photo of supernova in galaxy

নক্ষত্রমন্ডলীর নামকরণ ও পৌরাণিক উপাখ্যান️

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

Perhaps they are not stars in the sky, but rather openings where our loved ones shine down to let us know they are happy.

Eskimo Legend

৬ নভেম্বর, ২০২০ সালের সন্ধ্যার আকাশে দৃশ্যমান মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। স্থান: কুমিল্লা, ছবি কৃতজ্ঞতা: মোঃ ইকরামুল হাসান

সন্ধ্যার খোলা আকাশ আমার বরাবরই পছন্দের ও আগ্রহের দৃশ্য। আমার গ্রামের বাড়িতে আগে সন্ধ্যা হলেই বিদ্যুৎ চলে যেতো। তখন আমি বেশ ছোট। নক্ষত্র নিয়ে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই। খসে পড়া নক্ষত্র এ জীবনে অনেকবার দেখা হয়েছে। আমার ছোট্ট মন ভাবতো, এই খসে পড়া নক্ষত্রেরা জোনাকি হয়ে আমাদের পুকুরপাড়ের ঝোপে জোনাকি হয়ে ঘুরে বেরায়। শুনতে কাব্যিক আর নাটকীয় লাগলেও এটা আমার সত্যিকারের উপলব্ধি ছিলো।

আজকের মতো আলো দূষণ আমার গ্রামের আকাশে কখনোই হয়নি। তখন নক্ষত্রের রাতগুলোয় বিশাল আকাশের বুক ফেড়ে এক বিশাল বড় গর্ত চোখে পড়তো। সে গর্তে নক্ষত্রের ঘনত্ব বেশি। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন এটা মেঘ।

বড় হয়ে জানতে পারি এটা আমাদের ছায়াপথ। মিল্কিওয়ে। আমাদের পরিবার; আমাদের উঠোন। নক্ষত্রের ওপর পড়াশোনাও বাড়িয়ে দিই। একে একে চিনতে শুরু করি একেকটা নক্ষত্রমন্ডলীকে। তাদের নাম, তাদের পরিচয়—সব! আগ্রহের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিলো, কিভাবে আসলো কনস্টেলেশানগুলির এই নামগুলি।

পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে বলি, আকাশের এই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রকে চেনা এবং তাদের অবস্থান জানতে প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা নক্ষত্রের একেকটা ঝাঁক-কে কল্পনা করেছেন একেকটা পৌরাণিক চরিত্ররূপে। একটা নক্ষত্রমন্ডলে থাকে অনেকগুলি নক্ষত্র। লাইনটা আবার পড়ুন। একটা নক্ষত্রমন্ডলীতে থাকে অনেকগুলি নক্ষত্র। এতে করে চেনা সহজ হয়ে একেকটা নক্ষত্রের অবস্থান। এদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে প্রাচীন কালে পথ পাড়ি দিতো মানুষেরা। ঋতু পরিবর্তন বোঝা যেতো। 

Orion বা কালপুরুষ দেখতে যেন একজন যোদ্ধা-ই, সোর্স: artstation

দক্ষিণ আকাশের কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের একটা ঝাঁকের দিকে ভালো করে তাকালে দেখবেন কিছু নক্ষত্র যেন এক সাথে হয়ে একটা ঢাল তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক যোদ্ধাকে কল্পনা করাচ্ছে আপনাকে। এটা খুব উজ্জল আর বিখ্যাত নক্ষত্রমন্ডল। এর নাম ওরিয়ন। আমাদের ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিদরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালপুরুষ’। মাথার ওপরে এ বিশাল পটে শত-সহস্র বছর ধরে মানুষের লেখা পাঁচালীগুলির কথা ভাবতে ভাবতে আমি ডুবে যাই—মিশে যাই সেই অনন্ত-অসীমে।

অরিওন বেল্ট। নীচে জ্বলজ্বল করছে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, sirius ; স্থান: কুমিল্লা, বাংলাদেশ, সময়: সন্ধ্যা ৮ টা ৩০, তারিখ: ১০ নভেম্বর, ২০২০, কৃতজ্ঞতা: মোঃ ইকরামুল হাসান।

হাইড্রার কথা ভাবি।

দানবাকার এ হাইড্রাকে এপ্রিলের কোনো এক রাতে খুব প্রাণবন্ত দেখবেন। আকাশের মাঝ বরাবর তার উপস্থিতি, যার লেজ গিয়ে ঠেকে পুবের দিগন্তে। যেন এক ভয়াল দানব আকাশ জুড়ে উড়তে চাইছে।

এই হাইড্রাকে নিয়ে যেমন ভেবেছেন পাশ্চাত্যের গ্রীক জ্যোতির্বিদরা। তেমনি ভেবেছেন আমাদের ভারতীয় জ্যোতির্বিদরাও। দিয়েছেন একটা সংস্কৃত নামও, ‘হৃদসর্প’।

আমি ভেবে অবাক হই—পৃথিবীর এক প্রান্তের জ্যোতির্বিদরা যেমন করে কোনো নক্ষত্রমন্ডলীকে দেখেছেন, তেমনি আকৃতিতে দেখেছেন আরেক প্রান্তের জ্যোতির্বিদরাও। অথচ, তাদের কথা হয়নি এক সাথে কোনোদিনই। গড়ে উঠেছেন তাঁরা ভিন্ন মনন আর ভিন্ন পরিবেশে। কিন্তু, আকাশপটে তাঁদের কল্পনার কতো সুন্দর একাত্মতা!

এই আকাশপটে যেমনি স্থান পেয়েছে গ্রীক দেবতাদের বীরত্বগাঁথা আর উপাখ্যান, তেমনি স্থান পেয়েছে আমাদের ভারতীয় বৈদিক পুরাণের উপাখ্যানও। এদেশের জ্যোতির্বিদরা হাজার বছর আগে খুব সুন্দর করে আকাশ পটে এঁকে গেছেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রী কৃষ্ণের মামা ‘কংস’ কে। বাদ যায়নি মহাদেব শিবের রোষানলে পড়ে প্রজাপতি দক্ষের ধর থেকে মাথা হারানোর উপাখ্যানও। চলুন, খুলে বলি। আজকের এই নক্ষত্রের পালাগানে আমার চারপাশে গল্প শুনতে বসে যান আপনারাও।

কংসের কথা তুলেছিলাম। অতএব, কংস দিয়েই শুরু করি। উত্তর আকাশে হারকিউলিস নক্ষত্রমন্ডলীর পায়ের কাছেই পেয়ে যাবেন ড্রাকো কে। ড্রাকোর ভারতীয় নাম, ‘তক্ষকনাগ’। তক্ষকনাগের ভারতীয় বৈদিক উপাখ্যানে পরে আসছি। এর আগে বলি, হারকিউলিসের পায়ের কাছের এই নক্ষত্রমন্ডলীর নাম কেন ড্রাকোই রাখা হলো। সেটার জন্য আমাদের জানতে হবে গ্রীক পুরানে চিত্রিত হারকিউলিসের কাহিনী। দেবালয়ের রাজা জিউসের পুত্র ডেমিগড হারকিউলিসের ১২টি শ্রমের সাথে সম্পৃক্ত অনেক চরিত্রই তারামন্ডলরূপে আকাশে বিরাজমান। ১২ টি শ্রমের সবগুলি লিখে লেখাটায় মেদ বাড়ানোর ইচ্ছা নেই।

১২ টি শ্রমের ২য় আর একাদশ শ্রমের গল্প করবো এখানে।

হারকিউলিসের একাদশ শ্রমে হাসপেরাইডদের বাগান থেকে আপেল তুলতে গিয়ে তিনি প্রহরায় নিযুক্ত ড্রাগন ল্যাডনকে বধ করেন। সেই ড্রাগনটিই উত্তর আকাশে হারকিউলিসের পায়ের কাছে বসে আছে। যার নাম ড্রাকো। ড্রাকো বা তক্ষকনাগের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র আছে। যার নাম ‘থুবান’। আজ থেকে ৫/৬ হাজার মিশোরীয় সভ্যতায় এই থুবানকে ধ্রুবতারা ভাবা হতো। প্রাচীন জাহাজের নাবিকরা এই থুবানের দিকে তাকিয়ে অসীম জলরাশির মধ্য দিয়ে নিকষ অন্ধকারেই পাড়ি দিতো শত-সহস্র ক্রোশ। এই পথপ্রদর্শক থুবান তারকাটিকে ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা খায়েশ করে নাম দিয়েছেন ‘প্রচেতা’।

কি? চিনে ফেলেছেন প্রচেতা কে? হ্যাঁ, তিনি শিবের পত্নী সতী’র পিতা।

তাঁর আরেক নাম প্রজাপতি দক্ষ। যতোদূর জানি, তিনি ব্রহ্মার সন্তান ছিলেন। সতীকে আত্মহত্যায় প্রলোভিত করার জন্য মহাদেব তার ধর থেকে মাথা পৃথক করে নেন এক সময়। এই পথপ্রদর্শক নক্ষত্রকে আমাদের জ্যোতির্বিদরা শুধু ‘প্রচেতা’ই ভাবতে পছন্দ করেন নি। আরেকবর্ণনায় এই থুবান নক্ষত্রের নাম দিয়েছেন ‘কংস’। শ্রীকৃষ্ণের মাতা দেবকীর সৎ ভাইয়ের নাম ছিলো কংস।

মনে আছে, উপরে বলেছিলাম, আমি হারকিউলিসের ১২ টি শ্রমের ২য় আর একাদশ শ্রম নিয়ে আলাপ করবো?

আগে একাদশ শ্রমের আলোচনায় ড্রাকো’র কাহিনী উঠেছিলো৷ সেই ড্রাকো পরিবারের থুবানের কথা উঠেছিলো। সেই থুবানের ভারতীয় নাম প্রচেতা কিংবা কংসের কাহিনীও জানা হয়েছিলো।

এবার আমরা হারকিউলিসের দ্বিতীয় শ্রম ঘেটে দেখি, এখানে কতোগুলি কাহিনী বের করে আনা যায়, যেগুলি জড়িয়ে আছে নক্ষত্রমন্ডলীর নামকরণের পেছনে।

লার্নার জলাভূমির ত্রাস ছিলো ‘হাইড্রা’। যার এক মাথা কাটলে সেখানে আরো একাধিক মাথা গজাতো। সেই হাইড্রাকে হারকিউলিসই বদ করেন। এটাই তাঁর দ্বিতীয় শ্রম। আর, এই ‘হাইড্রা’ কেই আকাশের সবচেয়ে বৃহত্তম নক্ষত্রমন্ডলের নাম দেয়া হয়েছে। সত্যি বলতে, এটা দেখতেও কয়েকটা ফনীওয়ালা সাপ কিংবা হাইড্রার মতো। আমার এ গল্পের শুরুতেই হাইড্রার কথা বলেছিলাম। মধ্য আকাশে হাইড্রার মাথা থাকলেও সে লেজ পুবের আকাশের একদম দিগন্ত অবধি চলে যায়। বিশাল এ আকাশে সাঁতারাতে থাকা এক দানব। এ নক্ষত্রমন্ডলের পাশ্চাত্যের কেচ্ছা তো শুনলেন। এবার শুনুন আমাদের উপাখ্যান। আমাদের উপমহাদেশের জ্যোতির্বিদরাও এটাকে একাধিক ফণাওয়ালা সাপই ভেবেছেন। সে থেকে নাম দিয়েছেন ‘হৃদসর্প’।

