এই পৃথিবীর বয়স কত? প্রশ্নটি কখনো আপনাদের মনে আসে নি? আচ্ছা কোন সমস্যা নেই, আমিই না হয় বলে দেই। আমাদের এই বাসভূমির বয়স প্রায় ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর! অনেকটা সময়, তাইনা?
আজ আমরা পৃথিবীতে যে সব প্রাণীদের দেখছি,তারাই কি এই আদিযুগ থেকে ছিল? নাকি তারা বিভিন্ন আদিম প্রাণীদের বিবর্তিত রূপ?
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত বিরতিতেই এসব আদিম দানবদের ফসিল আবিস্কার করে চলেছেন। তাদের ভেতর ডাইনোসর, আতিকায় ম্যামথ, বিশালাকৃতির সরীসৃপ সহ নানা ধরনের প্রাণীর ফসিল রয়েছে।
সম্প্রতি ২০২১ সালে একটি নতুন প্রজাতির তিমি আবিষ্কৃত হয়েছে। মিসরের বিজ্ঞানীরা এই ফসিলটি আবিষ্কারটি করেছেন । তাদের দাবি, প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াতো এসব চার পায়ের তিমিরা।
জী,আপনি ঠিকই শুনেছেন,আমি এইমাত্র এক আদিম প্রজাতির চারপেয়ে তিমির কথাই আপনার সামনে বলেছি!
উভচর এ তিমির কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে মিসরের পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমিতে। তবে তিমিটি বিলুপ্ত প্রোটোসেটিডির প্রজাতির বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাচীন মিসরের মৃত্যুর দেবতা অ্যানুবিসের সঙ্গে এ তিমির মাথার খুলির অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে । যে কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে ফিওমিসেটাস অ্যানুবিস। এর আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৩ মিটার এবং ওজন ছিলো প্রায় ৬০০ কেজি! আকারে তিনি বর্তমান সময়ের কিলার হোয়েলের সমকক্ষ হবেন।
তিমিটি সম্ভবত ধূর্ত শিকারি ছিল বলে ধারণা গবেষকদের। আধুনিক তিমির পূর্বপুরুষরা হরিণের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছিল, যারা প্রায় ১ কোটি বছর ধরে মাটিতে বসবাস করেছে।
প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শক্ত চোয়ালের ফিওমিসেটাস অ্যানুবিস ভূমিতে হাঁটতে এবং পানিতে সাঁতার কাটতে পারতো। এর কঙ্কালের বিভিন্ন অংশ মিসরের ফায়ুম খাদে পাওয়া গেছে।
গবেষক মোহাম্মদ সামেহ, আবদুল্লাহ গোহার এবং হাশেম সালাম এই নতুন প্রজাতির তিমি আবিস্কারের খবরটি তাদের গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেন।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মনসৌরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এলাকাটি এখন মরুভূমি হলেও একসময় সেখানে সমুদ্র ছিলো। বর্তমানে মিশরের এই অঞ্চলটি সামুদ্রিক জীবাশ্মের একটি সমৃদ্ধ উৎস।
একইভাবে, এর কিছুদিন আগেই পেরুতে প্রায় ৪৩ মিলিয়ন বছরের পুরনো আরেকটি চারপেয়ে তিমির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাদের পা ছিল অনেকটা হাসের পায়ের মত।
প্যালিয়েন্টোলজিস্টদের মতে প্রায় ১৩ ফুট লম্বা এই দানব একই সাথে পানি এবং ভূমিতে সমান ভাবে বিচরণ করতে পারত। তার চারটি পা এবং শক্তিশালী লেজ বেশ ভালভাবেই শরীরের ওজন বহন করতে সক্ষম। এই আধা জলজ তিমির প্রজাতির শারীরিক গঠনকে আমরা বর্তমান সময়ের ওটার বা বিভারের সাথে তুলনা করতে পারি।
তিমি বিবর্তনের ধারায় কিভাবে চারপেয়ে থেকে বর্তমান অবস্থায় এসেছে, সে বিষয়ে এই ফসিলগুলো আমাদের নতুন পথ দেখাবে।
ড. অলিভার ল্যামবার্ট, রয়্যাল বেলজিয়ান ইন্সটিটিউট অব ন্যাচারাল সাইন্সের একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তিমির নানা প্রজাতির বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, ভারত এবং পাকিস্তানের বাইরে সম্ভবত এটিই চারপেয়ে তিমির পূর্নাঙ্গ ফসিল। পেরুর সমুদ্র উপকূলের প্রায় এক কিলোমিটারের ভেতর মেরিন সেডিমেন্টের তলদেশে এর অস্তিত্ব আবিস্কৃত হয়। স্থানটির প্রকৃতি দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর আগে তিমির বিবর্তন শুরু হয়।
ধীরে ধীরে তাদের শরীর পানিতে চলবার জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে। পরবর্তী ৮ মিলিয়ন বছরের ভেতর তারা ডাঙার মায়া কাটিয়ে উঠতে শুরু করে। পরে তারা উত্তর আমেরিকা এবং উত্তর আফ্রিকার দিকে দল বেঁধে যাত্রা শুরু করে। মূলত এসব জায়গাতেই এখন তাদের ফসিল পাওয়া গিয়েছে।
তবে পেরুতে এই তিমির ফসিল পাওয়া যাওয়ার কোন অর্থ কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? তারমানে তারা যাত্রার এক পর্যায়ে দক্ষিণ আমেরিকার সাগরেও চলে এসেছিল।
বিজ্ঞানীরা এই নতুন প্রজাতির তিমির নাম দিয়েছেন পেরিগোসেটাস প্যাসিফিকাস। যার অর্থ সমুদ্র ভ্রমণকারী তিমি,যে কিনা প্যাসিফিক বা প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।
দেখা যাচ্ছে আজকের তিমিদের পূর্বপুরুষেরা ছিল শক্তিশালী চোয়াল যুক্ত চারপেয়ে মাংসাশী প্রাণী, যারা একই সাথে জলে এবং স্থলে শিকার করতে সক্ষম ছিল।
ভারত, পাকিস্তান, পেরু, মিশর সহ অনেক দেশেই ডুরেডন, অ্যাম্বুলিসিটাস, পাকিসিটাস প্রজাতির তিমির নিকট আত্মীয়দের ফসিলের দেখা মিলেছে। সামনের দিনগুলোতে আমরা তিমি এবং এর সমগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণীদের বংশগতি এবং বিবর্তনের ধারা সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য জানতে পারব।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply