১৯৫৩ সালের এপ্রিলে, নেচার জার্নালে ডিএনএ এর গঠন সম্বন্ধে তিনটা বেক-টু-বেক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথমটি লেখেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক, যেটি ছিল মূলত ডিএনএ এর গঠন নিয়ে তাত্ত্বিক বিষয়ের উপরে লেখা। বাকী দুইটি তথ্যবহুল নিবন্ধের একটি লিখেন লন্ডনের কিংস কলেজের মরিস উইলকিন্স এবং তাঁর দুইজন সহকারী, অন্যটি লেখেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন এবং পিএচডি গবেষণারত রেমন্ড গোসলিং। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখা নিবন্ধটি ছিল ডিএনএ তে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক বন্ধন থেকে তৈরি বিভিন্ন কোণের জটিল গাণিতিক হিসাব নিকাশ যেগুলো মূলত ফ্রান্সিস ক্রিকের দেয়া ধারণার উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। অনেকেই দাবি করেন যে ওয়াটসন এবং ক্রিক অন্যায় ভাবে ফ্রাঙ্কলিনের আবিষ্কার করা মডেল চুরি করেছিলেন। আসলেই কি তাই? এইসব দাবির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট শুরু হয়ে গেছিল নেচারে ওয়াটসন এবং ক্রিক এর প্রকাশ করা নিবন্ধের সময় থেকেই।
ওয়াটসন ছিলেন তরুণ এবং ডিএনএ এর গঠন আবিষ্কারের নেশায় অনুরুক্ত একজন। ক্রিক ছিলেন মেধাবী, আড্ডাবাজ এবং উইলকিন্স এর একজন কাছের বন্ধু। উইলকিন্স কিছুটা লাজুক স্বভাবের ছিলেন। রোজালিণ্ড ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি প্রক্রিয়ায় একজন বিশেষজ্ঞ গবেষক। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে আসেন। উইলকিন্স ভেবেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর সাথে কাজ করবেন কিন্তু কিংস কলেজের কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ফ্রাঙ্কলিনকে স্বাধীনতা দেন। শুরু থেকেই উইলকিন্স এবং ফ্রাঙ্কলিন এর খুব একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠে নি।
উইলকিন্স ছিলেন শান্ত প্রকৃতির মানুষ এবং তর্কে জড়ানো খুব একটা পছন্দ করতেন না। অপরদিকে ফ্রাঙ্কলিন জোরালো স্বভাবের ছিলেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্ক করতে পছন্দ করতেন। তাঁর বন্ধু নর্মা সাদারল্যান্ড তাঁর ব্যাপারে বলেন, “ ফ্রাঙ্কলিনের আচরণ ছিল কঠোর এবং সর্বদা মুখোমুখি প্রকৃতির। এই স্বভাবের দরুন তাঁর অনেক বিরুদ্ধাচারি তৈরি হয়েছিল”। ডিএনএ এর গঠন উদ্ধারের ব্যাপারে ওয়াটসন এবং ক্রিক এর প্রথম পদক্ষেপ দেখা যায় ১৯৫২ সালে। তখন তাদের দেয়া ডিএনএ এর ত্রিসূত্রক গঠন কিংস কলেজের কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে ফ্রাঙ্কলিন কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়। ফলস্বরূপ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওয়াটসন এবং ক্রিক কে এ বিষয়ে গবেষণা কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয়।
তবে পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে, যুক্তরাজ্যে লিনাস পলিং এর ডিএনএ এর গঠন সংক্রান্ত গবেষণায় কৌতূহল প্রবণতা দেখে কেমব্রিজ কর্তৃপক্ষ পুনরায় ওয়াটসন এবং ক্রিককে তাদের গবেষণা কাজ শুরু করবার অনুমতি দেন। একই বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে, ওয়াটসন কিংস কলেজে আসেন। সেখানে উইলকিন্স ফ্রাঙ্কলিন কে কিছু না জানিয়েই তাকে ডিএনএ এর গঠনের উপর নেয়া একটি এক্স-রে ছবি দেখান। ছবিটি ‘ফটো ৫১ (Photo 51)’ নামে পরিচিত। ছবিটি নিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন এবং তাঁর সহযোগী রেমন্ড গোসলিং। রেমন্ড গোসলিং মূলত উইলকিন্স এর তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন, পরে ফ্রাঙ্কলিন এর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কলিন কিংস কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় গোসলিং পুনরায় উইলকিন্স এর সাথে কাজ শুরু করেন। ওয়াটসন বলেন,
“ফটো ৫১ ছিল তখন পর্যন্ত তাঁর দেখা ডিএনএ মডেলের নেয়া সবচাইতে পরিষ্কার ছবি। ছবিটি দেখার সাথে সাথে তাঁর হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করে। তাঁর মতে, ফটো ৫১ ডিএনএ এর দ্বিসুত্রাকার গঠন সম্বন্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়”।
কিন্তু তখনও ডিএনএ এর সুত্রকের গঠন এবং রাসায়নিক উপাদান গুলো সুত্রকে কিভাবে অবস্থান করে তা অজানা রয়ে গিয়েছিল। এসব জানতে হলে ওয়াটসন এবং ক্রিক এর দরকার ছিল ডিএনএ এর গঠনের উপর আরও গভীরে পর্যবেক্ষণ এবং আরও তথ্য। এইসব কিছুই ফ্রাঙ্কলিন আগেই আবিষ্কার করে রেখেছিলেন যা পরবর্তীতে একটা সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ আকারে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্স পেরুটজ এর হাতে পৌঁছায়। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে পেরুটজ নিবন্ধটি কেমব্রিজ এর কর্তৃপক্ষের কাছে দেন এবং সবশেষে সেটি ওয়াটসন এবং ক্রিক এর হাতে পৌঁছায়। ক্রিকের কাছে এখন সবরকম হিসাব নিকাশ করার জন্যে দরকারি তথ্য হাজির। ফ্রাঙ্কলিনের দেয়া সেসব তথ্যকে ব্যবহার করে ক্রিক বের করে ফেললেন ডিএনএ তে থাকা রিপিটিটিভ ক্ষার সিকোয়েন্স গুলোর মধ্যবর্তী দুরত্ব এবং বলেন যে ডিএনএ তে থাকা দুইটা সুতা পরস্পরের বিপরীত ডিরেকশনে অবস্থান করে।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে কেমব্রিজ কর্তৃপক্ষ অনৈতিক ভাবে ফ্রাঙ্কলিন এর তথ্য হাতে পেয়েছিল এবং তারা এগুলো দিয়ে কি করছে সেটাও কিংস কলেজের কাউকে জানায় নি। এমনকি তারা ফ্রাঙ্কলিন থেকে অনুমতি পর্যন্ত নেন নি তাঁর ডাটা ব্যবহার করবার ক্ষেত্রে। যখন ওয়াটসন এবং ক্রিক কেমব্রিজে পাছে পাউলিং তাদের আগে সফলতা পেয়ে যান সেই ভয়ে বিরতিহীন ভাবে ডিএনএ এর গঠন আবিষ্কারে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তখন ফ্রাঙ্কলিন এই বিষয়ে তাঁর গবেষণা সমাপ্তি করে ফেলেন। কোনরকম অন্য কারোর সহায়তা ছাড়া একা তিনি যতটুকু পৌঁছাতে পেরেছিলেন তা ছিল সন্দেহাতীত ভাবে অসাধারণ। প্রথমদিকে তাঁর কাছে এ বিষয়ে জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার গুলো কঠিন লেগেছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি বোঝতে পারেন, ডিএনএ এর গঠন দ্বিসূত্রাকার এবং এর মধ্যে নিউক্লিয়টাইডস ক্ষার গুলো এমনভাবে অবস্থান করে যে সূত্রক গুলো পরস্পরের পরিপূরক। তিনি তাঁর নোটে উল্লেখ করেন, ডিএনএ তে থাকা নিউক্লিয়টাইডস বেস সিকোয়েন্স গুলোই প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের নির্দিষ্টতা রক্ষায় দায়ী। তাঁর এই নোটস ডিএনএ বেস সিকোয়েন্সে জেনেটিক কোড এর উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
তাঁর এই মতামতের প্রমাণ করার জন্যে রাসায়নিক এবং গাণিতিক ভাবে আরও যথার্থ পর্যবেক্ষণ দরকার ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি এই সুযোগ পান নাই কারণ ওয়াটসন এবং ক্রিক ইতোমধ্যেই নাটকের শেষটা লিখে ফেলেছিলেন তাঁরই বের করা তথ্যের উপর ভিত্তি করে। তাঁরা দুজন ডিএনএ এর দ্বিসূত্রক গঠনের যাবতীয় বিন্যাস, রাসায়নিক উপাদান গুলোর অবস্থান, রাসায়নিক বন্ধন এর দুরত্ব, কৌণিক মান, সূত্রকের ব্যাস এসব কিছুই মডেল আকারে দাঁড় করান। অবশেষে ডিএনএ এর বিখ্যাত দ্বিসূত্রাকার মডেল জিম ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক এর নামেই প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ফ্রাঙ্কলিন এবং উইলকিন্স এর নামে ওয়াটসন এবং ক্রিক এর মডেল আবিষ্কার করতে সাহায্যকারী তথ্য গুলো প্রকাশিত হয়।
ফ্রাঙ্কলিন ১৯৫৮ সালে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মারা যান। এর চার বছর পরে ১৯৬২ সালে ওয়াটসন, ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্স ডিএনএ এর দ্বিসূত্রাকার মডেল প্রদানের জন্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। হয়ত বেঁচে থাকলে ফ্রাঙ্কলিনকেও পুরস্কৃত করে ধন্য হতো নোবেল কমিটি। তবে ওয়াটসন এবং ক্রিক কে নিয়ে প্রচলিত ধারণা গুলো এক একটা মিথ বলেই প্রমাণিত হয় যদিও ওয়াটসন এবং ক্রিক ফ্রাঙ্কলিন এর অনুমতি নিয়ে তাঁর তথ্য ব্যবহার করার উচিত ছিল। ঠিক যেমনটা উইলকিন্স এর উচিত হয় নি ফ্রাঙ্কলিন কে অবগত না করে তাঁর নেয়া ফটো ৫১ ওয়াটসন কে দেখানো। ফ্রাঙ্কলিন এ ব্যাপারে পরে আর কখনোই অবগত হন নি।
তথ্যসুত্রঃ Sexism in science: did Watson and Crick really steal Rosalind Franklin’s data?
Leave a Reply