ধরা যাক আমরা পৃথিবীটাকে যেভাবে চিনি তা আগামীকালই ধ্বংস হয়ে যাবে। ধরা যাক, ভয়াবহ ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্ব-মহামারী ঘটে, কিংবা মহাকাশ থেকে গ্রহাণুর আঘাতে, অথবা নিউক্লিয়ার গণহত্যা দিয়ে বিশ্ববিপর্যয় ঘটবে। অধিকাংশ মানুষই হারিয়ে যাবে। ধ্বসে পড়বে আমাদের সভ্যতা। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যারা বেঁচে যাবেন, তারা নিজেদের আবিষ্কার করবেন ক্ষতবিক্ষত একটি পৃথিবীতে, পরিত্যক্ত নগরে, যেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো দস্যুরা জোড়জবরদস্তি-লুটপাট করছে দুর্বলদের।
শুনতে খারাপ শোনালেও এটাই কিন্তু মানবতার সমাপ্তি নয়। আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। আগে বা পড়ে হোক, ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি হয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরত আসবেই। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী স্থিতিশীল আকার ধারণ করবে। তারা তখন আবার গোড়া থেকে প্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করার যন্ত্রণাদায়ক কাজটি শুরু করবে। প্রশ্ন হলো: একটি সমাজ ঠিক কতদূর পর্যন্ত পুনর্গঠন করতে পারবে? ধ্বংসযজ্ঞ-পরবর্তী সমাজ কি প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতা পুনরায় গঠন করতে পারবে?
চলুন এই চিন্তন-পরীক্ষার ভিত্তিটি আরো সুনির্দিষ্ট করা যাক। এ মুহুর্তে আমরা সহজে নিষ্কাষণযোগ্য অশোধিত তেলের অধিকাংশই ব্যবহার করে ফেলেছি। ব্রিটেনের অধিকাংশ অগভীর কয়লা-খনি থেকে উত্তোলন করা শেষ। শিল্পভিত্তিক আধুনিক সভ্যতা সংগঠনের মূল কেন্দ্রে রয়েছে জীবাশ্ম-জ্বালানী। উন্নয়নের জন্যেও জীবাশ্ম-জ্বালানী গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংগঠন ও উন্নতি এ দুইটি কিন্তু বিষয় ভিন্ন। যদি আমরা কোনভাবে জীবাশ্ম-জ্বালানী ছাড়া চলতেও পারি (যেটা আমরা পারি না), তা থেকে ভিন্ন প্রশ্ন হলো আমরা এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছিয়েছি, জীবাশ্ম-জ্বালানী ছাড়া সেখানে আদৌ কখনো পৌঁছতে পারতাম কি না।
তাই প্রশ্ন হচ্ছে, জীবাশ্ম-জ্বালানীর মজুদবিহীন একটি গ্রহে কোন সমাজ কি শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে নতুন করে উন্নয়নের পথে যাত্রা করতে পারবে? অন্যভাবেও প্রশ্নটা বলা যায়। পৃথিবীতে যদি কখনোই ভূঅাভ্যন্তরীণ তেল বা কয়লার কোন মজুদ না থাকতো তাহলে কি হতো? তাহলে আমাদের উন্নয়ন কি আঠারোশ শতকের প্রাক-শিল্পায়নের অবস্থাতেই পড়ে থাকতো?
জীবাশ্ম-জ্বালানীর প্রতি আমাদের বর্তমান নির্ভরতা অবমূল্যায়ন করা সহজেই সম্ভব। দৈনন্দিন জীবনে এদের বহুল-দৃশ্যমান ব্যবহার হলো রাস্তায় চলমান যানবাহনে পেট্রোল বা ডিজেল ভরানো। আধুনিক জীবনযাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা দিয়ে পাওয়ার স্টেশন চালানোর উদাহরণ আসবে। তবে বিদ্যুৎ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনে নানা ধরনের শিল্প-উপকরণের উপর নির্ভর করি। ভূগর্ভ খুঁড়ে এসব পদার্থ খুঁজে বের করা কিংবা বিস্তৃত ভূমি হতে এদের সংগ্রহ করতে অধিকাংশ সময় উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। প্রচুর পরিমাণ তাপ শক্তি ছাড়া আপনি আকর গলিয়ে ধাতু সংগ্রহ করতে, কাঁচ তৈরি করতে, কংক্রিটের কাঁচামাল ঝলসাতে বা কৃত্রিম সার তৈরি করতে পারবেন না। এই তাপ শক্তির অধিকাংশই আসে কয়লা, গ্যাস ও তেল রূপে জীবাশ্ম-জ্বালানী থেকে।
বিষয়টি আসলে আরো জটিল। সভ্যতার চালু রাখতে কীটনাশক থেকে শুরু করে প্লাস্টিক ইত্যাদি বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যাপক পরিমাণে দরকার হয়। এদেরকে অপরিশোধিত তেলে উপস্থিত নানা ধরনের জৈবপদার্থ থেকে আহরণ করা হয়। পৃথিবীতে অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ খুব দ্রুত কমে আসছে। এ পরিস্থিতিতে বলা যায় অপরিশোধিত তেল পোড়ানোই হলো এর সবচেয়ে অপচয়কারী ব্যবহার। আমাদের উচিত মূল্যবান সব জৈব পদার্থের এ ভান্ডারটিকে সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা।
তবে আমাদের কি করা উচিত সেটা এ লেখাটির মূল বিষয় নয়। প্রায় সবাই জানেন যে আমাদের নিম্ন-কার্বন ব্যাবহারকারী অর্থনীতির দিকে যাওয়া উচিত। বরং আমি একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই যা মূলত তাত্ত্বিক (আশা করছি এটা তাত্ত্বিকই থাকবে)। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অগ্রসর কোন সভ্যতাকে কি জীবাশ্ম-জ্বালানী থেকে পাওয়া শক্তির সহজ সরবরাহের উপর নির্ভরশীল হতেই হবে? জীবাশ্ম-জ্বালানী ছাড়া কোন শিল্পায়িত সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব? উত্তর হলো: হয়তো সম্ভব – তবে তা হবে অত্যন্ত দুরূহ। চলুন দেখা যাক কেন।
একটা স্বাভাবিক ভাবনা দিয়ে শুরু করা যাক। জ্বালানীর অনেকগুলো বিকল্প প্রযুক্তি ইতিমধ্যে বেশ বিকশিত। যেমন আজকাল সৌরবিদ্যুৎ জ্বালানী হিসেবে বেশ ভালো বিকল্প। প্রতি বছর বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবনের ছাদে সৌরপ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছে। জীবাশ্ম-জ্বালানী শেষ হয়ে গেলেও সৌরপ্যানেল থেকে আমরা বিদ্যুৎ শক্তি পাবো। তাই এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সভ্যতা যে অবস্থায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, সেখান থেকেই নতুন সমাজ পুনরায় শুরু করতে পারবে। নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে সভ্যতার দ্বিতীয় সংস্করণ শুরু না করার কোন কারণই নেই – এরকমও মনে হবে।
সভ্যতা ধ্বসে পড়ার পর শুধু সৌরবিদ্যুতের উপর ভর করে নতুন সভ্যতা শুরু করা সম্ভব, কিন্তু খুব সঙ্কীর্ণভাবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীতে যদি আপনি নিজেকে টিকে যাওয়াদের মধ্যে আবিষ্কার করেন, তাহলে আপনি অনেকগুলো সৌরপ্যানেল দিয়ে জীবনযাত্রার মানকে বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎনির্ভর করে রাখতে পারববেন। সৌরপ্যানেলের আলোক-নির্ভর ভোল্টায়িক কোষের খুব একটা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আর তারা ভীষণ স্থিতিস্থাপক। তবে সময়ের সাথে সাথে এরাও একটু একটু করে নষ্ট হতে থাকে। প্যানেলের খাপের মধ্যে আর্দ্রতা প্রবেশ করে আর সূর্যালোক নিজেই উচ্চ-বিশুদ্ধতার সিলিকন স্তরকে নষ্ট করতে থাকে। প্রতিবছর সৌর-প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় এক শতাংশের মতো করে কমতে থাকে। তাই কয়েক প্রজন্ম পরে এসব উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সৌরপ্যানেলগুলো অকর্মণ্যতার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তখন কি হবে?
একেবারে শূণ্য থেকে নতুন সৌরপ্যানেল তৈরি তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। সৌর প্যানেল বানানো হয় সিলিকনের অতি-বিশুদ্ধ ফালি থেকে। যদিও সাধারণ বালিই হলো এর কাঁচামাল, কিন্তু বালিকে সুক্ষ্ম ও জটিল পদ্ধতি দিয়ে প্রক্রিয়াজাত ও বিশুদ্ধ করতে হয়। এ পদ্ধতিটি আজকের আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর ভিত্তিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তির সমতূল্য। এসব প্রক্রিয়া বিকশিত করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। আর পৃথিবী ধ্বংসের পর এসব প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করতেও সম্ভবত দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই প্রাক-শিল্পায়ন যুগের কোন সমাজ আলোক-ভোল্টাইক সৌরপ্যানেল তৈরিতে সক্ষম হবে না।
হয়তো তড়িৎ-শক্তি দিয়ে শুরু করাই সঠিক পথের যাত্রা ছিলো। আমাদের অধিকাংশ নবায়নযোগ্য-শক্তি প্রযুক্তি বিদ্যুৎ তৈরি করে। তবে আমাদের উন্নতির ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় তড়িতের প্রপঞ্চটি ১৮০০ শতকের প্রথম ভাগে আবিষ্কৃত হয়েছিলো। এটি কিন্তু বাষ্পীয়-ইঞ্জিনের প্রারম্ভিক অগ্রগতির অনেক পরে ঘটেছে। তখন ভারী-শিল্প ইতিমধ্যে দহন-নির্ভর মেশিনের উপর নির্ভরশীল ছিলো। তখন থেকেই প্রায় সব সময় ধরে নেয়া হতো যে আমাদের অর্থনৈতিক সংগঠনে বিদ্যুৎশক্তি কেবল সম্পূরক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এই অনুক্রম কি উল্টো হতে পারতো? শিল্পায়নের জন্য এমন কোন আবশ্যকীয় শর্ত আছে কি যে তাপীয় শক্তির বিকাশ অবশ্যই আগে হতে হবে?
প্রথম প্রথম মনে হতে পারে যে একটি উন্নয়নশীল সমাজের পক্ষে বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরি করে বায়ুকল (উইন্ডমিল) কিংবা জলচক্রের (ওয়াটারহুইল) সাথে যুক্ত করা অসম্ভব নয়। এমনকি তারা হয়তো পরবর্তীতে বায়ুচালিত টার্বাইন ও জলবিদ্যুতের বাঁধ নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, জীবাশ্ম-জ্বালানী বিহীন পৃথিবীতে কোন বিদ্যুৎ-নির্ভর সভ্যতা দহন-ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করতে পারবে। সে সভ্যতা হয়তো নিজেদের দূরযাত্রা ও শহুরে যাতায়াত ব্যবস্থা নির্মাণ করবে বৈদ্যুতিক ট্রেন ও ট্রামের মাধ্যমে। আমি বলেছি ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই’। আমরা সকল ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা দিয়ে কাজ করতে পারবো না।
যদিও যান্ত্রিক প্রয়োগের প্রয়োজনে কয়লা-পুড়ানো বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার বৈদ্যুতিক মটর দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যাবে। তবে আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, বৈদ্যুতিক মটর তৈরির করতে অনেকগুলো রাসায়নিক ও ভৌত রূপান্তরের প্রয়োজন হয়। এ রূপান্তরের জন্য সমাজকে তাপীয় শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। তাই শিল্পায়ন চালু থাকা অবস্থায় কোন দেশ কিভাবে ইস্পাত, লোহা, ইট, হামানদিস্তা, সিমেন্ট ও কাঁচ তৈরি করতে পারবে – যদি তাদের কয়লার ভান্ডারের অবলম্বন না থাকে?
হ্যাঁ, আপনি বিদ্যুৎ থেকে তাপ তৈরি করতে পারবেন। আমরা ইতিমধ্যে বৈদ্যুতিক ওভেন ও চুল্লী ব্যবহার করছি। আধুনিক বিদ্যুচ্চালিত আর্ক ফার্নেস ব্যবহৃত হচ্ছে ঢালাই লোহা তৈরি কিংবা ইস্পাত পুনঃব্যবহারের জন্য। এমন না যে আপনি কোন কিছু উত্তপ্ত করতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে বায়ু কিংবা পানি থেকে কেবল নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস ব্যবহার করে উচ্চতাপ তৈরি করা হলো চ্যালেঞ্জের কাজ।
উচ্চ-তাপ উৎপাদনের একটি বিকল্প হতে পারে সরাসরি সৌর-শক্তির ব্যবহার। আলোক-ভোল্টায়িক প্যানেলের উপর নির্ভর না করে বরং অনেকগুলি দৈত্যাকার আয়না দিয়ে নির্মিত একটি অবতল-কাঠামোর মাধ্যমে সূর্যের রশ্মি একটি ছোট স্থানে ফোকাস করা যায়। এভাবে ঘনীভূত তাপশক্তিকে কিছু রাসায়নিক বা শিল্প-প্রক্রিয়া চালানোর জন্য ব্যবহার করা যায়। কিংবা বাষ্প তৈরী করে জেনারেটরও চালানো যায়। তবুও লৌহ-গলানো ব্লাস্ট-ফার্নেসে যে পরিমাণ তাপ প্রয়োজন, এধরনের ব্যবস্থা দিয়ে তা উৎপন্ন করা খুবই কঠিন।
আধুনিক শিল্পের চাহিদা অনুসারে ধাতুকে উত্তপ্ত করে সাদা-আলো নিঃসরণ করার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অধিক পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয়। এজন্য কোন কিছু পুড়ানো ছাড়া অন্য কোন ভালো বিকল্প নেই।
তবে এর মানে এই নয় যে আমাদের একমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানীই পুড়াতে হবে।
বর্তমান আলোচনা থেকে একটু সরে গিয়ে আধুনিক শিল্পের প্রাক-ইতিহাস থেকে ঘুরে আসা যাক। ধাতু গলানোর জন্য কয়লা ব্যবহারের পূর্বে চারকোল ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। বহুদিক দিয়েই কয়লা থেকে চারকোল শ্রেয়তর। এটি পোড়ানোর সময় কয়লা থেকে বেশি উষ্ণ হয়। তাছাড়া এতে খাদের পরিমাণও অনেক কম। কয়লার খাদ শিল্প বিপ্লব ঘটার ক্ষেত্রে বড়সড়ো সমস্যা তৈরি করেছিলো। কয়লা দহনের সময় খাদগুলো বের হয়ে এসে উৎপাদিত পণ্য দূষিত করে দিতো। ধাতু গলনের সময় সালফার-দূষণ গলিত লোহার মধ্যে প্রবেশ করতো। ফলাফলে ধাতুটিকে ভঙুর হয়ে যেত এবং ব্যবহারের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়তো। অন্যদিকে, চারকোল এক্ষেত্রে ঠিকঠাক কাজ করতো।
তারপর আমরা চারকোল ব্যবহার করা বন্ধ করে দিলাম। পেছন ফিরে দেখতে গেলে এখন বিষয়টা দুঃখজনক মনে হবে। টেকসই উৎস থেকে আসা চারকোল পুড়ালে তা কার্বন-নিরপেক্ষ ছিলো। কারণ চারকোল বায়ুমণ্ডলে নতুন কোন কার্বন নিঃসরণ করে না। অবশ্য শিল্পযুগে শুরুর দিকে কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি বিবেচনা করার কথা ছিলো না।
চারকোল-ভিত্তিক শিল্প একেবারে হারিয়ে যায় নি। বরং তা ব্রাজিলে ভালোভাবেই টিকে আছে। ব্রাজিল পৃথিবীর বৃহত্তম চারকোল উৎপাদনকারী ও নবম-বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ। আমরা এখানে কোন ছোটখাটো কুটিরশিল্পের কথা বলছিনা – ইস্পাত উৎপাদন একটি ভারী শিল্প। জীবাশ্ম-জ্বালানী ব্যাতীত চারকোল হতে ভারী শিল্প চালানোর বিষয়টা আমাদের চলমান চিন্তন-পরীক্ষাটির জন্য ভীষণ উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ।
ব্রাজিলে চারকোল উৎপাদনে যেসব গাছ ব্যবহৃত হয় সেগুলো মূলত বিশেষভাবে আবাদ করা দ্রুত-বর্ধনশীল ইউক্যালিপ্টাস। চারকোল বানানোর প্রচলিত পদ্ধতি হলো শুকনো কাঠ কেটে গম্বুজ-আকৃতির ঢিবির মধ্যে স্তুপ করে রাখা। তারপর এই ঢিবিটি মাটি বা তৃণ-আচ্ছাদন দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হয় যাতে বায়ু-চলাচল সীমিত হয়ে যায়। এর মধ্যে থকা কাঠ খুব ধীরগতিতে কোন শিখা ছাড়াই জ্বলতে থাকে। ব্রাজিলের উদ্যোক্তারা এই পদ্ধতিটিকে শিল্প-পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য বড় আকারে নিয়ে গেছেন। শুকনো কাঠ সিলিন্ডার আকৃতির মোটা ভাঁটাতে স্তুপ করে রাখা হয়। এ ভাঁটাগুলো ইট বা পাথর দিয়ে গাঁথা হয় আর লম্বা সারিতে সাজানো থাকে যাতে এদেরকে সহজেই একের পর এক ভর্তি কিংবা খালাস করা যায়। চারকোল তৈরির বড় কারখানাতে শত শত ভাঁটা থাকতে পারে। ভর্তি হওয়ার পর ভাঁটাগুলোর প্রবেশমুখ বন্ধ করে উপর থেকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
