আমরা এখন তথ্য প্রযুক্তির উত্থানের যুগে বাস করছি। যার পতন হয়ত আর কোনো কালেই হবে না। বৈপ্লবিক এই পরিবর্তনের ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে তার আকাঙ্ক্ষিত জীবনের দিকে। পৃথিবী এখন প্রযুক্তিনির্ভর এবং এই নির্ভরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রযুক্তির নানা প্রক্রিয়া ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করাই যেন মূখ্য। অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রতিযোগিতা এখন সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
গত দুই দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন মানুষকে নেটওয়ার্কের জালে বন্দি করেছে। বিচ্ছিন্ন পৃথিবীকে বেঁধে ফেলেছে অদৃশ্য সূঁতোয়। মাত্র দুই যুগ আগেও মানুষ যেসব ভেবে ভেবে কল্পনায় তাড়িত হত, সেসব-ই এখন বাস্তবতায় প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই ক্রমবর্ধমান বিবর্তনে আমরা এখন বাস করছি তথ্য প্রযুক্তির ধাপে।
বলা হয়ে থাকে- ভবিষ্যৎ পৃথিবী কেবলই তথ্য নির্ভর; তথ্যের আদান-প্রদান, প্রয়োগ কৌশল ও সার্বিক কর্মযজ্ঞের উন্নতিতে যে বা যাঁরাই এগিয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে তাঁরাই নেতৃত্ব দেবে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উত্থানের সাথে অন্তর্জালের ব্যবহার প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ইতোমধ্যে পৃথিবী এখন পঞ্চম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পা দিয়েছে। অনাগত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে প্রজন্মভিত্তিক এই ইন্টারনেট প্রযুক্তিই নেতৃত্ব দিবে। যার কেন্দ্রে রয়েছে মোবাইল কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। তথ্য প্রযুক্তি খুব সহজে প্রায়োগিক করতে মোবাইলকে কেন্দ্র করে এই প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার ব্যাপক বিস্তার হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ এবং নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির বিবর্তন এখন মানবজাতির বিকাশে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে মানব বিকাশের পাশাপাশি ডিজিটালাইজড ডিভাইস এবং পরিষেবাগুলির ক্রমবর্ধমান উন্নতি আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। গড়ে উঠছে শিল্প কলকারখানা, প্রয়োগ ও রক্ষনাবেক্ষণের জন্য হাজারো প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বিস্তার ঘটছে দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসংস্থানের।
টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
টেলিযোগাযোগের জন্য তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজে গড়ে ওঠেনি। ১৯৮০ সালে প্রথম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর থেকে গত কয়েকবছর ধরে চতুর্থ প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। ৪ জি নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন বাজারে পাওয়া গেলেও ইতোমধ্যে অধিকাংশ মোবাইল প্রস্তুকারক প্রতিষ্ঠান তাদের পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ফোন বাজারে এনেছে। বাংলাদেশে এখনও পঞ্চম প্রযুক্তির তারবিহীন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তবে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশও এই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে বলে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
আমরা যে এক জায়গা থেকে অন্যত্র খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারছি এই দূর যোগাযোগের সূচনা হয়েছিলো আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের হাত ধরে। ১৮৭৬ সালের ১০ মার্চ তিনিই পৃথিবীতে প্রথম তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার উদ্ভব ঘটান। তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ (ইলেকট্রম্যাগনেটিক ওয়েব) ব্যবহার করে মানুষের মুখের কথাকে এক জায়াগা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করার জন্য প্রেরন ও গ্রহণ যন্ত্রের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের সূচনা করেন। মাত্র ৬ মাইল দূরত্বে প্রেরিত সেদিনকার তথ্যের এই আদান প্রদানই পৃথিবীর প্রথম টেলিফোন কল হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতে আন্তঃশহর টেলিফোন সেবা চালু হলেও খুব দূরে এই সেবা কার্যকর ছিলনা। বানিজ্যিকরণ না হওয়ার ফলে খুব একটা সফলতা তখন দেখা যায়নি। এর দীর্ঘ সময় পর ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এখনকার মোবাইলের প্রাথমিক সূচনা হয়েছিলো।
০ জি বা 0G কি
তারের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার পদার্পনের সাথেই মূলত এই প্রজন্মভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা হয়। পরবর্তীতে রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ১৯৪৬ সালে মটোরোলা ও বেল কোম্পানি প্রথম বানিজ্যিক মোবাইল ফোন সার্ভিস এমটিএস বা মোবাইল টেলিফোন সিস্টেম সেবা দেওয়া শুরু করে। আজকাল খুব ছোট্ট একটা মোবাইল ডিভাইসের পরিবর্তে মানুষ তখন ব্রিফকেস ভরতি মোবাইল রেডিও টেলিফোন সিস্টেম ব্যবহার করতো। এগুলোর ট্রান্সমিটার ও রিসিভার ভারী হওয়াতে(প্রায় ৩০ কেজি) সিস্টেমের ট্রান্সরিসিভার গাড়ির সাথে ইনস্টল করা থাকতো। গ্রাহককে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেই তথ্য আদান প্রদান করতে হতো। সেলুলার টেলিফোনের প্রথম প্রজন্মের পূর্বসূরী হওয়ায় এই সিস্টেমগুলিকে 0 জি (জিরো জেনারেশন) সিস্টেম বলা হয়। প্রাক-প্রাথমিক এই মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থায় পুশ টু টক(পিটিটি), ইমপ্রুভড মোবাইল টেলিফোন সিস্টেম(আইএমটিস) ও অ্যাডভান্সড মোবাইল টেলিফোন সিস্টেম(এএমটিএস) ব্যবহার করা হয়। প্রথম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার আগ পর্যন্ত এসব ব্যবস্থা ব্যবহার করেই মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতো ।
১ জি বা 1G কি
০ জি কে প্রজন্মভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পূর্ব প্রস্তুতি বলা হয়। মূলত প্রজন্মভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ হলো ১ জি। ১৯৮০ সালে 0 জি এর মতোই অ্যানালগ রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করে ১ জি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা তার পূববর্তীর থেকে বেশি কিছু সুবিধা নিয়ে আসে এবং এখন পর্যন্ত সবথেকে বেশি সময় ধরে গ্রাহকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। ১জি ব্যবহারের সময়ে তখনকার এই সিস্টেমকে ১জি হিসেবে নামকরণ করা হয়নি। ২জি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার পরেই এই নামকরণ করা হয়। প্রযুক্তিগত মান অনুসারে মোবাইল নেটওয়ার্কের এটি মূলত ২ জি অপেক্ষা প্রাচীন ছিলো বলেই ০ জি ও ১জি’র এই নামকরণ।
১৯৭৯ সালে নিপ্পন টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন(এনটিটি) কোম্পানি জাপানের টোকিও শহরে বানিজ্যিকভাবে প্রথম স্বয়ংক্রিয় সেলুলার নেটওয়ার্ক চালু করে এবং মটরোলা তখন ১জি প্রযুক্তিসম্পন্ন মোবাইল বাজারে আনে। এই মোবাইলের বিশেষত্ব হলো মোবাইল রেডিও টেলিফোনের মতো ভারী ট্রান্স-রিসিভার ব্যবহার করতে হত না। ফলে সহজেই বহন করা যেত। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই জাপানের সর্বত্র এই যোগাযোগ ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে এবং জাপান-ই প্রথম জাতি যাঁরা পুরোপুরিভাবে প্রথম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে।
জাপানে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ১৯৮১ সালে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক সহ উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতেও ১ জি চালু হয়। পরবর্তীতে রাশিয়া ও নর্ডিক(উত্তর ইউরোপ) দেশগুলো মিলে ১ জি নেটওয়ার্কের নতুন আদর্শিক ব্যবস্থা নর্ডিক মোবাইল টেলিফোন (এনএমটি) চালু করে। এছাড়াও আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডভান্সড মোবাইল ফোন সিস্টেম(এএমপিএস), ইংল্যান্ডে টোটাল অ্যাকসেস কমিউনিকেশন সিস্টেমস(টিএসিএ) ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশগুলোতেই যোগাযোগের এই আদর্শিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে প্রথম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়।
১ জি ব্যবহারের প্রধান সুবিধা ছিলো ফোন কলের মাধ্যমে মানুষের ভয়েস তথ্যকে স্থানান্তরিত করা। সিম বিহীন ফোনগুলোতে ডাটা ট্রান্সমিশন রেট ছিলো সেকেন্ডে মাত্র ৩-৪ কিলোবাইট। অ্যানালগ সিগন্যাল ও কম ব্যান্ডউইথের কারণে বেশি দূর অব্দি ডাটা ট্রান্সমিশন সম্ভব হত না। তখনকার ব্যবহৃত সেলুলার ফোনগুলোও অপেক্ষাকৃত সাইজে বড় হওয়ার কারনে বহন করা ছিল অসুবিধার। কম ডাটা ট্রান্সমিশনের কারণে কিছু দূরত্বেই ভয়েস ভেঙে ভেঙে যেত। নির্দিষ্ট সক্ষমতার বাইরে কথা বলা অনেকটা দূরহ ছিলো। তথ্যের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা গুলোও ছিলো ব্যাপক। নানাবিধ সমস্যার কারণে প্রথম প্রজন্মের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা প্রয়োজনীয় হলেও মানুষের চাহিদার জন্য এটি যথেষ্ট ছিলো না।
২ জি বা 2G কি
প্রথম প্রজন্মের নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে ফিনল্যান্ডে প্রথম বানিজ্যিকভাবে দ্বিতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা ২ জি চালু হয়। ফিনল্যান্ডের জিএসএম অপারেটর রেডিওলিনজা কোম্পানির হাত ধরে এর সূচনা হয়। ১ জি’র অ্যানালগ সিগনাল ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা থেকে ডিজিটাল সিগনাল ট্রান্সিমিশনে উন্নতি ঘটিয়ে তারবিহীন সেলুলার যোগাযোগ পদ্ধতি গ্রোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস(জিএসএম) ব্যবস্থা ব্যবহার করে ২ জি চালু হয়। জিএসএম পদ্ধতিতেই প্রথম সিম কার্ড ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা এই জিএসএম পদ্ধতিতেই চলমান রয়েছে। তারবিহীন জিএসএম নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য টাইম ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস(টিডিএমএ) ও কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস(সিডিএমএ) ভিত্তিক এই দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলো সুবিধা ছিলো একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ ব্যবহার করে একসঙ্গে একাধিক কলের সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। সারাবিশ্বের প্রায় শতভাগ মানুষ এই দুই পদ্ধতি ব্যবহার করে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সবথেকে বড় সুবিধা ছিলো অডিও কলের পাশাপাশি এতে লিখিত বার্তা(এসএমএস) ও মাল্টিমিডিয়া বার্তা(এমএমএস) আদানপ্রদান করা যেত। এছাড়াও পূর্বের থেকে উন্নত মান সম্পন্ন ফোন কল, উন্নত নেটওয়ার্ক কানেকশন, অপেক্ষাকৃত অনেক ছোটো ডিভাইস সহ গ্রাহকদের তথ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ইতিপূবে মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্ত না হলেও ২জি চালু হওয়ার পর নানা সুযোগ সুবিধার জন্য মানুষ এটাকে অত্যাবশাকীয় হিসেবে মনে করে। তখন থেকেই ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল প্রস্তুকারক ও মোবাইল সম্পর্কীত যাবতীয় শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এসব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এনহ্যান্সড ডাটা রেটস ফর জিএসএম ইভোলিউশন(EDGE) ও জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস(GPRS) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবার তথ্য স্থানান্তর গতি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। যেগুলো পরবর্তী প্রজন্মের ২.৫ জি ও ২.৭৫ জি হিসেবে ইন্টারনেট সেবায় ব্যবহার করা হত।
নানা সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি বেশ কিছু সমস্যাও ছিলো এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার। নেটওয়ার্ক কাভারেজ কম হওয়ার পাশাপাশি এখনকার থেকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল সিগনাল ব্যবহৃত হত। মাল্টিমিডিয়া ভিডিও সেবাও তখনও পাওয়া সম্ভব ছিলো না। ছোটোখাটো সমস্যা ব্যতীত দ্বিতীয় প্রজন্মের তারবিহীন এই যোগাযোগ ব্যবস্তা নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
৩ জি বা 3G কি
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের মাধ্যমে আশির দশকে প্রথম ৩ জি যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্ভাবন হয়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী গবেষণার পর ১৯৯৮ সালে জাপানে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ৩ জি চালু করা হয়। তিন বছর পরীক্ষা চালানোর পরেও এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বান্যিজ্যিক ভাবে চালু করার সুযোগ হয়নি। প্রচলিত ২ জি ব্যবস্থাপনার নানাবিধ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কারণে ৩ জি চালু হওয়া অনেকটা বাধার সম্মুখীন হয়।
২০০১ সালের অক্টোবরে প্রথম জাপানে এনটিটি ডোকোমো কোম্পানির হাত ধরে ৩ জি বানিজ্যিকভাবে চালু হয়। একইসাথে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় চালু হয়। জাপান ও কোরিয়ায় মূলতো সিডিএমএ আদর্শে তৃতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থাপর প্রসার ঘটতে থাকে। পাশাপাশি ইউনিভার্সেল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম(UMTS) আদর্শে ইউরোপে প্রথম ৩ জি চালু করে টেলিনর ও ২০০২ সালে পুরোপুরিভাবে আমেরিকায় সিডিএমএ ২০০০ আদর্শে ৩জি চালু হয়।
৩জি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় ডাটা ট্রান্সমিশন রেট তার পূর্ববর্তী ২জি’র থেকে প্রায় চারগুন বেড়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ডাটা ট্রান্সমিশন রেট সেকেন্ডে ২০০ কিলোবাইট হারে হলেও পরবর্তীতে তা প্রায় সেকেন্ডে ৭ এমবিতে উন্নতি ঘটে।
ডাটা ট্রান্সমিশনের এমন উন্নতির ফলে মোবাইল নেটওয়াকিং ব্যবস্থাপনার অনেকটা বিপ্লব ঘটে। পাশাপাশি মোবাইলের ধরণেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সারাবিশ্ব তখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্টফোনের সাথে পরিচিত হয়। যা তখন অবদি অনেকটা অবিশ্বাস্য ছিলো। মেসেজ ও ফোন কলের পাশাপাশি ভিডিও কল, ইমেইলিং, ওয়েব ব্রাউজিং, লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মতো সেবাগুলো তখন থেকেই শুরু হয়। ইন্টারনেট সেবায় ডাটা ট্রান্সিমিশন বাড়ার ফলে গ্রাহকদের কাছে ৩ জি ও ৩জি সম্বলিত মোবাইল হ্যান্ডসেটের চাহিদা বাড়তে থাকে।
এত সুযোগ সুবিধার পরেও সারাবিশ্বের গ্রাহকদের কাছে ৩জি পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। পূর্ববতী ২ জি থেকে ৩জি তে রূপান্তরের জন্য অপেক্ষাকৃত অধিক ফ্রিকুয়েন্সি ব্যান্ডের জন্য যন্ত্রপাতি, টাওয়ার ব্যবস্থাপনা সহ নতুন ব্যান্ডের জন্য লাইসেন্সের দরকার হয় এবং নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজাতে হয়। যা অনেকটা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ ছিলো। যার কারণে অধিকাংশ দেশ এই ব্যবস্থাপনায় তখনো আগ্রহ দেখায়নি।
স্মার্টফোনের অভাবনীয় উন্নতের ফলে মানুষ তৃতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পার্সোনাল ডিজিটাল অ্যাসিসট্যান্ট(পিডিএ) সম্বলিত মোবাইলগুলোতে তখন ম্যাপ দেখা, ব্রাউজিং করা ও গেইম খেলার মতো সুযোগগুলো যোগ হতে থাকে। যার জন্য দ্রুতগতির নেটওয়ার্ক অত্যাবশাকীয় হয়ে পড়ে। ৩জি আবির্ভাবের দীর্ঘ সময় পরে বাংলাদেশ প্রথম ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় পদার্পন করে।
পরবর্তীতে ডব্লিউ-সিডিএমএ’র থেকে অপেক্ষাকৃত ডাটা ট্রান্সমিশন রেট বেশি সমৃদ্ধ হাই স্পিড প্যাকেট অ্যাকসেস(HSPA) ও HSPA+ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। স্মার্টফোনের স্ক্রীনের উপরিভাগে আমরা যে H ও H+ চিহ্নিত অংশ দেখি তা এই আদর্শিক ব্যান্ডগুলোরই চিহ্ন বিশেষ। এগুলো মূলতো ৩.৫ জি ও ৩.৭৫ জি নামে পরিচিত। যেখানে ডাটা সিডিএমএ’র থেকে চারগুন দ্রুত গতিতে ট্রান্সমিশন করা যেত। যার ফলে ডাটা ট্রান্সমিশন রেট আপলিঙ্কের ক্ষেত্রে সেকেন্ডে ৪২ এমবি ও ডাউনলিঙ্কের ক্ষেত্রে তা ২২ এমবিপিএস পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হয়।
৪ জি বা 4G ও 4G LTE কি
স্মার্টফোনের প্রযুক্তিগত দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে ৩ জি নেটওয়ার্কের ডাটা ট্রান্সমিশন রেট অপ্রতুল হয়ে ওঠে। দরকার হয়, কম সময়ে আরো বেশি তথ্য স্থানান্তরযোগ্য এমন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার। সময়ের সাথে প্রযুক্তিগত চাহিদার অন্যতম প্রতিফলন হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
২০০০ সালে প্রথম ৪জি নেটওয়ার্ক নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার এসব পরিবর্তনকে বিপ্লবের পরিবর্তে বিবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করে। সচল নেটওয়ার্কের থেকে অপেক্ষাকৃত টেকসই, অধিক ডাটা ট্রান্সমিশন রেট ও গ্রাহকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পরবর্তী প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর চিন্তা থেকে ২০০৮ সালের মার্চে চতুর্থ প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার রূপরেখা প্রবর্তন করে। ২০০৯ সালে সুইডিশ কোম্পানি টেলিয়া সোনেরা হুয়াওয়ে ও এরিকসন কোম্পানির সহযোগিতায় প্রথম বানিজ্যিকভাবে স্টকহোম ও অসলো শহরে ৪ জি নেটওয়ার্ক চালু করে।
৪জি নেটওয়ার্কের প্রাথমিক ডাটা ট্রান্সমিশন রেট ছিলো সেকেন্ডে ১০০ এমবি। যা তার পূর্ববর্তী ৩ জি’র থেকে প্রায় দশগুন। ২০১০ সালে ৪জি ও ৪জি LTE এই দুই ক্যাটাগরিতে বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই এই চতুর্থ প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার হয়। লং টার্ম ইভোলিউশন(LTE) হল EDGE, CDMA 2000, W-CDMA, HSPA ও HSPA+ এর পরবর্তী দ্রুত ও কার্যকরী সেলুলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনার থেকে অধিক ডাটা ট্রান্সমিশন রেট সম্বলিত এই যোগাযোগ ব্যবস্থাই বর্তমান মোবাইলগুলোতে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এলটিই ব্যান্ড বিভিন্ন দেশে এক না হওয়ার কারণে ইন্টারনেট গতিরও দেশ অনুযায়ী বিভিন্নতা দেখা যায়।
ওয়াইম্যাক্স ও ৪জি ভয়েস ওভার লং টার্ম ইভোলিউশন(VOLTE) হলো এলটিই’র সাথে নতুন সংযোজন যা ভয়েস টেলিফোনি সিস্টেমকে পুরোপুরি ডিজিটাইজড করতে সক্ষম। এই সিস্টেম প্রটোকলে ভয়েস মান, তথ্যের নিরাপত্তা ও উচ্চ গতির নিশ্চয়তা দেয়। ৪ জি, গ্রাহকদের উন্নতমানের গেমিং সেবা, এইচডি মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্সিং, আইপি টেলিফোনি সহ উচ্চ গতি সম্পন্ন কাজগুলোকে সহজতর করেছে।
নানা সুবিধার পাশাপাশি চতুর্থ প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। অপেক্ষাকৃত জটিল হার্ডওয়্যার, ফ্রিকুয়েন্সি ব্যান্ড রেঞ্জ ব্যবহার করার সক্ষমতার সাথে এরিয়া কাভারেজ ও গতি বাড়াতে অতিরিক্ত খরচ এটির প্রধান সমস্যা।
৫ জি বা 5G কি
৪জি’র নানা ধরণের উন্নত সুযোগ সুবিধার মাঝে ২০১৮ সালে প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার ঘোষণা আসে। ৩ জি থেকে ৪জি ইন্টারনেট গতিতে অভাবনীয় সাফল্য দেখায়। তার ওপর ৫ জি ইন্টারনেট গতি কেমন হবে সেটা নিয়েও মানুষের কম জল্পনা কল্পনা ছিলো না।