এই হাইড্রা নক্ষত্রমন্ডলের প্রথম তারাটির নাম ‘আলফার্দ’। এটি বেশ উজ্জ্বল। এর ভারতীয় নাম ‘কালীয়’। মহাভারতের বৃন্দাবন কান্ডে বলা হয়েছে এই ভয়ানক সাপের গল্প। যমুনা নদীর এক ঘুর্ণাবর্তে বাস করতো। যার ফণা কতোটি তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। বিষ্ণুপুরাণ বলে ৩ টি আর ভগবত বলে সহস্রাধিক। কালিয়াকে কৃষ্ণের বদ করার কাহিনীটি ‘কালীয়দমন’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। এককালে কতো কবিগানে গাওয়া হতো সে গল্প। 

ঠিক কোথায় যেন হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের দুটি ভিন্ন সভ্যতার মানুষের পৌরাণিক কল্পনাগুলিতেও এক প্রকার সাদৃশ্যতা রয়েছে। তাই বোধহয় একাত্মতা দেখতে পাওয়া যায় নক্ষত্র মন্ডলীর আকৃতি দেয়ার বেলায়ও।

হিন্দু পুরাণে ‘বাসুকীনাগ’-এর নাম তো আপনারা প্রায় সকলেই শুনেছেন, তাই না?

পৌরাণিক উপাখ্যান গুলি বলে, আমাদের এ বিশ্বচরাচরকে নিজ ফণায় ধারণ করে সেটাকে মহাসাগরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচান বাসুকীনাগ।

ব্যাপারটা আরেকটু খুলে বলা যাক।

কশ্যপমুনির জেষ্ঠ্যনাগপুত্রের নামছিলো ‘শেষনাগ’। তিনি প্রচন্ডরকম ব্রহ্মাভক্ত ছিলেন। হাজার হাজার বছর ব্রহ্মার নৈকট্য পাওয়ার জন্য সাধনা করেন। অবশেষে দেখা দেন ব্রহ্মা। সে-ই ব্রহ্মার আদেশেই ‘শেষনাগ’ পাতালে গিয়ে এ বিশ্বকে নিজ মাথায় ধারণ করে নেন। এতে করে পাতাল নাগরা তাঁকে ‘বাসুকীনাগ’ উপাধী দেন।

এই হাইড্রা বা হৃদসর্প নক্ষত্রমন্ডলটির দ্বিতীয় ও অষ্টম নক্ষত্রের গ্রীক নাম যথাক্রমে ‘বিটা হাইড্রি’ ও ‘জিটা হাইড্রি’। 

বিটা হাইড্রির ভারতীয় নাম ‘শেষ’। জিটা হাইড্রির ভারতীয় নাম ‘বাসুকী’।

হ্যাঁ, দু’টো তারকার নামই বাসুকীনাগের নামে।

হাইড্রা বা হৃদস্বর্প

আজকের আলোচনায় হারকিউলিসের দ্বিতীয় আর একাদশ শ্রমের ঘাড়ে ভর করে সর্পাকৃতির নক্ষত্রমন্ডলীর পৌরাণিক আলোচনা করলাম। অন্য কোনোদিন আমরা আবারো জলসায় বসাবো আকাশপটে হাজার বছর আগে জ্যোতির্বিদদের এঁকে যাওয়া বীরদের বীরত্বগাঁথার গল্প নিয়ে। কিংবা আলোচনায় বসবো সিটাসের মতো দানবদের। কিংবা ব্রহ্মক্ষত্রিয় যোদ্ধা পরশুরামের। যাদের কল্পনা করে আকাশে এঁকে গেছেন আমাদের প্রাচীনপুরুষেরা। লিখে গেছেন দেবতাদের গল্প। আকাশকেই করে গেছেন এক পৌরাণিক মহাগ্রন্থ। 

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 2,617-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Sujoy Kumar Das Avatar
    Sujoy Kumar Das

    দারুণ!

    1. মাহাথির আহমেদ তুষার Avatar
      মাহাথির আহমেদ তুষার

      ধন্যবাদ

Leave a Reply to Sujoy Kumar DasCancel reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading