আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কত কিছুই না করি। তার মধ্যেই ফুরসত পেলেই ফোনের প্লে-লিস্ট থেকে গান শুনি। শত কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও খানিক অবসরে, আয়েশ খুঁজি গান শোনায়। কারো কারো ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে বেশির ভাগ মানুষ বোধহয় গান শোনার দলেই। মন ভালো থাকলে গান শোনা, মন খারাপ থাকলে গান শোনা- এইসব কিছু দারুণভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মস্তিষ্কের মাধ্যমে। সংগীতের প্রভাব মস্তিষ্কে বিস্ময়কর।
অনেকে আছে, গান গাইতে পছন্দ করে। আবার অনেকে গান গাওয়ার চাইতে শুনতে বেশি স্বস্তি পান। আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়ে চলছে। সহজ কথায় প্লাস্টিকের মত আচরণ করে। তাই এই বৈশিষ্ট্যকে মস্তিষ্কের নমনীয়তা (neural plasticity) বলে। গান শোনা বা গাওয়ার ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হয়ে থাকে। গানের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য একদল গবেষক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (MRI) যন্ত্রে মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা পরিমাপ করেন। এই গবেষণার জন্য একজন মৃত দক্ষ সংগীতজ্ঞের মস্তিষ্ক নেন। দেখা যায় যে, মস্তিষ্কের কিছু অংশ বিশেষভাবে পরিবর্তিত, স্বাভাবিক মানুষের তুলনায়। সেগুলো হলোঃ-
- অডিটরি (Auditory)- যা শোনার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ভিজ্যুয়াল(visual) – যা দেখার জন্য অংশ নেয়।
- মোটর (motor)- যা চলাচলে ভূমিকা রাখে।
এই অংশগুলোর বিশেষায়িত পরিবর্তন শুধুমাত্র মস্তিষ্কের আকার বাড়ার সাথেই নয় এমনকি কাজের ক্ষেত্রেও সমান তালে ভূমিকা রাখে।
বিজ্ঞানের মতে , সংগীত জীবনে শুধুমাত্র বিনোদনের অংশ নয় বরং তার চেয়েও বেশি কিছু।
গান শোনা বা গাওয়ার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া
- অডিটরি- মস্তিষ্কের এই অংশ সুরকে প্রক্রিয়া করে সংগীত শেখার পর। মানুষ খুব সহজে তখন সুরের ফ্রিকোয়েন্সির (frequency) তফাত ধরতে পারে- যা স্বাভাবিক কথা থেকে আলাদা। যারা গান শেখে তাদের যেমন হয়, যারা গান শোনে তাদেরও ঠিক তেমন।
- মোটর- এই অংশ সংগীতের সাথে সম্পর্কিত পেশীর, বিভিন্ন অঙ্গ যেমন -আঙুল,মুখ ইতাদির আকৃতি বৃদ্ধি এবং চলাচলে ভূমিকা রাখে। অধিক সংখ্যক নিউরণ এইসব অংশে জড়িয়ে থাকে বিধায় পেশীদের মসৃণভাবে চলাচল সহজ হয়ে থাকে।
- পড়া (Reading) – গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের পড়ার দক্ষতা ভালো তাদের সংগীতের সাথে যোগসূত্র আছে। ব্যাপারটা এমন, যে খুব দ্রুত পড়তে পারে সে খুব সহজে গানের সুরকে অক্ষরে রুপান্তরিত করে ফেলে মস্তিষ্কে।
গান শ্রবণেন্দ্রিয়ের বেশ অনেকগুলো অংশে পৌঁছাতে পারে- যা অন্যান্য সংবেদন অঙ্গের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আচ্ছা ধরুন, আপনাকে আপনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়কাল মনে করতে বলা হলো। তারপর বলা হলো, বলুন তো ‘ ক ‘ বর্ণের চার অক্ষর পরের বর্ণ কোনটা? অধিকাংশ ব্যক্তি কিন্তু গানের একটা সুর খুঁজে পাবেন। কেননা ছোটবেলায় আমরা অনেকেই তখন সুরের মত করে বর্ণমালা শিখেছি। এই প্রক্রিয়া একি সাথে শিখনকে যেমন আনন্দদায়ক করে তুলেছিল।
একটু খেয়াল করলে চারপাশে দেখবেন, অনেকেই কিন্তু পড়াশোনার সময় ক্ষীণ শব্দে গান বাজিয়ে থাকে। এর পেছনের যুক্তি বিস্ময়কর। যেহেতু গানের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের অনেক সংবেদন অঙ্গ জড়িত তাই খুব সহজে পড়া আত্মস্থ হয়।
একটা মজার ব্যাপার শেয়ার করাই যায় এ প্রসঙ্গে। এই নিবন্ধের তথ্য সংগ্রহ এবং লিখার সময় আমার কক্ষে কিন্তু গান বাজছে। তাই আমার এই কাজটি করতে তেমন কষ্ট লাগছে না।একঘেয়েমি ভাব আসছে না। বিরক্তি আসছে না কাজে।
যখন কেউ গান শিখতে চেষ্টা করে তখন তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গাণু সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তার মধ্যে দর্শন, শ্রবণ,স্পর্শ, পেশী সংকোচন-প্রসারণ, এবং সঠিক অনুপাতে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখা। দুটো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চমৎকারভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়া যায়। আসুন, জেনে নেই ঝটপট।
প্রথমত, যখন আপনি গান শিখতে শুরু করেন তখন সকল ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে। উদাহরণ দিয়ে বললে – যখন আপনি একটি বাদ্যযন্ত্র হাতে নেন, তা বাজানোর সময় শুনেন, নোট বইতে সুরের তাল দেখেন। তিনটি ঘটনাই কিন্তু ধাপে ধাপে ঘটে থাকে। এরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এসে মস্তিষ্কে আঘাত হানে। মস্তিষ্ক হচ্ছেন মাস্টারমশাই। তিনি এদের মধ্যে জোড়া দিতে শুরু করেন। সামঞ্জস্য তৈরী করে ফেলেন খুব তাড়াতাড়ি। এসব ক্ষেত্রে নিউরণ ভূমিকা রাখে।
দ্বিতীয়ত, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ক্ষেত্রে সুরের তারতম্য ঘটে। সময়ের সাথে সাথে সুরের উর্ধ্বগতি এবং নিম্নগতি হয়। এইসব কিন্তু মস্তিষ্কে গিয়ে এক লাইনে সংঘবদ্ধ হয়। উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করা যাক – ধরুন, একজন গিটারিস্ট একটি গানের কনসার্টে বাজাচ্ছে। একেক গানে একেক রকম সুর। ভিন্নতা আছে প্রতিটি গানে। তাকে সেই অনুপাতে বাজাতে হয়। কোন কোন গানে দেখবেন প্রথমে অধিক ছন্দ, মাঝে কম ছন্দ,শেষে গিয়ে আবার ছন্দের আধিক্য। তাই গিটারিস্টকে প্রতিটা গানের ক্ষেত্রে কিন্তু মনোযোগ দিয়ে বাজাতে হয়। একটু বেখেয়ালি হলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।
%22%20transform%3D%22translate(1.5%201.5)%20scale(2.98828)%22%20fill-opacity%3D%22.5%22%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23b49da4%22%20cx%3D%2287%22%20cy%3D%2261%22%20rx%3D%2264%22%20ry%3D%2264%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23fff%22%20cx%3D%22232%22%20cy%3D%2263%22%20rx%3D%2264%22%20ry%3D%22253%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23ed759c%22%20cx%3D%2240%22%20cy%3D%2274%22%20rx%3D%2237%22%20ry%3D%2237%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23f5fdfa%22%20rx%3D%221%22%20ry%3D%221%22%20transform%3D%22rotate(-96.3%2062.3%2063.1)%20scale(18.0246%20102.20831)%22%2F%3E%3C%2Fg%3E%3C%2Fsvg%3E)
চিত্রঃ- গান যেভাবে সংবেদন অংশদের সক্রিয় করে তুলে।
গান যেভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে
কোথাও গান বাজছে বা আপনিই গান বাজালেন কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই নিজের মধ্যে! এমনটা হয়ছে কখনো? গান বাজানো বা শোনার ক্ষেত্রে প্রায় সবাই দেখবেন মাথা নাড়ায়, পা দোলায়, আঙুল নাড়াচাড়া করে থাকে। আন্দোলিত হতে থাকে। কখনো প্রকাশ করে ,কখনো করে না। একদম ভাবাবেগ আসে না গানের ক্ষেত্রে- এমন মানুষ বোধ করি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গানের সুর আপনার হৃদয়ের স্পন্দনকে (heart bit) প্রভাবিত করে। কোথাও আড্ডা হচ্ছে আর গান হচ্ছে না এমন মেলা ভার। আড্ডার সময়ে গান নিজেদের মধ্যে ভাব-আন্তরিকতা বাড়িয়ে দেয়।
ধরুন, আপনার মন বেশ ফুরফুরে তখন আপনি সেই মেজাজে কেমন গান পছন্দ করবেন? নিশ্চয়ই ফুরফুরে আনন্দদায়ক গান। আপনার মেজাজ আরো সতেজতায় ভরে যাবে।
আবার ধরুন, আপনার মন অনেক খারাপ। তখন আপনি কিন্তু দুঃখী সুরের ঠান্ডা মেজাজের গান শুনতে পছন্দ করবেন। মনে হবে সেই গানের সুরে নিজের দুঃখ উড়োউড়ি করছে মেঘের মতো মনের আকাশে। বিচ্ছিন্নতার সুরে নিজেকে আন্দোলিত করে আপনি প্রাণের আয়ু খুঁজবেন। বিরহের গান মস্তিষ্কে পূর্বের কৃতকর্মের কথা মনে করায়, অনুশোচনা বোধ জাগায়। এক কথায় নেগেটিভ একটা ধারণার ভিত্তিকে শক্তপোক্ত করে তোলে। খেয়াল করলে দেখবেন, অনেকে ব্যায়াম করার সময় উদ্দীপনাদায়ক গান শুনে থাকে। সেই গানগুলো তাদের আরো পরিশ্রম করতে, ব্যায়ামের কষ্ট সহ্য করতে মনোবল বাড়ায়।
সংগীত আজকাল চিকিৎসায় মানসিক থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা দেখেন, জটিল অস্ত্রোপাচারের পূর্বে যদি রোগীকে তার পছন্দের গান শুনতে দেয়া হয় তবে তার কষ্ট কম লাঘব হয়। রোগী কম শঙ্কিত থাকে। তার মনোবল বাড়িয়ে সুস্থতায়ও ভূমিকা রাখে তাড়াতাড়ি।
সংগীত ডিপ্রেশন কমাতে, মানসিক চাপ কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে। আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে দেয়।
গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সংগীত শরীরে এক ধরনের সুইচ বা ট্রিগার (trigger) হিসেবে কাজ করে। আর এই সুইচ ডোপামিন (Dopamine) হরমোনের প্লাবন ঘটায়। মস্তিষ্কের পুরস্কার হিসেবে সাধারণত ডোপামিন হরমোন নিঃসরিত হয়। আচ্ছা, উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক-
ধরুন, আপনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। জীবনের গতিপথে মোটামুটি স্থির হয়েছেন পথিক হিসেবে। এই সময়ে একদিন হুট করে একটা গান শুনলেন। যে গান অনেক বছর শোনেননি। হতে পারে বয়ঃসন্ধিকালের বা ছোটবেলার। আচ্ছা, বয়ঃসন্ধিকাল যেহেতু কাছাকাছি সময় তাই সেটাই ধরা যাক। সেই গান হতে পারে আপনার তখনকার প্রেমের ভরা মৌসুমকার অথবা সম্পর্কের বিচ্ছেদকালের। গানটা শোনার সাথে আপনার তখনকার স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। যদি সুখের ঘটনা হয় তবে হঠাৎ সুখের আন্দোলন অনুভব করবেন শরীরে। আর যদি দুঃখের হয়, তবে বিষাদের ছায়া নেমে আসবে। গান অটোমেটিক ভাবে ট্রিগার হিসেবে কাজ করে স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই ব্যাপারটায় মস্তিষ্কের অসংখ্য নিউরণের সংযোগ লাইন জড়িত। নিউরণের সংযোগক্রিয়ায় হরমোনের নিঃসরণ তড়িৎগতিতে ঘটে থাকে। ফলশ্রুতিতে সুখ বা দুঃখ অনুভব হয়ে থাকে। গান একি সাথে আপনার স্মৃতি শক্তিকে শাণিত করে তোলে। গান হচ্ছে চিত্তের নির্মল বিনোদনের খোরাক।
%22%20transform%3D%22translate(.6%20.6)%20scale(1.16797)%22%20fill-opacity%3D%22.5%22%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%238b80c4%22%20cx%3D%2247%22%20cy%3D%2267%22%20rx%3D%2243%22%20ry%3D%2235%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%238a7fc3%22%20rx%3D%221%22%20ry%3D%221%22%20transform%3D%22matrix(-19.21247%20-20.1047%2024.01646%20-22.95063%20169%2059.3)%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23c8bdff%22%20rx%3D%221%22%20ry%3D%221%22%20transform%3D%22rotate(172.8%2060.1%2073.5)%20scale(253.21935%2046.06441)%22%2F%3E%3Cellipse%20fill%3D%22%23c8bdff%22%20cx%3D%2278%22%20cy%3D%2212%22%20rx%3D%22231%22%20ry%3D%2217%22%2F%3E%3C%2Fg%3E%3C%2Fsvg%3E)
ছবিসূত্র- livehappy.com
জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সংগীত
আপনার যেরকম সংগীত পছন্দ, অন্য মানুষের কিন্তু সেরকম পছন্দ না। একি জীবনধারণ করা সব মানুষ একই রকম সংগীত পছন্দ করে না। সংগীত আপনার রুচি এবং ব্যক্তিত্বের ও বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। খানিকটা বিশ্বাস দুলে উঠতে পারে এটা পড়ার পর। জানি! আসুন, একটু ব্যাখ্যাটা জেনে নিন। ধরুন,আপনি রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন বা ঠান্ডা মেজাজের গান। আবার আপনার বন্ধু পছন্দ করে ব্যান্ডের হেভি মেটালিক গান। আপনার কাছে সে যদি বলে ব্যান্ডের গান দারুণ তখন আপনার খটকা লাগবে! আদৌ ভাল লাগে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ জাগবে। বিপরীতভাবে আপনার বন্ধু ও কিন্তু একই রকম ধারণা করবে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, যারা অন্তর্মুখী স্বভাবের তারা ঠান্ডা মেজাজের গান বেশি শুনে থাকে।
সংগীত একটা দেশ ও জাতির স্বতন্ত্রতা বজায় রাখে। গানের মাধ্যমে সে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ফুটে উঠে। আন্তর্জাতিক খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় দেখবেন অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে সে দেশের জাতীয় গান বা গানের সুর বাজানো হয়। খুব সহজে সে দেশকে পরিচিত করে তোলা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আবহমানকাল ধরে কিছু লোকগান প্রচলিত। এসব গানের অনেকখানিই পুঁথিগত ও করা হয়নি। তবুও মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে শুনে শুনে গেয়ে চলেছে। উৎসব, বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বচ্ছন্দ্যে গেয়ে উঠে সেসব গান। নিজেদের আনন্দ-দুঃখের প্রকাশ ঘটায় গানের সুরে। ব্যক্তির না বলা কথারা প্রাণ পায় গানের সুরে। মানসিক চাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে উঠে মস্তিষ্কের নিউরণ-জালিকা।
তথ্যসূত্র-
১। Music and Learning: Does Music Make You Smarter?
২।How Does Music Affect Your Mood? | Music and Emotion Relationship










Leave a Reply