[একমেবাদ্বিতীয়ম্ সংযোজন – ১ম কিস্তি]
প্রথম দেখায় একটি গাছ থেকে ঐ গাছের পাতা খাওয়া শুঁয়োপোকা, গাছের বাকল থেকে অঙ্কুরিত ব্যাঙের ছাতা, গুঁড়ির পাশে বর্ধনশীল ঘাস, কিংবা তরু ছায়ায় বসে গল্প করা যুগল – কোন কিছুই দেখতে এক রকম লাগবে না। তবে বাহ্যরূপ ছলনাপূর্ণ হতে পারে। আণুবীক্ষণিক পর্যায়ে বিবর্ধিত করে দেখা হলে এদের কাঠামোগত সাদৃশ্য অবাক করে দেবে। কারণ এরা সকলে একই ধরনের গঠন-শৈলী মেনে চলা কোষ দিয়ে তৈরি।
ধারাবাহিকের সূচী: ধারাবাহিকের সূচী: কিস্তি ১. প্রাণের প্রথম একশ কোটি বছর কেন একঘেয়ে ছিলো? কিস্তি ২. সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব কেন অসম্ভব-সম্ভাবনা ছিলো? কিস্তি ৩. প্রাককেন্দ্রিক জিনেরা সুকেন্দ্রিক জিনোমে কিভাবে কর্মবিভাজন করলো? কিস্তি ৪. মাইটোকন্ড্রিয়াহীন সুকেন্দ্রিকদের হুমকি সামলানো গেলো কিভাবে? কিস্তি ৫. কোষের শক্তি কোথেকে আসে? কিস্তি ৬. কেন সুকেন্দ্রিকদের উদ্ভব গবেষণায় অনিশ্চয়তা নিশ্চিত?
এ কোষগুলোতে রয়েছে একটি নিউক্লিয়াস যা সুক্ষ্ম ঝিল্লী দিয়ে ডি.এন.এ-কে ধরে রাখে। আর এ নিউক্লিয়াসই হলো কোষের শাসন-কেন্দ্র, হেডকোয়ার্টার। নিউক্লিয়াসের চারপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠুরী আছে যারা আসলে ক্ষুদ্র অঙ্গাণু, এরা বিশেষায়িত কাজ করে বেড়ায়: যেমন গুরুত্বপূর্ণ অণু জমা রাখা কিংবা প্রোটিন তৈরি। এসব কুঠুরীর মাঝে আছে শিম-আকৃতির মাইটোকন্ড্রিয়া: কোষকে শক্তি সরবরাহ করা পাওয়ার-প্ল্যান্ট।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঘুরে-ফিরে দেখা যায় সকল প্রাণী, উদ্ভিদ, ছত্রাক ও শৈবালের প্রায় সব কোষে – যাদেরকে এক নামে ডাকা হয় ইউক্যারিয়টস বা সুকেন্দ্রিক কোষ।
অন্যদিকে ব্যক্টেরিয়ারা কোষ নির্মাণের অন্য একটি সরলতর নির্মাণ-কৌশল দেখায় – এ কৌশল সুকেন্দ্রীক কোষের চেয়ে অন্তত একশ কোটি বছরের পুরনো। এদেরকে বলে প্রোক্যারিয়টস বা প্রাককেন্দ্রীক কোষ। এসব কোষ আকারে সাধারণ সুকেন্দ্রিক কোষের চেয়ে অনেক ছোট এবং মাইটোকন্ড্রিয়া বা নিউক্লিয়াসের মতো কোন অভ্যন্তরীণ কুঠুরী বিহীন। নির্মাণশৈলী তুলনামূলক সরলতর হলেও ব্যক্টেরিয়ারা বেশ মনোগ্রাহী জৈব-যন্ত্র। তারা সকল সাম্ভাব্য বাসভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করে, তা সে হোক না অভ্রচুম্বী মেঘ কিংবা গভীর সমুদ্র। তাদের রয়েছে একঝাঁক জৈব-কৌশল যার মাধ্যমে ওরা রোগব্যাধি তৈরি করতে পারে, হজম করে ফেলতে পারে অপরিশোধিত তেল, বহন করতে পারে বিদ্যুত-প্রবাহ, সূর্য থেকে সংগ্রহ করতে পারে শক্তি, আর যোগাযোগ করতে পারে নিজেদের মধ্যে।
তবু, সুকেন্দ্রিক কোষের মতো বিশেষায়িত কাঠামো নেই বলে ব্যক্টেরিয়া চিরদিনের জন্য ক্ষুদ্র-আকৃতি ও সরলতার মধ্যে আটকে যায়। তাদের অজস্র মনোগ্রাহী দক্ষতা আছে, কিন্তু সুকেন্দ্রীক-কোষী জীবরাই পৃথিবীর বন ও তৃণভূমি ছেয়ে আছে – যারা এ গ্রহের মাঝে খাদ্য ও সঙ্গীর সন্ধানে চরে বেড়ায়, যারা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য রকেট নির্মাণ করে।
পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো আদিম প্রাককোষী থেকে জাঁকজমকপূর্ণ সুকেন্দ্রিককোষের উদ্ভব। আর এই ঘটনাটা তিনশ কোটি বছরের বেশি সময়ের মধ্যে মাত্র একবার ঘটেছে।
বিষয়টা কিন্তু খুবই অবাক করা। পৃথিবীতে জীবন অজস্র জটিল কাঠামোতে পরিপূর্ণ যাদের হরদম বিবর্তন ঘটছে। কতগুলো একাকী কোষ কয়েক ডজন আলাদা ঘটনার মাধ্যমে একাট্টা হয়ে গঠন করেছে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মতো বহুকোষী জীব। একই কথা প্রযোজ্য চোখের ক্ষেত্রে; চোখ স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হয়েছে বারবার। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি বিবর্তনের পথে একই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে একই সমাধানে পৌঁছাতে পারে। আবার ভিন্ন পদ্ধতিতেও সমাধানে পৌঁছাতে পারে; যেমন উড়ার জন্য কীট-পতঙ্গ (ভ্রমর), সরীসৃপ (উড়ন্ত ডাইনোসর), পাখি (শালিক), স্তন্যপায়ী (বাদুড়) ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। কিন্তু প্রাককেন্দ্রিক থেকে সুকেন্দ্রিক কোষের উদ্ভব একবারই ঘটেছে।
ব্যক্টেরিয়ারা বারবার অধিকগতর জটিল নির্মাণের পথে ঠেলাঠেলি করেছে। তাদের কেউ কেউ সাধারণ অণুজীবের তুলনায় আকারে বেশ বড়ো; বাকিরা একসাথে উপনিবেশ তৈরি করে করে কাজকারবার করে, অনেকটা বহুকোষ দিয়ে তৈরি একক জীবের মতো। কিন্তু কেউই সুকেন্দ্রিককোষের দরকারী বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে নি: বড় আকার, নিউক্লিয়াস, আভ্যন্তরীণ কুঠুরী, মাইটোকেন্ড্রিয়া ও অন্যান্য বিশেষত্ব। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নিক লেন যেমন বলেন: ব্যাক্টেরিয়ারা সুকেন্দ্রিক কোষের মতো জটিলতার অর্জনের লক্ষ্যে সকল পথে প্রচেষ্টা চালিয়ে দ্রুত থেমে গেছে। কিন্তু কেন?
এমন নয় যে সুযোগের অভাব। পৃথিবী অজস্র প্রাককেন্দ্রিক জীব দিয়ে ঠাসা যারা খুব দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে। তবে তাদের এই গতি সুকেন্দ্রিক-কোষী হওয়ার জন্য খুব একটা দ্রুত নয়। জীবাশ্মের তথ্য আমাদের বলে যে সবচেয়ে পুরাতন ব্যক্টেরিয়া এখন থেকে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো বছরের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলো। কিন্তু দুইশ-দশ কোটি বছরের আগে কোন সুকেন্দ্রিক কোষের খোঁজ পাওয়া যায় না। তাই বিস্ময় তৈরি হয় যে কেন একশো কোটি বছরের কল্পনাতীত দীর্ঘ সময় ধরে প্রাককেন্দ্রীক জীবেরা এত সরল কোষ হিসেবে বেঁচে ছিলো?
অনেকগুলো সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে কিভাবে প্রাককেন্দ্রীক থেকে সুকেন্দ্রীক কোষের উদ্ভব পারে। এদের মাঝে একটি ব্যাখ্যা সম্প্রতি পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেয়েছে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী একটি প্রাককেন্দ্রীক জীব কোনভাবে অন্যটির মধ্যে ঢুকে যায়। হয়তো অন্য কোষটি খাদ্য শিকারের সময় গিলে ফেলেছিলো প্রথমটিকে হজম করার উদ্দেশ্য, কিন্তু সেখানে প্রথম কোষটির সাথে দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারির আত্মীয়তা শুরু করে আভ্যন্তরীণ কোষটি। এই আভ্যন্তরীণ কোষ – একটি ব্যক্টেরিয়া – তার মুক্ত জীবন পরিত্যাগ করে এবং অবশেষে মাইটোকন্ড্রিয়ায় পরিণত হয়। এ ঘরোয়া পাওয়ার-হাউজ পোষক কোষের বাড়তি শক্তির একটি যোগান হয়ে দাঁড়ায়। নতুন শক্তিতে বলীয়ান পোষক কোষটি আরো জটিলতার পথে বিবর্তিত হওয়ার সামর্থ্য লাভ করে, যেখানে অন্য প্রাককেন্দ্রীক কোষ পৌঁছাতে পারবে না কখনোই।
এখনো অনেকে আছেন যারা এ তত্ত্বকে সন্দেহের চোখে দেখেন, তবে এ কাহিনী যদি সত্য হয়, তাহলে সকল সুকেন্দ্রীককোষী – সব ফুল ও ছত্রাক, মাকড়শা ও চড়ই, মানুষ – সকলেই দুইটি অণুজীবের হঠাৎ-শ্বাসরুদ্ধকর-ধরনের সংযোজন থেকে বিবর্তিত হয়েছে। সে সংযোজন আমাদের বড়-বড়-বড়-বড়-বড়…বড়-বড়-দাদাদাদীর দুই কোষের মিলন; দুইটি কোষ এই জোড়া লাগার মাধ্যমে এক হয়ে জীবনের বহুরূপী বৈচিত্র্যের ভিত্তি গঠন করে। পৃথিবীকে এখন আমরা যেভাবে দেখছি তা অপরিবর্তিতভাবে বদলে যায় সেই চরম মিলনের মাধ্যমে – যে মিলন এতোটাই অসম্ভব যে না ঘটলেও তা স্বাভাবিকই ঠেকতো, পৃথিবীকে চিরদিন শাসন করতো একঘেয়ে চেহারার অজস্র অণুজীব; জীবনের বৈচিত্র্যকে কখনোই স্বাগত না জানিয়ে; গাছপালা, ব্যাঙের ছাতা, শুয়োপোকা ও মানুষের আবির্ভাব না দেখেই।
[এড ইয়ং এর Unique Merger প্রবন্ধের অনুবাদ। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে]
Leave a Reply