গ ত বছরের শুরুতে চীনের উহাং প্রদেশে প্রথম আবির্ভাব ঘটে করোনা ভাইরাসের। ওয়ার্ল্ডমিটার এর তথ্য অনুযায়ী সে থেকে এ যাবত পুরো বিশ্বে পঞ্চাশটিরও বেশি দেশে ২১৬, ৪০৫, ৬২৩ জন মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয় এবং এর মধ্যে ৪, ৫০২, ৮২১ জন মানুষ প্রাণ হারান। করোনা ভাইরাসের এত দ্রুত সংক্রমিত হবার পেছনে একটা অন্যতম কারণ হল এটি একটি আরএনএ (RNA) ভাইরাস। আরএনএ প্রতিলিপন প্রক্রিয়ায় প্রুফ রিডিং এর ব্যবস্থা নেই। তবে ডিএনএ প্রতিলিপন প্রক্রিয়ায় প্রুফ রিডিং ব্যবস্থা আছে। বলে রাখা ভালো, প্রতিলিপন প্রক্রিয়ায় কোন ভুল হয়েছে কিনা সেটা নির্ণয় করা হয় প্রুফ রিডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আরএনএ প্রতিলিপনে প্রুফ রিডিং এর ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি। এই কারণে আরএনএ ভাইরাসে পরিবৃত্তি বা মিউটেশান ঘটার সম্ভাবনাও বেশি। তাছাড়া কোন ভাইরাসের অধিক পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ার দরুনও ঐ ভাইরাসের পরিবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। পরিবৃত্তির মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন ভ্যারিয়েন্ট পূর্বের ভ্যারিয়েন্ট এর তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক এবং মারাত্মক হতে পারে। সারস-কোভিড-২ (SARS-CoV-2) ভাইরাসে এ পর্যন্ত অনেকবার পরিবৃত্তি ঘটেছে। ফলে কয়েকটা নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়েছে যেগুলা আগের ভ্যারিয়েন্ট এর তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে চারটা ভ্যারিয়েন্ট কে ভ্যারিয়েন্ট অব কন্সার্ণ এ তালিকাভুক্ত করেছে- আলফা, বেটা, ডেলটা, গামা। আলফা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যে। এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের হার পঞ্চাশ ভাগ বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর হারও বেড়ে যায়। বেটা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। এই ক্ষেত্রেও সংক্রমণের হার পঞ্চাশ ভাগ বাড়ে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয় প্রতিবেশি দেশ ভারতে। এই ভ্যারিয়েন্ট ভারতে কিরকম তুলাকালাম কাণ্ড চালায় তা আমরা জানি সবাইই। নতুন ভ্যারিয়েন্ট গুলোতে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ বোঝতে হলে করোনা ভাইরাস কিভাবে আমাদের কোষে আক্রমণ করে সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা আছে। শুধু তাই না করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সফল ওষুধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও এর জীবন চক্র বোঝার প্রয়োজনীয়তা আছে। বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই করোনা ভাইরাসের জীবন চক্র বোঝার চেষ্টা করে আসছিলেন। এই লেখাটা সারস-কোভিড-২ এর জীবন চক্র নিয়ে।
প্রস্তুতি পর্যায়
ভাইরাস জীব এবং জড়ের মাঝামাঝি একটা স্বত্তা। এর জীবিত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় কোন পোষক কোষের সংস্পর্শে এলে। সারস-কোভিড-২ এর বাইরের পৃষ্ঠে এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত ২৪-৪০টি স্পাইক প্রোটিন রয়েছে। মানব কোষ কে আক্রমনের জন্যে স্পাইক প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন অনেক বেশি নমনীয়। নমনীয়তার আধিক্য এদেরকে পোষক কোষের তল খুঁজে পেতে এবং সেখানে একসাথে অনেক গুলো স্পাইক প্রোটিন এর যুক্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ায়। স্পাইক প্রোটিনে থাকা রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন (RBD: Receptor binding domain) আমাদের কোষে থাকা ACE2 (angiotensin-converting enzyme 2) বাইন্ডিং সাইটে যুক্ত হয়। সারস কোভিড ভাইরাসও পোষক কোষে যুক্ত হবার সময় একই বাইন্ডিং সাইট ব্যবহার করে। তবে এর তুলনায় সারস-কোভিড-২ দুই থেকে চার গুণ বেশি শক্তভাবে ACE2 বাইন্ডিং সাইটে যুক্ত হতে পারে। ভ্যারিয়েন্ট অব কন্সার্ণ এ থাকা ভ্যারিয়েন্ট গুলোর RBD সিকোয়েন্সে পরিবর্তন সাধিত হবার কারণে সেগুলোর বাইন্ডিং সাইটে যুক্ত হবার ধরণ পাল্টে যায়। উদাহরণস্বরূপ আলফা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিন সিকোয়েন্সে দশটি পরিবর্তন সাধিত হবার দরুন এর RBD আরও খাঁড়াভাবে ACE2 বাইন্ডিং সাইটে যুক্ত হতে পারে। ফলে আরও সহজে এটি পোষক কোষে প্রবেশ করতে পারে। পুরো বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের RBD সাইটে তিনটি মিউটেশান ঘটার কারণে এর পোষক কোষে প্রবেশ করার প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং দ্রুত হয়ে গেছে।
