মস্তিষ্কে অ্যালকোহলের প্রভাব

লিখেছেন

লেখাটি , , বিভাগে প্রকাশিত

অ্যালকোহল বা বাংলায় মদ হচ্ছে এক ধরনের নেশাজাতীয় পানীয়। মদ শরীরে দ্রুত প্রভাব ফেলে। যখন কোন ব্যক্তি অ্যালকোহল পান করে তখন তা পাকস্থলীর মাধ্যমে পুরো শরীরের রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে সেটা কোষে চলে যায়। 

অ্যালকোহল পান করার মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে তা মস্তিষ্কে পৌঁছায়। আর মাত্র ১০ মিনিটের মাঝেই তা শরীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ২০ মিনিট পর যকৃৎ (liver) মদ প্রক্রিয়া করতে শুরু করে। যকৃৎ প্রতি ঘন্টায় ১ আউন্সের মতো মদ প্রক্রিয়া করতে পারে। রক্তে অ্যালকোহলের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ০.০৮% – যা শরীরের পুরো সিস্টেম থেকে চলে যেতে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। প্রায় ৮০ ঘন্টা পর্যন্ত প্রস্রাবে (urine) অ্যালকোহল থাকতে পারে এবং চুলের ফলিকলে থাকতে পারে তিন মাস অব্দি।

কি ঘাবড়ে যাচ্ছেন নাকি?  আরে, মাত্র তো শুরু হলো শরীরে অ্যালকোহলের করা নীল নকশার উন্মোচন। আসুন ধাপে ধাপে জেনে নেয়া যাক মূল ঘটনাগুলো। 

 অ্যালকোহল শরীরে প্রবেশের পর যেভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে

একটি প্রচলিত মিথ আছে যে, মদ্যপান মস্তিষ্কের কোষদের হত্যা করে। সত্যিকার অর্থে এমন না।  আরে, খুশি হবেন না! 

মদ্যপানের কারণে নিউরণের শেষপ্রান্তগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার ফলে নিউরণ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারে না এবং বার্তা প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এভাবেই মূলত মদ্যপান মস্তিষ্কে পরোক্ষভাবে আঘাত হানে। 

একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত অ্যালকোহল শরীরে বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু সেই মাত্রা যদি কেউ অতিক্রম করে মানে বেশি পান করে, তবে তা বিষক্রিয়া ঘটায় শরীরে – যাকে বলা হয় মদ্যপান বিষক্রিয়া ( Alcohol intoxication)।

মদ্যপানের প্রথম দিকে, মস্তিষ্ক অধিক পরিমাণে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। যার ফলে সাময়িক আনন্দ বা সুখানুভূতির উদ্রেক হয়। অ্যালকোহল এক প্রকার স্নায়ু উপশমকারী- যার অর্থ মদ মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। 

একজন ব্যক্তি যত বেশি মদ পান করবে, তত বেশি তার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাবে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে  সৃষ্ট বিষক্রিয়া বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। মদ্যপানের ফলে বিষক্রিয়ার কিছু উপসর্গ দেখা যায়।  চলুন, জেনে নেয়া যাক!

  • প্রথমত, মদ মস্তিষ্কের সম্মুখ অংশের কার্যক্রম কমিয়ে দেয়। যেমন ধরুন- কোন কিছু নিয়ে পরিকল্পনা করা, সমস্যা নিয়ে ভাবা- তা সমাধান করা, আবেগ প্রশমিত করা। এই সময় ব্যক্তি সাধারণত এমন কিছু আচরণ করে- যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় করতো না।  
  • দ্বিতীয়ত, মদ মধ্য-মস্তিষ্কের সাব-কর্টিকাল (mid sub-cortical) অংশে যখন পৌঁছায় তখন ব্যক্তির কথা জড়িয়ে যায়, আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় এবং স্মৃতিশক্তি বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে থাকে। 
  • সর্বশেষে, অতিরিক্ত মদ্যপান পৌঁছে যেতে পারে পেছনের মস্তিষ্কে। ফলে ব্যক্তি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, হৃদপিন্ডের স্পন্দন (heart beat) কমে যায়। এমনকি কিছুক্ষেত্রে মদ ব্যক্তির মস্তিষ্কের শ্বাস-প্রশ্বাসের কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে ফেলে এবং কমিয়ে দেয় স্বাভাবিক মাত্রা। আর এই পরিস্থিতি ব্যক্তিকে কোমায় নিয়ে যেতে পারে।

অ্যালকোহলের প্রভাবে এই তিন ধরনের বিশেষ পরিবর্তন, সাধারণত বেশ ভাল রকমের ফ্যাক্টর বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এই যেমন ধরুনঃ