পঞ্চম প্রজন্মের এই যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা কেবল মোবাইলকে প্রাধান্য দিয়ে রূপরেখা তৈরি করা হয়নি বরং মোবাইলের সাথে অন্যান্য ডিভাইসের সাথে সমন্বয় করে মানুষের জীবনকে কিভাবে সহজ থেকে সহজতর করা যায় সেই চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উন্নত মোবাইল ব্রডব্যান্ড, অপেক্ষাকৃত জটিল যোগাযোগ(অবকাঠামো, চিকিৎসা, যানবাহন, ক্লাউড গেমিং) ও আইওটি; মূলতো এই তিন ধরণের সেবাকে মূখ্য হিসেবে ধরে সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে নকশা করা হয়েছে।
পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি দ্বারা অধিক ডাটা রেট, স্থানান্তর শক্তি এবং গতিশীলতার মধ্যে সমন্বয় করার ক্ষমতার মাধ্যমে সবকিছুতে প্রচুর সংখ্যক কৃত্রিম বুদ্ধিদীপ্ত সেন্সরকে সংযুক্ত করা এবং কম খরচে নানাবিধ সমস্যাকে সমাধান প্রদান করার কাজ সম্ভব হবে। ৫জি’র ডাটা ট্রন্সমিশন রেট তার পূর্ববর্তী ৪ জি’র থেকে প্রায় একশো গুন বেশি হবে। যার স্পিড সেকেন্ডে ৫০ এমবি – ১ জিবি পর্যন্ত হতে পারে। কোয়ালকমের তথ্যমতে- আইএমটি-২০২০ আদর্শে এই গতি প্রায় সর্বোচ্চ ২০ জিবি পর্যন্ত হবে। মূলত উচ্চ রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহারের ফলে তথ্যকে বেশি পরিমাণে ও দ্রুত হারে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। উচ্চতর এই ব্যান্ডগুলোকে মিলিমিটার বা মিমি তরঙ্গ বলা হয়। আন্তর্জাতিকে টেলিকমিউনিকেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায় IMT-2020, 3GPP ও 5G NR এই তিন আদর্শে ৫ জি সেবা চলমান থাকবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার(AI) জন্য কোনো ধরণের বাধা ছাড়া অনেক দ্রুত নেটওয়ার্ক সংযোগ ও ইন্টারনেট অব থিংগস’র(IOT) পুরোপুরির সুবিধা পাওয়ার জন্য সেকেন্ডেই বিশাল তথ্য স্থানান্তর দরকার পরে। যা ৫জি তে সম্ভব হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
মোবাইল ভিত্তিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রজন্মের নামকরণের মাধ্যমে মূলত টেলিযোগাযোগ সেবার কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনকে বোঝায়। সময়ের সাথে এই নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার ইতিবাচক বিবর্তন যেমন অতীতে হয়েছে তেমনি ভবিষ্যতেও হবে। নতুন নতুন সেবা, যেমন: নতুন ধরনের স্থানান্তর প্রযুক্তি, উচ্চতর পিক ডাটা রেট, নতুন ফ্রেকুয়েন্সি ব্যান্ড, সমকালীন তথ্য স্থানান্তরের জন্য অধিক ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদিকে বিবেচনা করে নতুন কোন প্রজন্মের উদ্ভব হবে। দেখা যায় যে প্রায় দশ বছর পর পর টেলিযোগাযোগ প্রজন্মের পরিবর্তন ঘটে। ৫জি ব্যবহারের পরবর্তী দশ বছরেই সমগ্র বিশ্বে হয়ত নতুন কোনো সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বিকাশের সাথে তথ্য আদান প্রদানের জন্য কেবল মোবাইল ভিত্তিক না হয়ে এর পরিসর আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। যার অনেকটাই মানুষের অকল্পনীয় হবে। পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তিতে পা দেওয়া সত্ত্বেও আমরা এখনও জানিনা আমাদের গন্তব্য ঠিক কোথায়। আজ যা কল্পনার মতো মনে হবে; ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তাই কার্যকর হবে এবং বাস্তবতা হয়ে আমাদের হাতে ধরা দিবে। কিন্তু গোড়ার খবরাখবর জেনে ঠিক কোন অবস্থা থেকে আমাদের এই বর্তমান সময়ে এস পৌঁছেছি তা জেনে অন্তত আমরা ধারণা করতে পারবো আমাদের ভবিষ্যৎ যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন হতে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র:
১. List_of_mobile_phone_generations
২. 1G, ২জি, 3G, 4G, 5G, জিএসএম
৩. The evolution of mobile technologies
৪. A brief history of 1G mobile communication technology
৫. A rewind of the evolution from 1G to 5G
৬. The evolution of the G’s
৭. 0G to 5G Mobile Technology: A Survey
৮. Everything you need to know about 5G.
৯. The Mobile Wireless Communication Technology Journey – 0G, 1G, 2G, 3G, 4G, 5G
১০. Technology & Innovation
Leave a Reply