবে বলা যায় “অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা”।

প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞানীরা এখন ‘মস্তিষ্কের চেতনা’ বিষয়ে বোঝার জন্য উদ্ধুদ্ধ হয়ে পড়েছেন, এর পিছনে অবশ্য কিছু কারণও রয়েছে।কিন্তু আজ থেকে ১০০ বছর আগেও যখন বিজ্ঞানীদের আবিস্কারের জোয়ারে ভাসছিলো মানুষ, মনোবিজ্ঞানীগন মানুষের আচার আচরণ নিয়ে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করলেন, নিউরোসায়েন্টিস্টগণ মস্তিষ্কের সকল বিষয়ে গবেষণার সাফল্য অর্জন করলেন কিন্তু মস্তিষ্কের চেতনা বিষয়টিকে তারা একপ্রকার বাদই দিয়ে দিলেন এমনকি তার উপর বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাতও করলেন না। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় দেখা গেলো মানব কাজের সকল উৎস এই চেতনা। চেতনা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে ইহজাগতিক যাবতীয় সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ দর্শন সম্ভব নয়।

র‍্যনে দেকার্তে দেহ ও মস্তিষ্কের চেতনার দ্বৈততা বা ডুয়ালিজমের ধারণা দিয়ে বলেছিলেন ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’ (cogito ergo sum)। মস্তিষ্ক এবং এর সকল স্নায়ুকোষ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে বিবেচনা করে তিনি মানবদেহকে একটি মেশিনের সাথে তুলনা করতেও পিছুপা হন নি।

মানুষের হাসি-কান্নাই শুধু নয়, ব্যাথা-বেদনা, আর্তনাদ-চিৎকার, অশ্রু সব কিছুর আড়ালেই মস্তিষ্কের চেতনা কাজ করছে, তবে এই সকল কোন কথাই আমার নয়, এগুলো বলে গেছেন যীশু খৃষ্টের জন্মেরও আরো ৪০০ বছর আগের চিকিৎসকরা কিন্তু তাঁদের সেই জ্ঞানটি সে কালের মানুষ গ্রহণ করেনি। তাদের মধ্য অনেকের বিশ্বাস ছিলো সকল হার্দিক অনুভূতির উৎস হলো হৃৎপিণ্ড, যার কম্পনের ফলেই বুকের মাঝে সকল অনুভুতির সৃষ্টি হয় এবং একথা সকল প্রেমিকমাত্রই দাবী করে থাকেন। প্রাচীন আসিরিয় ও ইহুদিরা বিশ্বাস করত যে লিভার বা যকৃত থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি।অবশ্য,প্রাচীন যুগে পর্যায়ক্রমে মানুষের প্রায় সকল প্রত্যঙ্গেই চেতনার উৎস বলে একসময়-না-একসময়ে মনে করা হতো তবে স্পষ্টত উত্তর আজও কেও দিতেন পারেন নি।

এই ভূতুড়ে মস্তিষ্কের চেতনা সম্পর্কিত জ্ঞান আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তবে এখনো উত্তরহীন প্রশ্ন হিসাবে রয়ে গেছে। যদিও ‘সায়েন্স অ্যাডভান্স’ এ প্রকাশিত নতুন গবেষণাটি (Human consciousness is supported by dynamic complex patterns of brain signal coordination নামে) মস্তিষ্কের যে নেটওয়ার্কগুলি কাজ করছে এর বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছে। তাছাড়া মস্তিষ্কের গুরুতর আঘাতের পরে রোগী “সচেতন” কিনা তা নির্ধারণ করা চিকিৎসক এবং পরিবার, উভয়েরই তাদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে কেননা আধুনিক মস্তিষ্কের ইমেজিং কৌশলগুলি এই অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলতে শুরু করেছে, যা আমাদের মানবিক চেতনায় অভূতপূর্ব অন্তর্দৃষ্টি দিতে বাধ্য করছে।

সচেতনতা আপাতদৃষ্টিতে হারিয়ে যায়, আবার পুনরুদ্ধার হয়, আমাদের ঘুমিয়ে পড়ে থেকে ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্ত। সচেতনতাকে ফার্মাকোলজিকাল এজেন্টদের দ্বারা বা আরও স্থায়ীভাবে মস্তিষ্কের আঘাতের মাধ্যমে ক্ষণস্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা যায়। সচেতন জাগ্রত হওয়া থেকে এই প্রতিটি প্রস্থান মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, আচরণ এবং স্নায়ুরসায়নে বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে আসে। তবুও, তারা সকলেই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ভাগ করে নিয়েছে: ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা প্রতিবেদনের অভাব।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে, “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” বা “প্রিফিউনিয়াস” সহ জটিল মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলি, যা অনেকগুলি উচ্চতর জ্ঞানীয় কার্যের জন্য দায়ী, সাধারণত সচেতন চিন্তায় জড়িত। তবে মস্তিষ্কের “বৃহত অঞ্চলগুলিও” অনেক কিছুই করে থাকে যেসকল কাজ সম্পর্কে আমরা এখনো অবগত নই সুতরাং বলা যেতে পারে নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের স্তরে মস্তিষ্কে “সচেতনতাকে” কীভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে তা এখনো সবার কাছে অপরিস্কারই রয়ে গেছে।

“মস্তিষ্কের চেতনা” নিয়ে অধ্যয়ন করা এত কঠিন হওয়ার পেছনে কারণ হল এগুলি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ এবং সহজে কোন কিছু এটিতে প্রবেশ করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দুইজন ব্যাক্তি দেয়ালে ঝুলছে এমন একই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি, তবে ছবিটি দেখার পরবর্তী অভিজ্ঞতা বা আমরা দুইজন কি অনুরূপ ভাবছি কিনা তা জানার কোনও উপায় নেই,যদি না দুইজনই সেই সম্পর্কে না বলি। কেবল সচেতন ব্যক্তিদেরই বিষয়গত অভিজ্ঞতা থাকতে পারে অতএব, কেউ সচেতন কিনা তা নির্ধারণের সর্বাধিক প্রত্যক্ষ উপায় হল তাদের সম্পর্কে আমাদের বলার জন্য জিজ্ঞাসা করা।

এই বিষয়গুলো এতো সূক্ষ্ম ও জটিল যে বিশ্বের শীর্ষ সাতটি দেশের বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের চেতনা নিয়ে একত্রে কাজ করেও এর কোন অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। তারা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনান্স ইমেজিং (এফএমআরআই) এর মাধ্যমে ১২৫ জন ব্যক্তির মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা করেছিলেন যাতে স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে জটিল ও তীক্ষ্ণ যোগাযোগ প্রদর্শন করেছিল আর দূর্বলদের মস্তিষ্কের বেলায় সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। জটিল যোগাযোগের ক্ষেত্রে যখন স্বাস্থ্যবান ব্যাক্তিদের চেতনানাশক দেয়া হত, তখন তাদের মধ্যে এই জটিল যোগাযোগের ধরণটি হারিয়ে যেত,কিন্তু কিভাবে এবং কেন? তার কোন যথোপযুক্ত উত্তর তারা দিতে পারেন নি।

বৈজ্ঞানিক ছাড়াও সমাজের বাইরের বিভিন্ন সংস্কৃতির দার্শনিকরাও এই “চেতনা” নামের গবেষণাক্ষেত্রটির সমস্যার সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা করেছেন কিন্তু সম্পুর্ণ সফল কেও হতে পারে নি এবং অদূর ভবিষ্যতে পারবেন কিনা সেই প্রশ্ন এই বিশাল মস্তিষ্ক ভান্ডারের কোন এক ছোট্ট কোটরে রেখে দেয়াই যেতে পারে।


তথ্যসূত্র:
1/ Human consciousness is supported by dynamic complex patterns of brain signal coordination
2/ Scientists identify brain patterns associated with consciousness
3/ Researchers Think They’ve Identified the Brain Pattern that Signals Consciousness
4/ How our brain generates consciousness — and loses it
5/ Consciousness: A Very Short Introduction (Susan jane blackmore)

লেখাটি 294-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 911 other subscribers