উদ্ভিদ জগতের সবচাইতে দীর্ঘজীবী পাতার সন্ধান মেলবে দক্ষিণ অ্যাংগোলা এবং উত্তর নামিবিয়ার সীমান্তে একটি কর্কশ, রুক্ষ মরুভূমিতে। মরুভূমি চির অসবুজ বলেই আমরা জানি কিন্তু নামিবিয়া মরুভূমি যেখানে কিনা প্রতি বছরে একবার দুই ইঞ্চির থেকে কম বৃষ্টিপাত হয় সেটিই “ওয়েলভিটসিয়া”- এর বাসভূমি। আফ্রিকানদের কাছে উদ্ভিদটি “টুইব্লারকেনিডুড” নামে পরিচিত। এর ভাবার্থ হচ্ছে “দুটি পাতা যা কখনো মারা যায় না”। এই রকম নামের পেছনে কারণ হল এই উদ্ভিদ দুটো পাতা নিয়ে জন্মায় এবং দুটো পাতা নিয়েই বাড়তে থাকে। আর এই বৃদ্ধি সহস্রাব্দ বছর ধরে চলতে পারে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2021/08/index-1.jpg?resize=274%2C184&ssl=1)
ছবিটি ওয়েলভিটসিয়া মিরাবালিস এর। ওয়েলভিটসিয়া মূলত একটি গণ।
লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ জিনতত্ত্ববিদ অ্যান্ড্রো লিচ বলেন, “ বেশীরভাগ উদ্ভিদেরই বিকাশ শুরু হয় একটা পাতা দিয়ে। কিন্তু এই উদ্ভিদ এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষনীয়। তাছাড়া এটি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে এবং বাড়তে থাকে। এর বৃদ্ধি থেমে যাওয়া মানে বোঝতে হবে এটি মারা গেছে”। এগুলোর মধ্যে কোন কোনটা, সেই লৌহ যুগ যখন কিনা ফিনিশিয়ান বর্ণমালা আবিষ্কৃত হয় এবং ডেভিড কে ইসরাইলের রাজমুকুট পড়ানো হয়, তখন থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে। এদেরও দুটো পাতা নিয়ে জীবন শুরু হয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত সেই দুটো পাতা নিয়েই বৃদ্ধিরত অবস্থায় টিকে আছে।
“ওয়েলভিটসিয়া” দেখতে খুব যে নান্দনিক তা কিন্তু না। এর আঁশাল দুটো পাতা, মরুভূমির শুকনা বাতাসে দোলতে থাকে এবং তৃষ্ণার্ত প্রাণীদের আহারের বস্তু হয়। ধীরে ধীরে পাতাগুলো কুঁচকে যেতে থাকে যা ওয়েলভিটসিয়া কে একটা অক্টোপাস এর চেহারা দেয়। ১৯ শতকে লন্ডনের কিউ গার্ডেন এর পরিচালক ওয়েলভিটসিয়া কে নিয়ে মন্তব্য করেন, “এটি তার দেশে আনা সবচাইতে অদ্ভুত এবং সবচাইতে কুৎসিত উদ্ভিদ”। কিন্তু এই উদ্ভিদটি আবিষ্কৃত হবার সময় থেকে জীববিজ্ঞানীদের বরাবরের মতো চমৎকৃত করে যাচ্ছে। বিবর্তনবাদের জনক মহামতি চার্লস ডারউইন এবং উদ্ভিদবিদ ফ্রেডেরিখ ওয়েলভিটস এদের মধ্যে অন্যতম। মূলত ফ্রেডেরিখ ওয়েলভিটস এর নামেই উদ্ভিদটির এমন নামকরণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, ১৮৫৯ সালে যখন ওয়েলভিটস প্রথম এই উদ্ভিদের কাছে আসেন তখন তিনি তপ্ত মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেন এবং গাছটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, অর্ধেক ভয়ে পাছে একটা স্পর্শ যেন এটাকে কল্পনার প্রতীক প্রমাণ করে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2021/08/220px-Friedrich_Welwitsch_IA_mobot31753003484141_cropped.jpg?resize=757%2C826&ssl=1)
এই মাসে নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত একটা গবেষণা প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা “ওয়েলভিটসিয়া”-এর এইরকম অন্যন্য আকৃতি, দীর্ঘজীবীতার পেছনে কিছু জিন রহস্য প্রকাশ করেন। এইরকম শুষ্ক এবং কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন পরিবেশে এই উদ্ভিদ কি করে টিকে থাকে সেই হদিস মেলে তার জিনোমে। সেই সাথে এর জিনোম ইতিহাস পরিবেশগত ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। গবেষণাটির নেতৃত্বে থাকা চীনের শেনজেনে অবস্থিত দ্যা ফেইরি লেক বোটানিক্যাল গার্ডেন এর উদ্ভিদবিদ তাও ওয়ান বলেন, “আনুমানিক ৮৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে যখন নামিবিয়া মরুভূমির শুষ্কতা এবং খরার পরিমাণ বেড়ে চলেছিল তখন ওয়েলভিটসিয়ার কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় ভুলবশত এর পুরো জিনোম একটার জায়গায় দুইটা হয়ে যায়”। পরিবেশের চরমভাবাপন্ন অবস্থাই এইরকম জিনোম ডুপ্লিকেশন এর জন্য দায়ী। ডুপ্লিকেটেড জিনগুলো তাদের মূল কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
তবে অপেক্ষাকৃত বড় জিনোম চালানোর খরচও কিন্তু বেশি। একটি কোষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তার ডিএনএ এর অনুলিপন। কোষে লাগা মোট শক্তির এক তৃতীয়াংশ খরচ হয় অনুলিপন প্রক্রিয়ায়। কাজেই জিনোমের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া মানে জীবন আরও জটিলতর হওয়া। বিশেষ করে এই রকম কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন পরিবেশে তো বটেই। ওয়েলভিটসিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও খারাপ এর দিকে যায় কেননা দেখা যায় এর জিনোম এ রেট্রোট্রান্সপোজন এর পরিমাণ অনেক বেশি। রেট্রোট্রান্সপোজন হচ্ছে ডিএনএ এর এক ধরণের ট্রান্সপোজন এলিমেনট। ডিএনএ এর এমন কিছু অংশ যারা নিজেই নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে জিনোমের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে পারে। প্রথমে রেট্রোট্রান্সপোজন হতে ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় আরএনএ তৈরি হয়। তারপর রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় আবার ডিএনএ তে রূপান্তরিত হয়ে জিনোমের অন্য কোন জায়গায় যুক্ত হয়। প্রক্রিয়াটা অনেকটা কপি- পেস্ট করার মতন। রেট্রোট্রান্সপোজন এর কারণে জিনোমের দৈর্ঘ্য আরও বাড়তে থাকে। ফলে কোষের শক্তি চাহিদা আরও বেড়ে যায়।
আজ থেকে এক থেকে দুই মিলিয়ন বছর আগে গবেষকরা চরম তাপমাত্রার কারণে রেট্রোট্রান্সপোজন এর ক্রিয়াকলাপ বেড়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু ওয়েলভিটসিয়া ডিএনএ মিথাইলেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর জিনোমে থাকা রেট্রোট্রান্সপোজন গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এই প্রক্রিয়া এবং আরও কতগুলো নির্বাচনী শক্তি ওয়েলভিটসিয়ার বড় জিনোমের শক্তি খরচ অনেকটা কমিয়ে আনে। গড়পড়তায় উদ্ভিদের পাতা তার শীর্ষ অথবা কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার টিপি-টপ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু ওয়েলভিটসিয়ার আসল ক্রমবর্ধমান টিপটি মারা যায় এবং এর পরিবর্তে গাছের শারীরবৃত্তির একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বেসাল মেরিস্টেম যা ক্রমবর্ধমান উদ্ভিদকে তাজা কোষ সরবরাহ করে সেখান থেকে পাতাগুলো বেরিয়ে আসে। এই অংশের কোষের বৃদ্ধি, বিপাক ক্রিয়ার গতি বাড়ানো এবং স্ট্রেস এর সাথে মানিয়ে নেবার সাথে জড়িত কিছু জিন এর কার্যকারিতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রতিকূল পরিবেশেও উদ্ভিদটি বাড়তে থাকে।
ওয়েলভিটসিয়ার জিনোম আমাদের উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে কম পানির চাহিদা বিশিষ্ট ফসল প্রজননের আশা জাগায়। ড.লিবেনস-ম্যাক বলেন, “যখন আমরা দেখি এই রকম রুক্ষ এবং শুষ্ক পরিবেশে ওয়েলভিটসিয়ার টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে, তখন আমি অনুভব করি আমাদের কৃষিকে আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যাবার কথা”। পরিশেষে ড. লিচ বলেন,
“অদ্ভুত জিনিস থেকে, আপনি এমন অদ্ভুত কিছু আবিষ্কার করবেন যা আপনাকে এমন বিষয় বুঝতে সাহায্য করে যা আপনি জানেন না এবং আপনি বুঝতে পারেন নি”।
তথ্যসুত্রঃ A Plant That ‘Cannot Die’ Reveals Its Genetic Secrets. – দি নিউইয়র্ক টাইমস।
Leave a Reply