চারকোল তৈরির মূল দক্ষতার বিষয় হলো নির্দিষ্ট পরিমাণের বাতাসকে ভাঁটার মধ্যে ঢুকতে দেয়া। বাতাসের কম-বেশী হওয়া যাবে না। এখানে দহনের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ তাপ তৈরি হতে হবে যা আর্দ্রতা ও উদ্বায়ী পদার্থদের তাড়িয়ে কাঠকে পাইরোলাইজ করে দেয় (পাইরোলাইসিস একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জৈবপদার্থ আংশিক জারণের মাধ্যমে কার্বন কিংবা কার্বন-সংবলিত অবশিষ্টে পরিণত হয়)। তবে তাপের পরিমাণ এতো বেশি হবে না যাতে সবকিছু ছাইয়ের স্তুপে পরিণত হয়। একজন রক্ষণাবেক্ষণকারী ভাটার উপর দিয়ে বের হওয়া ধোঁয়া দেখে মাধ্যমে এর মধ্যে দহনের দশা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রয়োজনে তিনি বাতাস বের হওয়ার জন্য গর্ত করেন কিংবা কাদা দিয়ে গর্ত বন্ধ করেন।
যারা অপেক্ষা করতে জানেন, ভালো ফলাফল তাদের কাছেই আসে। এই কাঠ পাইরোলাইসিস করতে এক সপ্তাহের সতর্কতার সাথে ধিকিধিকি আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হতে পারে। এই মূলনীতিটি হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই জ্বালানী যে কাজে ব্যবহৃত হয় তা আধুনিক। ব্রাজিলের এই চারকোলগুলো বন থেকে ট্রাকে করে দেশটির ব্লাস্ট-ফার্নেসে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সেগুলো ব্যবহৃত হয় আকরিক থেকে কাঁচালোহা তৈরিতে। ইস্পাত তৈরির মূল কাঁচামাল হলো কাঁচালোহা। ব্রাজিলিয় এই পণ্য চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে রপ্তানী করা হয় যেখানে এগুলো ট্রাক, সিঙ্ক, বাথটাব ও রান্নাঘরের যন্ত্রপাতিতে পরিণত হয়।
ব্রাজিলের দুই-তৃতীয়াংশ চারকোল আসে টেকসই-বনায়নের মাধ্যমে। আধুনিক এই প্রক্রিয়াকে তাই বলা হয় সবুজ-ইস্পাত। দুঃখজনক হলো বাকি এক-তৃতীয়াংশ আসে মূল-অরণ্যের বৃক্ষ কর্তনের মাধ্যমে, যা মোটেই টেকসই নয়। তারপরও ব্রাজিলের এই উদাহরণটি থেকে দেখা যায় যে জীবাশ্ম-জ্বালানীর উপর নির্ভর না করেও আধুনিক সভ্যতার দরকারী কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব।
আরেকটি অনুরূপ বিকল্প হতে পারে কাঠের বায়ুকরণ (গ্যাসিফিকেশন)। তাপ উৎপাদনের জন্য কাঠের ব্যবহার মানব-ইতিহাসের মতো প্রাচীন প্রক্রিয়া। সাধারণত কাঠ পোড়ালো এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শক্তি ব্যবহার করা যায়। বাকি শক্তি পোড়ানো-প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বাষ্প ও গ্যাসের সাথে বাতাসে হারিয়ে যায়। তবে উপযুক্ত পরিবেশে ধোঁয়াকেও ব্যবহার করা যায়। আমরা সেটাকেও হারাতে চাই না।
তাই সাধারণ প্রক্রিয়ায় কাঠ পোড়ানোর চেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো একে তাপীয়-ভাবে ভেঙে উৎপাদিত গ্যাস সংগ্রহ করা। একটি ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আপনি নিজেই এর কার্যনীতি বাস্তবে দেখতে পারবেন। জ্বলন্ত ম্যাচের শিখা কিন্তু কাঠিটিকে স্পর্শ করে না: বরং শিখাটি কাঠির সাথে সুস্পষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে নাচতে থাকে। ঘর্ষণজনিত তাপে কাঠিটির একাংশ ভেঙে গিয়ে যে উত্তপ্ত গ্যাস তৈরি করে তা ব্যবহার করেই শিখাটি নাচতে থাকে। এ গ্যাস কেবল বাতাসের অক্সিজেনের সাথে মিশেই প্রজ্জ্বলিত হয়। কাছ থেকে দেখলে অগ্নিশলাকা আসলেই একটা বিস্ময়কর জিনিস।
কাঠ থেকে গ্যাস নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বের করতে চাইলে একটি বদ্ধ পাত্রের মধ্যে কিছু কাঠ সেঁকতে হবে। ‘পাত্রটিতে অক্সিজেন ঢুকতে দেয়া হয় না যাতে কাঠে আগুন না ধরে যায়। কাঠের জটিল অণুগুলো পাইরোলাসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্লেষিত হয়। তারপর পাত্রের মেঝেতে পড়ে থাকে চারকোলের উত্তপ্ত-কার্বন-দলা। এটি তখন বিশ্লেষিত পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন ও কার্বন মনোঅক্সাইডের মতো অগ্নিদাহ্য গ্যাস তৈরি করে।
এভাবে তৈরি ‘উৎপাদক গ্যাস’ বেশ বহুমুখী জ্বালানী। এটিকে সংরক্ষণ করা যায়। অথবা পাইপ দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে তাপ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায়। রাস্তারও বাতি জ্বালানো যায়। এমনকি অভ্যন্তরীন-দহন ইঞ্জিনের মতো জটিল মেশিন চালানোর জন্যও বেশ উপযোগী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তেল সংকটের সময় এক-মিলিয়নেরও বেশি গাড়ি এভাবে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে চালিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক যাতায়াত-ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছিলো। শত্রু-অধিকৃত ডেনমার্কে সকল ট্রাক্টর, ট্রাক ও মাছ ধরার নৌকার পচানব্বই শতাংশ চলতো কাঠ-গ্যাস উৎপাদকের মাধ্যমে। তিন কিলোগ্রাম কাঠের শক্তির পরিমাণ এক লিটার পেট্রোলের সমরূপ (এটা নির্ভর করবে কাঠ কতটা শুকনো ও ঘন তার উপর)। এক গ্যালনে কত মাইল – এই পরিমাপের বদলে এক কিলোগ্রাম কাঠে কত মাইল হিসেবে কাঠ-গ্যাস উৎপাদক চালিত গাড়ির জ্বালানী ব্যয়ের হিসাব করা হয়। যুদ্ধকালীন গ্যাস-উৎপাদক প্রতি কিলোগ্রামে দেড় মাইল যেতে পারতো। অবশ্য গ্যাস-দাহকের আধুনিক নকশায় এ থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে।
তবে রাস্তায় গাড়ি চালানো ছাড়াও কাঠ-গ্যাস দিয়ে আপনি আরো বহু কিছুই করতে পারবেন। দেখা গেলো এই গ্যাসটি আমাদের চেনা যে কোন ধরনের তাপখেকো উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য উপযোগী, যেমন চুন, সিমেন্ট বা ইটের ভাঁটা। কাঠ-গ্যাস উৎপাদক দিয়ে সহজেই কৃষি বা শিল্পের যন্ত্রপাতি বা পাম্প চালানো যায়। টেকসই বন ও কৃষি-উচ্ছিষ্টাংশ ব্যবহার করে পাওয়ার স্টেশনের বাষ্প-টারবাইন পরিচালনায় শীর্ষে আছে সুইডেন ও ডেনমার্ক। এই বাষ্প তাদের ‘সম্মিলিত তাপ ও শক্তি’-র (Combined Heat and Power বা CHP) ইলেকট্রিসিটি প্লান্টে বিদ্যুৎ তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ার পর পাইপের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী লোকালয় ও শিল্প-কারখানায় চলে যায় উত্তাপ সরবরাহের জন্য। এরকম CHP স্টেশনগুলো শক্তি-নৈপুণ্যে নব্বুই শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। এ ধরণের প্লান্ট জীবাশ্ম-জ্বালানীর উপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। এটি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অসাধারণ দূরদৃষ্টির জন্ম দেয়।
এটাই তাহলে সমাধান? আমাদের নতুন করে শুরু করা সভ্যতা কাঠ দিয়ে চলবে? নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সম্পূরক বিদ্যুতের মাধ্যমে? হয়তো – যদি জনসংখ্যা যথেষ্ট কম হয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। এসব বিকল্প নিয়ে ভাবার সময় আমরা ধরেই নিচ্ছি যে আমাদের টিকে যাওয়া বংশধররা নিপূণ বাষ্প-ইঞ্জিন, CHP স্টেশন ও আভ্যন্তরীণ দাহক-ইঞ্জিন তৈরি করতে পারবে। আমরা জানি এগুলো কিভাবে তৈরি করতে হবে – কিন্তু যখন একটি সভ্যতা ধ্বসে পড়বে, কে বলতে পারে যে সেই জ্ঞানও তখন হারিয়ে যাবে না? আর যদি হারিয়েও যায়, আমাদের বংশধররা যে সেগুলো পুনঃনির্মাণ করতে পারবে তার সম্ভাবনাই বা কতটুকু?
আমাদের ইতিহাসে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রথম সফল ব্যবহার ছিলো কয়লা খনি থেকে পানি পাম্প করানোতে। এটা এমন একটা সময় ছিলো যখন জ্বালানী ছিলো প্রচুর। তাই প্রথম দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নকশা অপটু হলেও তা কোন সমস্যা ছিলো না। এসব খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা প্রথমে আকরিক থেকে লোহা গলানো এবং পরে কামারশালায় লোহার কাজে ব্যবহৃত হতো। লৌহ যন্ত্রাংশ পুনরায় বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরিতে ব্যবহৃত হতো, যা আবার খনি থেকে পাম্প করতে বা লৌহ ঢালাইয়ের ব্লাস্ট ফার্নেস চালাতে ব্যবহৃত হতো।ইঞ্জিনের কারখানায় এসব বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে আরো নতুন বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরির কাজে লাগানো হলো। প্রথম বাষ্প-ইঞ্জিন তৈরি হওয়ার পরপরেই ইঞ্জিনিয়াররা বাষ্পীয় ইঞ্জিনের কর্মদক্ষতা বাড়ানো ও জ্বালানী-চাহিদা কমানোর পথ খোঁজা শুরু করেন। তারা ইঞ্জিনের আকার ও ওজন কমানোর উপায় খুঁজে পান। তারা ইঞ্জিনগুলোকে পরিবহন ও কারখানার যন্ত্র চালানোর জন্য মানিয়ে নেয়া শুরু করেন। অন্যকথায়, শিল্পবিপ্লবের একদম শুরু থেকেই একটা ধনাত্মক-প্রতিক্রিয়া চক্র (Feedback loop) কাজ করছিলো: কয়লা – লোহা ও বাষ্প-ইঞ্জিনের উৎপাদন পরষ্পর-সমর্থক ছিলো।
খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা-বিহীন একটি পৃথিবীতে কি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উড়নচণ্ডে প্রোটোটাইপ (মডেল বা নমুনা) পরীক্ষা করার কোন সুযোগ পাওয়া যাবে? হয়তো এ প্রোটোটাইপগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিপক্ব হয়ে আরো দক্ষ হবে। আলাদা বয়লার ও সিলিন্ডার-পিস্টনের সরল বহিঃদহন-ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা দিয়ে শুরু না করে বরং তাপগতিবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, বলবিদ্যার পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করে আভ্যন্তরীন-দহন-ইঞ্জিনের সুচারুভাবে পারষ্পারিক-ক্রিয়া করা যন্ত্রাংশ তৈরি করা কোন সমাজের জন্য কতটা সম্ভব হবে?
আমাদের প্রযুক্তিকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে প্রচুর শক্তি খরচ করতে হয়েছে। এ কাজটি পুনরায় করতে সম্ভবতঃ আবারো প্রচুর শক্তি খরচ করতে হবে। জীবাশ্ম-জ্বালানীর কথা বাদ। তার মানে আমাদের ভবিষ্যত সমাজে প্রচুর পরিমাণ কাঠের দরকার হবে।
যুক্তরাজ্যের মতো নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে এক-একর জমিতে প্রশস্ত পাতাসম্পন্ন গাছ থেকে প্রতিবছর চার-পাঁচ টন জৈবজ্বালানী উৎপন্ন হয়। আপনি যদি উইলো বা মিসক্যান্থ ঘাসের মতো দ্রুত-বর্ধনশীল গাছ চাষ করেন তাহলে এই সংখ্যাটাকে চারগুণ বাড়ানো সম্ভব। সর্বোচ্চ কাঠ উৎপাদনের পদ্ধতি হলো নিয়মিত ছাঁটাই করা। অ্যাশ ও উইলোর মতো গাছ ছাঁটাই করার পর এর মূড়া আবার পল্লবিত হবে (মূড়া হলো কর্তিত বৃক্ষের ভূমিস্থ অধোভাগ)। এরপর পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে তা কাঠ সংগ্রহের অবস্থায় পৌঁছে যাবে। এভাবে আপনি বন উজাড় না করেই কাঠের টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবেন। চারপাশ বৃক্ষশূণ্য হয়ে শক্তি-সংকটে ভোগার সম্ভাবনাও থাকবে না।
তবে বিষয়টা হলো: প্রাক-শিল্প ব্রিটেনে গাছ ছঁটাইকরণ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সুবিকশিত ছিলো। কিন্তু এর পক্ষে তখনকার উঠতি বুর্জোয়া সমাজের সকল শক্তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় নি। বনভূমি সুসংগঠিত হলেও তা অন্যান্য ভূমি-ব্যবহারের সাথে (মূলত কৃষিকাজ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতো – এটাই ছিলো মূল সমস্যা। উন্নয়নের শাঁখের করাত হলো যে সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহের জন্য তার আরো বেশি সংখ্যক কৃষিজমির প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি বর্ধিত শক্তিচাহিদার জন্য কাঠের বর্ধিত উৎপাদন দরকার হয়। তখন একই জমির জন্য এই দুই প্রয়োজন পরস্পর প্রতিযোগিতা করে।
অতীতেও এই শাঁখের করাত কিভাবে কাজ করছে তা আমরা জানি। ষোল’শ শতকের মধ্য থেকে ব্রিটেন এসব বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কয়লাখনির ব্যবহার বাড়িয়ে দিলো। এতে কৃষির উৎপাদন না কমিয়েও ভূমিতল থেকে প্রাচীন বনের শক্তি কাজে লাগালো তারা। এক হেক্টর গাছ-ছাঁটাই করে এক বছরে যে শক্তি পাওয়া যায়, সমান শক্তি পাঁচ থেকে দশ টন কয়লা থেকে পাওয়া যায়। আর বনভূমি পুনরায় পল্লবিত হওয়ার জন্য অপেক্ষার চাইতে কয়লা অনেক তাড়াতাড়ি ভূমিতল থেকে তোলা সম্ভব।
জীবাশ্ম জ্বালানীর সহজ উৎস ছাড়াই শিল্পায়িত হতে চাইলে তাপীয়-শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। ধ্বংসযজ্ঞ পরবর্তী পরিস্থিতিতেও এটি সত্য। জীবাশ্ম-জ্বালানী ব্যবহার না করা বিপরীত-বাস্তবতার পৃথিবীতেও এটি সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে কোন সমাজে শিল্পায়িত হতে হলে তার কিছু অনুকূল ও সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকতে হবে। এধরনের পরিবেশের উদাহরণ আঠারো’শ শতকের কয়লা-দ্বীপ ব্রিটেন নয় বরং স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা কানাডার অঞ্চল, যেখানে দ্রুত-প্রবাহী জলধারা থেকে জলবিদ্যুৎ শক্তি ও বিরাট এলাকার বনবাদাড় সম্মিলিত করে পরিবেশবান্ধব তাপ-শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব।
তবুও কয়লা-বিহীন শিল্পবিপ্লব খুব কঠিন হবে। বর্তমানে জীবাশ্ম-জ্বালানীর ব্যবহার বেড়েই চলছে। এটি একাধিক কারণে দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণগুলো এখানে উল্লেখ করলে ক্লিশে শোনাবে। নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির দিকে ধাবিত হওয়া জরুরী। তবে আমাদের এটাও বোঝা উচিত আমাদের এ পর্যায়ে পৌঁছতে তাপীয় শক্তির জীবাশ্ম-ভান্ডার কতটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছে। হয়তো আমরা অন্য কোন কঠিন পথ ধরে এ পর্যায়ে আসতে পারতাম। হয়তো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ও জৈবভরের (বায়োমাস) টেকসই ব্যবহারের সহযোগীতায় কোন ধীর-দহন প্রক্রিয়া দিয়ে যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন ধাপ পরিচালনা করা সম্ভব। আবার, এটা সম্ভব নাও হতে পারে। আমরা বরং আশা রাখি, যে কোন উপায়েই আমরা নিজেদের সভ্যতার ভবিষ্যত নিরাপদ রাখতে পারবো। হয়তো আমরা যে পথে উন্নয়ন করেছিলাম, নতুন কোন সভ্যতা দ্বারা সে পথটি অনুসরণ করার সকল সুযোগ আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি।
লুইস ডার্টনেল ইউনিভার্সিটি অব লেসিস্টারে যুক্তরাজ্য স্পেস এজেন্সি রিসার্চ ফেলো। তিনি জ্যোতির্জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন। মঙ্গলে প্রাণের উপস্থিতি অনুসন্ধান করেন তিনি। তাঁর সাম্প্রতিক বই The Knowledge: How to Rebuild Our World from Scratch (২০১৪)। Aeon-এ প্রকাশিত মূল লেখা Out of the ashes। অনুবাদটি আমার বই প্রাণের বিজ্ঞান: সাম্প্রতিক জীববিজ্ঞানের ভাবনা ভাষান্তর (২০১৭) থেকে নেয়া।
Leave a Reply