পিথাগোরাসের পর্ব:
পিথাগোরাস কে??
বিজ্ঞানের ছাত্র অথচ পাশ করবার জন্য পিথাগোরাসের উপপাদ্য গেলেনি এমনটি হয়ত দুরবিনেও ধরা পড়বে না। পিথাগোরাসকে বলা যেতে পারে গণিত শাস্ত্রের আদি পুরুষ। তিনি একাধারে গণিতজ্ঞ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্কের পশ্চিমে ইজিয়ান সাগরের সামোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন।
ধারণা করা হয় শৈশবে জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদে মিশর সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন । এই মিশরে এসে প্রধানত তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের দীক্ষা লাভ করেন। মিশরে অবস্থানের সময় পিরামিড দর্শন করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। বিশাল বিশাল পিরামিড নির্মাণের সময় যে গাণিতিক নিয়ম অনুসারে পাথরগুলিকে সাজানো হয়েছিল তা তাকে প্রবল ভাবে তাড়িত করে। সম্ভবত এখান থেকেই তাঁর মনে প্রথম জ্যামিতি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা জেগে উঠে। বিভিন্ন সংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই পিথাগোরাসের উপপাদ্য।
“পিথাগোরাসের উপপাদ্য”
এই উপপাদ্য টি গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাসের নামানুসারে করা হয়েছে, যাকে ঐতিহ্যগতভাবে এই উপপাদ্যসমূহের আবিষ্কারক ও প্রমাণকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে উপপাদ্যটির ধারণা তার সময়ের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। চীনে এই উপপাদ্যটি “গোউযু থিউরেম” (勾股定理) হিসেবে প্রচলিত। আমরা আরও দেখব এটা পিথাগোরাসেরও প্রায় ১০০০ বছর আগে ব্যাবিলনে একই ধরণের জ্যামিতি ব্যবহার হত।
পিথাগোরাসের উপপাদ্য বা পিথাগোরিয়ান থিউরেম হল ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অন্তর্ভুক্ত সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু সম্পর্কিত একটি সম্পর্ক।
যেটাকে সহজভাবে বলা হয়েছে, কোন একটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ঐ ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের যোগফলের সমান। যদি আমরা c কে অতিভুজ এবং a ও b কে অপর দুই বাহুর দৈর্ঘ্য ধরি, তাহলে সমীকরণের সাহায্যে উপপাদ্যটি হবে,
a² + b² = c²
এই সূত্রটি আমরা ছোট বেলায় আউড়েছি
ব্যাবলনীয় ট্যাবলেট:
এখানে আমাদের পরিচয় হবে প্রাচীন ব্যাবলনের দুইটি চিনা মাটির তৈরি ট্যাবলেট এর সাথে, এদেরকে উদ্ধার করা হয়েছে বর্তমান ইরাক থেকে। এনাদের একজনের নাম Plimpton 322.
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের G.A. Plimpton Collection এ ৩২২ নাম্বার তাকের শোভা বাড়াচ্ছে এই ট্যাবলেট টি। ধারণা করা হয় ১৮00 খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত এটি। এই ট্যাবলেটটিতে চারটি কলাম আর ১৫ টি সারির একটি টেবিল আছে যা সেই সময় কালের কিউনি ফর্ম লিপিতে লেখা।
আরেকজনের নাম si 429 .এটিও প্রাচীন চিনা মাটির তৈরি ।
এই ট্যাবলেটটি ১৮৯৪ সালে ইরাকের সিপ্পারে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান সময় অন্যান্য অনেক ট্যাবলেটের সাথে আবিষ্কৃত হয় এবং ইস্তাম্বুলের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের কোন এক কোণে বিস্মৃতির আড়ালে পড়ে ছিল এতদিন।
তখন কে বা জানত এরাই ইতিহাসের হরফ উলটে দিতে সক্ষম!
পিথাগোরিয়ান-ত্রয়ী নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা
এবার আসি আমাদের মূল আলোচনায়। তার জন্য পরিচয় হতে হবে ড. ড্যানিয়েল ম্যান্সফিল্ডের সাথে। যিনি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের একজন গণিতবিদ। অস্ট্রেলিয়ার হাই স্কুলের ম্যাথ টিচার দের জন্য তিনি একটি কোর্স তৈরি করছিলেন এমন সময় তিনি P322 এর একটি ছবি খুঁজে পান। সেটাও ২০১৭ সালের কথা।
এর আগে ১৯৪০ এর দশকে এটি সর্ব প্রথম গবেষকদের নজরে আসে। তারা এর কলাম আর সারি গুলোতে কিউনিফরম লিপিতে লেখা সংখ্যাগুলো দেখে ধারণা সেগুলো পিথাগোরাসের ত্রয়ী সংখ্যার মত মনে হচ্ছে। এই ত্রয়ী সংখ্যা একটা সমকোণের তিনিটি বাহুর দৈর্ঘ্যকে নির্দেশ করে।
ড. ড্যানিয়েল ম্যান্সফিল্ডে এই ট্যাবলেট নিয়ে পড়াশোনা করে বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাবিলনবাসীরা যেই ত্রিকোণ মিতি ব্যবহার করত সেটা কোণ বা বৃত্তের উপর ভিত্তি করে না বরং সংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে। তারা ত্রিকোণমিতিকে প্রকাশ করত সমকোণের তিনটি বাহুর অনুপাত হিসেবে। এ এক নতুন ধরণের ত্রিকোণমিতি, গ্রিকদের ত্রিকোণমিতি থেকে আরও সরল। এই অনুপাত sexagesima বা ৬০ ভিত্তিক। তার মতে আমরা ত্রিকোণমিতি চিন্তা করলেই sines বা cosines এর কথা চিন্তা করি। কিন্তু ব্যাবিলনের এই ত্রিকোণমিতি বুঝতে আমাদের এই প্রথা থেকে বের হয়ে আরও সরল ভাবে চিন্তা করতে হবে।
২০১৭ সালে তা গবেষণা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন ব্যাবলনীয়রা গ্রীকদের থেকেও প্রায় ১৫০০ বছর আগে ত্রিকোণমিতি আবিষ্কার করেন এবং এই সংক্রান্ত তার গবেষণাপত্র Historia Mathematica তে প্রকাশিত হয়। তবে P322 এ যা ছিল সেটা শুধুই সারিবদ্ধ সংখ্যা। এই ত্রিকোণমিতি ব্যাবিলনে কেনই আবিষ্কার হল বা কোথায় বা ব্যবহার হত সে সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। ড. ম্যান্সফিল্ড বুঝতে পেরেছিলেন এই রহস্যের সমাধান করার জন্য যেই চাবি দরকার তা P322 এ নেই। এজন্য তার খোঁজাখুঁজি আরও চলতে থাকে।
এর কিছু দিন পরে ইস্তাম্বুল আর্কিওলোজিকাল মিউজিয়ামে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা আরেকটি ট্যাবলেট si 429 এর ছবি তার নজরে আসে। ম্যানসফিল্ড ঠিক যেমন টা খুঁজছিলেন তেমন টাই যেন বিধাতা তাকে পাইয়ে দিল। ছবিতে পারফেক্ট সমকোণ গুলোর যেন তাকে কিছু বলবার আছে। তিন বছর পরে ম্যান্সফিল্ড রহস্যের সমাধান করলেন। বেরলো তার আরেকটি গবেষণাপত্র।
আজ থেকে প্রায় ৩৭০০ বছর আগে পুরাতন ব্যাবিলনীয় যুগের প্রাচীনতম জ্যামিতি। গ্রীকদেরও প্রায় ১০০০ বছর আগেকার কথা হচ্ছে। প্রাচীনযুগে তারা এই ত্রিকোণমিতির ধারণা ব্যবহার করে জমি জরিপ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করত এই si 429 থেকে তা অনেকটাই পরিষ্কার । ধারণা করা হয় যে তারা ইমারত নির্মাণ, জমি জরিপ বা সীমানা নির্ধারণ করার জন্য তাদের সরলতম ত্রিকোণমিতিকে ব্যবহার করেছিল।
একজন ভূমি জরিপকারীকে জমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিমাপ করতে হবে ,সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এবং তা করার জন্য তারা “পিথাগোরীয় ত্রয়ী সংখ্যা” ব্যবহার করেছে। এবং পারফেক্ট সমকোণ তৈরি করেছে। পিথাগোরীয় ত্রয়ী সংখ্যা হল তিনটি পূর্ণসংখ্যা যারা একটা সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু নির্দেশ করে। যেমন ৩,৪ এবং ৫।
ড. ম্যান্সফিল্ড বলেন এরকম আরও কয়েক হাজার ট্যাবলেট আছে যাতে জমির পরিমাণ এবং মালিকানা সম্পর্কে নানা বর্ণনা পাওয়া যায়।
তাহলে পিথাগোরাস কি ব্যাবিলনীয়দের কপি করেছেন? উমম, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার এখনও সময় হয়নি। দেখা যাক ইতিহাস কি বলে?
হয়ত পোস্টকার্ড সাইজের এই ট্যাবলেট Plimpton 322 ইতিহাসের বই নতুন করে লিখতে পারে।
আমরা তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে।।
Leave a Reply