  • খাদ্যগ্রহণ
  • শরীরের ওজন
  • লিঙ্গ
  • বয়স
  • শারীরিক সুস্থতা

একজন যতবেশি পরিমাণে মদ পান করবে বা মদ্যপ হবে তত বেশি পরিমাণে, তা মস্তিষ্কের তিনটি অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে মদ স্মৃতি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।

খালি পেটে যদি অত্যাধিক পরিমাণে মদপান করা হয়,তবে ব্যক্তি এমন এক বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে যায় – যাকে ব্ল্যাকআউট (blackout) বলে। এই অবস্থায় ব্যক্তি পরবর্তীতে আর সেই ঘটনা বা তখনকার পুরোটা সময় মনে করতে পারে না- কি হয়েছিল!

এক গবেষণা সমীক্ষায় এর সত্যতা খুঁজে  পাওয়া যায়। এই গবেষণায় ৭৭২ জন  আন্ডারগ্র‍্যাড লেভেলের ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করা হয় মদ্যপান নিয়ে, বিশেষ করে ব্ল্যাকআউটের অভিজ্ঞতা নিয়ে। 

তার মধ্যে ৫১% স্বীকার করেছিল- তাদের এইরকম স্থিতি হয়েছিল। প্রায় ৪০%  জানায়, এই সমীক্ষার এক বছর আগে তাদের এরকম একবার হয়েছিল। এই সমীক্ষা চলাকালীন ২ সপ্তাহে যারা মদপান করেছিল,তাদের মধ্যে ৯.৪% জানায়, সেসময় তাদের ব্ল্যাকআউট হয়েছিল। ব্ল্যাকআউটের সময় তারা যা কিছু করেছিল,যেমন- অরক্ষিত যৌনমিলন, বেপরোয়া ড্রাইভিং ইত্যাদি কিছুই মনে পড়েনি পরবর্তীতে। 

গর্ভাবস্থায় মদ্যপান মারাত্মক প্রভাব ফেলে গর্ভের সন্তানের উপর। শারীরিক, মানসিক, শিখন প্রক্রিয়া, আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায় ক্রমবর্ধমান মস্তিষ্কে – যা ফিটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম (fetal alcohol syndrome) নামে পরিচিত। এই উপসর্গের জন্য সেই বাচ্চাদের মস্তিষ্ক  অন্যদের তুলনায় ছোট হয়।  তাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ এবং যকৃতের রোগ দেখা দেয়।

শরীরে অ্যালকোহলের সামগ্রিক প্রভাব

ক্ষণস্থায়ী প্রভাব

  • মনোযোগ কমে যায়
  • মুড সুয়িং হয়
  • দক্ষতা কমে যায়
  • পরিকল্পনায় ঘাটতি হয়
  • তন্দ্রাচ্ছন্নতা
  • অবসাদ
  • স্মৃতিবিলোপ
  • শারীরিক শক্তি হ্রাস

দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

  •  এরনিক’স- করসাকোফ সিনড্রোম (wernicke’s-korsakoff syndrome)

– দ্বিধাগ্রস্থতা

– ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা

– হ্যালুসিনেশান

– চোখের মণির অসংলগ্ন চলাচল

– অপুষ্টিজনিত কারণে ওজন হ্রাস

  • ফিটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোমঃ

থায়ামিন নামে এক প্রকার ভিটামিন B1, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে মস্তিষ্কেরসহ সকল কোষের জন্য। মদ্যপানের ফলে থায়ামিনের ঘাটতি দেখা দেয়।  উপসর্গঃ- 

– বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী

– স্মৃতিশক্তি হ্রাস

– দেখা বা শোনায় সমস্যা

– মনোযোগে বিচ্ছিন্নতা

  • মস্তিষ্কের রোগঃ

– ডিমেনশিয়া

– আচরণে পরিবর্তন

– আলঝেইমার্স রোগ ও

– পারকিন্সন রোগ হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

  • শারীরিক প্রভাবঃ

– উচ্চ-রক্তচাপ

– হৃদরোগ

– হৃদস্পন্দনে অস্বাভাবিকতা

– রক্তনালিকা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া

– কিডনির রোগ

– যকৃৎ রোগ

– অগ্ন্যাশয়ের রোগ

– দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের।

– বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশি যেমনঃ স্তন ক্যান্সার, যকৃৎ ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার। 

এতক্ষণ ভয়ানক সব বার্তা পড়ে নিশ্চয়ই পিলে চমকে যাচ্ছে! আসুন, এবার একটু দম নেয়া যাক। 