পোষক কোষে প্রবেশ
পোষক কোষের বাইন্ডিং সাইটে যুক্ত হবার পরে, সেখানকার কিছু প্রোটিন এর সাহায্যে ভাইরাল কোষ ঝিল্লীটি পোষক কোষের কোষ ঝিল্লীর সাথে মিশে যায়। পোষক কোষ পর্দায় থাকা টেম্প্রেস ২(TMPRSS2) নামক প্রোটিয়েজ এনজাইম সারস-কোভিড-২ এর স্পাইক প্রোটিন এর S2 সাবিউনিটে কেটে এর ভেতরের নিউক্লিয়বস্তুকে পোষক কোষের ভেতরে প্রবেশে সহায়তা করে। TMPRSS2 শ্বসন অঙ্গের কোষে প্রচুর পরিমাণে থাকে। তবে অন্যান্য সারস-কোভিড ভাইরাস এন্ডোসোমে থাকা ক্যাথেপসিন এল (cathepsin L) নামক প্রোটিয়েজ এনজাইম এই ব্যবহার করে। TMPRSS2, cathepsin L এর তুলনায় দ্রুত কাজ করে এবং অ্যান্টিভাইরাল প্রোটিন ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে না। কিন্তু এন্ডোসোমের মাধ্যমে ভাইরাসের প্রবেশ এর সময় অ্যান্টিভাইরাল প্রোটিন ভাইরাস শনাক্ত এবং আক্রমণ করতে পারে। এই কারণে কোন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ (যেমন ক্লোরোকুইন) সারস-কোভিড-২ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না এবং এটি অন্যান্য সারস ভাইরাসের তুলনায় দ্রুত পোষক কোষে প্রবেশ করতে পারে।
পোষক কোষের ভেতর
পোষক কোষের ভেতরে ভাইরাল RNA জিনোম প্রবেশের পর, ভাইরাল জিনোম পোষক কোষের রাইবোজোম কে ব্যবহার করে নন স্ট্রাকচারাল প্রোটিন (NSP: Non structural protein) তৈরি করে। NSP পোষক কোষের ট্রান্সলেশান (প্রোটিন তৈরি প্রক্রিয়া) প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, NSP প্রোটিন গুলো পোষক কোষের mRNA কে নিউক্লিয়াস থেকে বের হওয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করে। (mRNA এর কাজ হচ্ছে কোষের নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটিন তৈরি জিনোমিক তথ্য কপি করে রাইবোজোম এ নিয়ে যাওয়া। রাইবজোম mRNA জিনোম সিকোয়েন্স থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে )। ফলে কোষ তার প্রয়োজন মত ইন্টারফেরন প্রোটিন ( ভাইরাসের সংক্রমণ এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা তৈরি করতে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সংকেত প্রদান করে ইন্টারফেরন প্রোটিন) উৎপাদনে ব্যর্থ হয়।
পোষক কোষের রিমডেলিং
এই ধাপে ভাইরাসটি পোষক কোষের এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা গুলোকে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট ভেসিকল (DMVs: Double membrane vesicles) বা বাবল এর মতন গঠনে রূপান্তরিত করে। এগুলোর ভেতরে ভাইরাল জিনোম নিরাপদে তার অনুলিপন প্রক্রিয়া এবং ট্রান্সলেশান প্রক্রিয়া চালাতে থাকে। ভাইরাল RNA প্রথমে ১৬টি প্রোটিন তৈরি করে যেগুলো ভাইরাল RNA এর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। অধিক পরিমাণ RNA ভাইরাসের বিভিন্ন অংশ যেমন স্পাইক, ঝিল্লী তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় ২৬টি প্রোটিন উৎপাদন করতে থাকে। ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস গঠনের জন্যে সবগুলো অংশ গঠিত হয়।
পোষক কোষ ত্যাগ করা
তৈরি হওয়া অংশগুলো একত্রিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস গঠনের পরে সেগুলো পোষক কোষের গলগি বডি অথবা লাইসোসোম কে ব্যবহার করে কোষ থেকে বের হয়ে যায়। অন্যান্য সারস ভাইরাস কোষ ঝিল্লী দিয়ে পোষক কোষ ত্যাগ করে। পোষক কোষ ত্যাগ করার রাস্তা হিসেবে গলগি বডি কিংবা লাইসোসোম তুলনামূলক ভাবে ধীর গতির প্রক্রিয়া। সারস-কোভিড-২ কেন গলগি বডি কিংবা লাইসোসোমকে এই ক্ষেত্রে বেছে নেয় তার কারণ এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার না। হয়ত গলগি বডি কিংবা লাইসোসোম এর পর্দায় থাকা লিপিড অণুগুলো সারস-কোভিড-২ কে অন্য কোন সুবিধা দেয়।
দ্যা লাস্ট স্লাইস
সারস-কোভিড-২ ভাইরাসের S1 সাবইউনিটে পাঁচটা অ্যামাইনো এসিড এর একটা সাইট থাকে। অ্যামাইনো এসিড এর সিকোয়েন্সটা এরকম- প্রোলিন, আর্জিনিন, আর্জিনিন, অ্যালানিন এবং আর্জিনিন। পোষক কোষ ত্যাগ করার সময় পোষক কোষে থাকা ফিউরিন নামক এনজাইম এই ফাইভ ইউনিট সাইট কেটে দেয়। ফলে ভাইরাসের পক্ষে নতুন কোন কোষ বিশেষ করে ফুসফুস এর কোষকে আক্রমণ করা সোজা হয়ে যায়। এভাবে সারস-কোভিড-২ একটার পর একটা কোষকে আক্রমণ করতে থাকে।
তথ্যসুত্রঃ How the coronavirus infects cells.
Leave a Reply