একবার ভেবে দেখুন তো আপনার হাতের প্লাস্টিক এর বোতলটা থেকে যদি ভ্যানিলা আইসক্রিম বানিয়ে ফেলা যায় তবে কেমন হবে?
বেশ কয়েক বছর আগের কথা, ফেরিওয়ালারা ফেরি করে শোনপাপড়ি নামক এক খাবার বিক্রি করত যা বাচ্চাদের খুবই প্রিয় ছিল। তখন তাঁরা পরিত্যাক্ত কাঁচের বা প্লাস্টিকের বোতলের বিনিময়ও শোনপাপড়ি দিয়ে থাকত। সেই বোতল গুলো হয়ত পরে কোনভাবে পুনর্ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সেই পরিত্যাক্ত বোতলটি থেকেই যে আপনার পছন্দের ভ্যানিলা আইসক্রিম তৈরি হতে পারে, এটাও কি সম্ভব? হ্যাঁ অদূর ভবিষ্যতে এটাও সম্ভব।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমন একটি উপায় বের করেছেন যার দ্বারা প্লাস্টিক থেকে ভ্যানিলা ফ্লেভার তৈরি করা সম্ভব। এতে করে সবরকম বর্জ্য ও পরিত্যাক্ত প্লাস্টিককে কাজে লাগিয়ে ভ্যানিলা তৈরি করা যেতে পারে যা পরবর্তীতে আইসক্রিম সহ অন্যান্য খাদ্য প্রস্তুত কাজে ব্যবহার করা যাবে। সেই সাথে পরিবেশকেও দূষণ থেকে রক্ষা করা যাবে।
ভ্যানিলার বেশিরভাগ গন্ধ এবং স্বাদ বহন করে থাকে ভ্যানিলিন নামক একটি যৌগ, যা প্রাকৃতিকভাবে ভ্যানিলা বিন থেকে বের করা যায় বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যেতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৮৫% ভ্যানিলিন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পাওয়া রাসায়নিক দ্রব্য থেকে তৈরি হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরণের খাবার, কসমেটিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, পরিষ্কারের এবং ভেষজনাশক পণ্যগুলিতে সাধারনত ভ্যানিলিন ব্যবহার হয় এছাড়াও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার ও চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গ্রিন কেমিস্ট্রি জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে, ভ্যানিলিনের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ছিল প্রায় ৩৭,০০০ মেট্রিক টন, এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ৫৯,০০০ মেট্রিক টন এ পৌঁছাবে। বর্তমানে ভ্যানিলিনের চাহিদা, ভ্যানিলা বিনের সরবরাহের মাত্রা ছাড়িয়ে অনেক বেশি। তাই এখন কৃত্রিমভাবে ভ্যানিলিন তৈরির আশ্রয় নিতে হয়েছে।
নতুন গবেষণার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন একটি অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা দ্বারা প্লাস্টিকের বর্জ্যকে ভ্যানিলিনে রূপান্তর করা যেতে পারে। এতে করে ভ্যানিলিনের সরবরাহ যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি পরিবেশে প্লাস্টিকের দূষণ হ্রাস পাবে। একই সাথে উভয় সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে কীভাবে পলিথিলিন টেরেফথ্যালেট থেকে তৈরি প্লাস্টিকের বোতলগুলোকে ভেঙ্গে টেরেফথালিক অ্যাসিডে রূপান্তর করা যায়। এই টেরেফথালিক অ্যাসিড হচ্ছে তাদের মৌলিক একক। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গের দুজন গবেষক তাদের নতুন এক গবেষণায় জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ই. কোলাই নামক একটি ব্যাকটেরিয়াকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন যে এটি টেরেফথালিক অ্যাসিডকে ভ্যানিলিনে রূপান্তর করতে সক্ষম। তার জন্য এই ব্যাকটেরিয়াকে খুব বেশি কিছুও করতে হয় না। টেরেফথালিক অ্যাসিড এবং ভ্যানিলিন এই দুইটি যৌগের রাসায়নিক গঠনে অনেকটাই মিল রয়েছে। এই নতুন ব্যাকটেরিয়াটির কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র টেরেফথালিক অ্যাসিডের কার্বন কাঠামোতে যুক্ত থাকা কিছু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুগুলোর পরিবর্তন করা। ব্যাস! তাতেই টেরেফথালিক অ্যাসিড রূপান্তরিত হয়ে যায় ভ্যানিলিনে। গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, গবেষকদের জিন প্রকৌশল করা এই ব্যাকটেরিয়াকে টেরেফথালিক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশিয়ে একদিনের জন্য ৩৭°সে বা ৯৮.৬° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রেখে দিলে এটি প্রায় ৭৯% টেরেফথালিক অ্যাসিডকে ভ্যানিলিনে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। ব্যাপারটি আসলেই খুব চমকপ্রদ এবং খুব আনন্দের। কেন না, চারিদিকে প্লাস্টিকের দূষণ যে পরিমাণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা মানবজাতির জন্য বড় একটি দুঃসংবাদ। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি এভারেস্টের চূড়াতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যার অধিকাংশই মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বর্জ্য।
সারাবিশ্বে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলোর খুব কম সংখ্যক পুনর্ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই গবেষণার একজন গবেষক দাবি করেন যে, এই আবিষ্কারটি প্লাস্টিক দূষণের সমস্যাটির একটি দারুন সমাধান হতে পারে এবং সেই সাথে কার্বনের নতুন একটি উৎস হতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ Scientists convert plastic waste into vanilla flavoring
Leave a Reply