সবকিছুর যেমন শুরু আছে, শেষ ও আছে। বর্তমানের যে অভ্যাস সাময়িক আনন্দ দিচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি তা মারাত্মক প্রভাব ফেলে – তবে সেটা বর্জনের সময় এখনি নয় কেন! ধূমপান, মারিজুয়ানা সেবন, নেশাজাতীয় দ্রব্য, অ্যালকোহল আসক্তি একজন সুস্থ  স্বাভাবিক মানুষকে ধীরে ধীরে ক্ষতিকর সমাপ্তির দিকেই নিয়ে যায়। অন্যান্য সব নেশার মতো মদ্যপানের আসক্তি থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। 

মদ্যপানের আসক্তি থেকে পরিত্রাণ

মদ্যপান ছাড়া একটি কঠোর সিদ্ধান্ত। চমতকার মানসিক দৃঢ়তার মাধ্যমে এই আসক্তি ধীরে ধীরে ত্যাগ করা যায়। কেউ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, কেউ রিহ্যাব বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে যান।   সীমিত মাত্রায় মদ্যপানের জন্য বা ছাড়ার জন্য  কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারেঃ-

  • কেউ যদি দৈনিক মদ্যপানে অভ্যস্ত থাকে সেক্ষেত্রে পুরুষের জন্য ও মহিলার জন্য পানের নির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করা এবং মেনে চলা।
  • শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট সময়ে পান করা যেমনঃ সপ্তাহান্তে বা যেকোন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে।
  • আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মদ্যপান না করা।
  • মদ্যপানের আগ্রহ হলে বিভিন্ন বেভারেজ পানীয় পান করা এর পরিবর্তে। 
  • প্রবল সদিচ্ছা।

যেকোন প্রকার নেশাজাতীয় কিছুতে আসক্তি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। একই সাথে ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক, আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতিতে যথেষ্ট বৈচিত্র‍্য আছে উপভোগ করার। একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন হোক সবার লক্ষ্য। 

তথ্যসূত্রঃ

  1. The Serious Effects of Alcohol on the Brain
  2. How Does Adolescent Alcohol Use Affect the Developing Brain?
  3. How Alcohol Impacts the Brain
  4. ALCOHOL’S DAMAGING EFFECTS ON THE BRAIN
  5. What to know about alcohol and brain damage

লেখাটি 1,087-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. এফ, এম, আশিক মাহমুদ Avatar
    এফ, এম, আশিক মাহমুদ

    দারুণ কবি 👏 এরকম বিস্তারিত আরো লেখা চাই 👌

    1. মিঠুন পাল Avatar
      মিঠুন পাল

      অণুপ্রেরণা পেলাম লেখক সাহেব।

  2. A T M Badruzzaman Avatar
    A T M Badruzzaman

    কোরিয়াতে থাকাকালীন সময়ে দেখতাম প্রতি সপ্তাহে একদিন ডিনারের পর সব ল্যাবমেট-প্রফেসর সহ সবাই একসাথে ইচ্ছেমত মদ খেয়ে ব্ল্যাকআউট হয়ে যেতে! আমি যতটুকু কোক খেতে পারতাম তার চেয়ে বেশি মদ ওরা খেতে পারত। পরে নেটে দেখেছিলাম, কোরিয়ানরা সবচেয়ে বেশি মদ পান করে, প্রায় ১০ লিটারের বেশি/বছর! কিন্তু এই আরটিকেল পড়ার পর কয়েকটা ব্যাপার উল্টা লাগছে, কারন, কোরিয়ানরা অন্যতম স্রজনশিল জাতি, ওদের গড় আয়ু অনেক বেশি (৮৪), ওদের হেলথ স্ট্যাটাস আমাদের চেয়ে অনেকগুন ভাল, ওদের কাজ করার ক্ষমতা, মনযোগ ও অনেক বেশি!! কিন্তু কেন?

    1. আরাফাত রহমান Avatar
      আরাফাত রহমান

      কিছু কিছু সংস্কৃতিতে সামাজিকতার জন্য মদ্যপান একটা অপরিহার্য অংশ। সম্ভবত মদ্যপান মানুষকে সামাজিক পরিসরে কথা বলার যে বাঁধ থাকে সেটা সরিয়ে দেয়।

      1. মিঠুন পাল Avatar
        মিঠুন পাল

        আমার কাছে মনে হয়, তাদের অভ্যস্ততা একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। একই ডোজ যেটা অন্যদের জন্য ক্ষতিকর সেটা তাদের কাছে সহনীয়। এইজন্যে তাদের অতিমাত্রায় অ্যালকোহল প্রভাব ফেলে না।

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers