প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিঃ প্রাইমারি ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আমাদের দেহের কোন একটি অঙ্গ কিংবা বিশেষ শ্রেণীর কোষ অথবা আরও ক্ষুদ্র জিন কি কাজ করে তা উদঘাটনের একটা সুপ্রচলিত পদ্ধতি হল … সেটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে ফলাফল পর্যবেক্ষন করা। এভাবেই ব্লুস গ্লিক, বার্সা অফ ফ্যাব্রিসিয়াসকে বিকল করে দিয়ে যে ফলা ফল পেয়েছিলেন তার ব্যখ্যা খুঁজতে গিয়েই  টি কোষের খোজ মেলে।  

একই পদ্ধতি ইঁদুর অথবা অন্য কোন গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণীর উপর চালিয়ে অন্তর্নিহিত এবং অভিযোজিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। যেহেতু নানা কারণে মানুষের উপর এই ধরণের গবেষণা চালানো সম্ভব হয়ে উঠেনা, তাই ইঁদুর বাদুর-ই ভরসা।  

তবে প্রকৃতি কখনো কখনো তার খেয়ালে মানুষের দেহেই ওই এক্সপেরিমেন্টগুলো করে দিয়ে থাকে। আমাদের দেহে প্রতিরক্ষার সাথে জড়িত কোষ এবং জৈব রাসায়নিক উপাদান তৈরি করা অত্যন্ত জটিল প্রকৃয়া, এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজের মত এগুলোও জিন দ্বারা পরিচালিত। পরিণত টি কোষ কিংবা বি কোষ তৈরি হয় হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেলের থেকে এবং এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে অন্থত শ খানেক জিন। 

এছাড়া সাইটোকাইন, এন্টিজেন রিসেপ্টর, বিভিন্ন এনজাইম তৈরিতেও বিভিন্ন জিনের অবদান থাকে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত কোন একটি জিন যদি দেহে না থাকে বা ঠিকমত কাজ না করে, তাহলে বিপর্যয় নেমে আসে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিকাশের কোন পর্যায়ে জিনের ত্রুটি দেখা দিয়েছে তার উপর ভিত্তি করে কোন একটি অংশই পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। যেহেতু সবগুলো অংশ খুব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাই ছোটখাটো ত্রুটি বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।    

তাই যখন এই ধরনের জিনগত ত্রুটি তথা মিউটেশন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত জিনের মধ্যে চলে আসে, তখন আমরা একটা অপূর্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাই যার কোন না কোন খুঁত রয়েই যায়। কিতাবি ভাষায় এই অবস্থার নাম প্রাইমারি ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ডিজিজ। এই রোগ অন্তর্নিহিত এবং অভিযোজিত উভয় শাখাকেই একইসাথে কিংবা আলাদাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। যেসব রোগের প্রতিক্রিয়া তীব্র সেসবে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ মারা যায় প্রতি বছর। অনেক ক্ষেত্রে অনেকের দেহে প্রাইমারি ইমিউনোডেফিসিয়েন্সির কারণে মৃদু উপসর্গ সৃষ্টি করে। কোনটার চিকিৎসা আছে,, কোনটায় চিকিৎসা নেই। তারা এই দূর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েই জীবন অতিবাহিত করেন।   

X-LINKED AGAMMAGLOBULINEMIA
এক্স ক্রোমোজোমের একটি ত্রুটিপূর্ন জিনের কারণে এই রোগটি হয়। আক্রান্ত জিনটি বি কোষের পরিণত হওয়া এবং এন্টিবডি তৈরি হওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। আক্রান্ত রোগীর দেহে জন্মের সময় খুব কম এন্টিবডি থাকে এবং যথেষ্ট পরিমাণ এন্টিবডি তৈরির ক্ষমতা কখনো পুনরুদ্ধার হয়না। এর ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তি যেকোন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সহজেই এদের কাবু হয়ে যান। এছাড়াও স্বাস্থ্যহীনতা ও উচ্চতা নিয়েও ভুগতে হয় । সৌভাগ্যক্রমে এই রোগের চিকিৎসা রয়েছে। প্রতি মাসে একত্রিত হিউম্যান ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন দিয়ে এন্টিবডির অভাব পূরণ করা যায়। এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। তারপরও যদি আক্রান্তু হয়, সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক তো থাকছেই। 

COMMON VARIABLE IMMUNE DEFICIENCY
এই রোগটি কিছুটা অদ্ভুত। জিনগত এবং বংশানুক্রমিকল হওয়া স্বত্বেও কৈশোরে পৌঁছানোর আগে এর কোন উপসর্গ প্রকাশ পায়না। ঠিক কোন জিনের কারণে এটা হয় তা জানা না গেলেও, এটা আমরা জানি এর ত্রুটির ফলে ফলে বি কোষ এবং এন্টিবডি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহে IgA এবং IgG টাইপের এন্টিবডি থাকে খুবই অপ্রতুল। চিকিৎসার ক্ষেত্রে XLA এর সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।  

CHRONIC GRANULOMATOUS DISEASE
এই বিরল রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেদের আক্রান্ত করে। বেশ কিছু জিন এর সাথে জড়িত। জন্মের পরপরই এর উপস্থিতি প্রকাশ পেতে থাকে। এই রোগ থাকলে  শিশু ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সংক্রমণে ঘন ঘন আক্রান্ত হয়। জ্বর, র‍্যাশ, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, ফোড়া হওয়া,  খুব অহরহ। এই রোগে এন্টিবডি নিয়ে কোন সমস্যা নেই, ঝামেলা হয় ম্যাক্রোফেজের। এরা গিলে ফেলা জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারেনা, যার ফলে সংক্রমণ দূর হয়না। এর কারণে সংক্রমণের স্থানে আরও বেশি পরিমাণে ম্যাক্রোফেজ ভীর করতে থাকে, এবং ফুলে গিয়ে গ্র্যানুলোমাস তৈরি করে। এই গ্রানুলোমাস আশেপাশের স্বাভাবিক টিস্যুর কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। প্রয়োজন অনুসারে ফোড়া গেলে দেয়া এবং এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কার্যকর ফ্যাগোসাইটের ঘাটতি কমানো সম্ভব। 

CHEDIAK-HIGASHI SYNDROME
এই জটিল রোগটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াও শরীরের অন্যান্য কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটায়। জিনের ত্রুটির কারণে দেহের কোষগুলো তাদের ভেতরের সঞ্চিত দানাদার উপাদান(Granules) খালাস করতে পারেনা। যেমন নিউট্রোফিল তার ভেতরের জীবাণুর সাথে লড়াই করার করা উপাদান মুক্ত করতে পারেনা। CD8 এবং NK কোষ তার ভেতরের পারফোরিন ছাড়তে পারেনা, যা জীবাণু দ্বারা আক্রন্ত কোষ ধ্বংসে কাজে লাগে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা এমনিতেই বেশিদিন বাঁচেনা, তার উপর ঘন ঘন সংক্রমণ জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই।  

WISKOTT-ALDRICH SYNDROME (WAS)
এই রোগটি আরেকটি এক্স ক্রোমোজোমের সাথে জড়িত ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি। এর ফলে টি কোষ, বি কোষের কার্যাবলি বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্লেটলেটের সংখ্যা কম থাকে। প্লেটলেট কম থাকার দরুন ক্ষত স্থানে রক্ত জমাট বাধেনা। তাই এই রোগীর অঙ্গ কেটে-ছড়ে গেলে প্রচুর রক্তপাত হয় এছাড়াও ঘন ঘন সংক্রমণ তো আছেই। জড়িত জিনের ত্রুটির কারণে ইমিউন কোষ গুলো সক্রিয়করণ সংকেতে সাড়া দিতে পারেনা। সাধারণ এই রোগীদের যখন যেই জটিলতা দেখা দেয়, তখন সেটা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর অবস্থায় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনেরও উপদেশ দেয়া হয়।  

HYPER-IgM SYNDROME
মানুষের দেহে সাধারণত ৫ শ্রেণির এন্টিবডি তৈরি। বি কোষ সক্রিয় হবার পর প্রথমে IgM তৈরি করে। যথেষ্ট পরিমাণ IgM তৈরির পর বি কোষ মেমরি কোষে রূপান্তরিত হয়ে দেহে বিদ্যমান থাকে। মেমরি কোষ এন্টিজেনের উপস্থিতিতে সক্রিয় হলে IgG অথবা IgA তৈরি করে। বি কোষের রূপান্তরে কার্যকর ভূমিকা রাখে,  সাহায্যকারী টি কোষের CD40L নামক প্রোটিন। বেশ কিছু জিনের ত্রুটির কারণে CD40L প্রোটিন অনুপস্থিত থাকতে পারে। যার ফলে দেহে মেমরি কোষ তৈরি হয়না, আর মেমরি কোষ না থাকলে IgG আর IgA তৈরি হয়না। এই দুটি এন্টিবডি নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে IgM এর তুলনায় বেশি কার্যকর । চিকিৎসা হিসেবে এন্টিবডির স্বল্পতা দূর করতে গামা গ্লোবিউলিন ইনজেকশন এবং প্রয়োজন মত এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। 

Severe Combined Immune-deficiency Disease(SCID)
যদিও সব প্রাইমারি ইমিউন ডেফিসিয়েন্সিই মারাত্বক, তবে এখন একত্রিত হিউম্যান গামা গ্লোবিউলিন এবং এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে বি কোষের স্বল্পতা নিয়ন্ত্রন করা যায়। টি কোষের স্বল্পতা নিয়ন্ত্রণ করা জটিল হলেও সম্ভব এবং গুরুতর অবস্থায় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনও করা হয়ে থাকে। তবে যখন একটি শিশুর জন্মের সময় বি কোষ, টি কোষ কোনটাই কার্যকর থাকেনা তখন মৃত্যু ছাড়া আর পথ থাকেনা। এটাকেই বলে Severe Combained Immune-deficiency Disease(SCID). 

টি কোষের কার্যকারীতার সাথে জড়িত একটি জিনের ত্রুটির কারণে জন্মের সময় শিশুর দেহে কোন পরিণত টি কোষ থাকেনা, ফলশ্রুতিতে বি কোষ ও পরিণত হয়না। এদের দেহে কোন অভিযোজিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকেনা। এইডস রোগীরা যেমন যেকোন জীবাণুর সহজ শিকার, এরাও তেমনি, একদম জন্ম থেকেই। জন্মের প্রথম বছর কিছুটা নিরাপত্তা পায় এরা অন্তর্নিহিত প্রতিরক্ষা এবং মায়ের দেহ থেকে পাওয়া এন্টিবডির মাধ্যমে, তবে বড় হবার সাথে সাথে যখন উপর্যুপরি পরিবেশের জীবাণুর আক্রমণের শিকার হতে থাকে, তখন আর বাঁচিয়ে রাখা যায়না। আর খুব কম হাসাপাতালেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তি আছে এমন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার। অনেক ক্ষেত্রেই জন্মের আগে বুঝা যায়না এই রোগের উপস্থিতি, তখন একদম মারাত্বক পর্যায়ে সংক্রমণের পর যখন হাসপাতালে আনা হয়, তেমন কিছু আর করার থাকেনা। আবার এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের দেহে টিকা থেকে নানান জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে। স্বস্তির বিষয় এটাই যে এই রোগটি খুবই বিরল। 

বুঝাই যাচ্ছে এই রোগে আক্রান্তদের প্রতি ভাগ্য মোটেই প্রসন্ন নয়। বেশি ভাগ ক্ষেত্রেই জন্মের ২ বছরের মধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়। মৃত্যু হয় মূলত ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে। টিস্যুতে খুব মিল আছে(Closely tissue-matched) এমন দাতার অস্তিমজ্জা এবং স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অনেকের আয়ু কয়েকবছর বাড়ানো যায়।  

SCID নিয়ে কথা আসলে যার কথা এড়ানো যায়না তার নাম ডেভিড। ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া এক আমেরিকান বালক ডেভিড “বাবল বয়” হিসেবে সুপরিতিচিত। ডেভিডের জন্মের আগে তার আরও একটি ভাই জন্মেছিলো যে SCID এর কারণে জন্মের কিছুদিন পরেই মারা যায়। SCID এর কয়েক রকমের মধ্যে তারটা ছিলো এক্স ক্রোমোজোমের সাথে যুক্ত। যার ফলে পরিবারের শুধু ছেলে শিশুই আক্রান্ত হত। ডেভিডের বাবা মা ঝুঁকিটা জানতেন, আর গর্ভাবস্থায় ৫ মাস পরে Amniocentesis এর মাধ্যমে যখন বুঝা গেলো অনাগত শিশুটিও ছেলে শিশু। তবে সেই সময় এটা বুঝার উপায় ছিলোনা যে ভ্রূণের ক্রোমোজোমে ত্রুটিপূর্ন জিন রয়েছে কি না। 

বাবল বয় হিসেবে পরিচিত ডেভিড

জন্মের সাথে সাথেই তাকে একটি সম্পুর্ণ জীবাণুমুক্ত(Sterile) ইনকিউবেটরে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা সম্পর্কে জানা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা। তবে যা হবার তাই বের হল, ডেভিডের ক্রোমোজোমে সেই ত্রুটিপূর্ন জিন বিদ্যমান, এবং সে ও SCID আক্রান্ত। তবে তাকে আর সেই জীবাণুমুক্ত ইনকিউবেটর থেকে তখন বের করা হলোনা। এই আশায় যে, যদি তাকে যথেষ্ট সময় জীবাণু থেকে দূরে রাখা যায়,  হয়তো একজন উপযুক্ত অস্থিমজ্জা দাতা পাওয়া যাবে কিংবা তার শরীর নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলবে। 

শুধুমাত্র জীবাণুমুক্ত বিচ্ছিন্নতা রাখা ছাড়া অন্য কোন ধরণের চিকিৎসা ছাড়াই ডেভিড অন্য সব SCID শিশুদের আয়ুষ্কাল অচিরেই ছাড়িয়ে যায়। যদিও কিছুদিন পর পরপরই টি কোষ এবং বি কোষের উপস্থিতি আছে কি না তা বুঝার জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছিলো, কিন্তু লাভ হচ্ছিলোনা। যখন সে আরও বড় হল, হামাগুড়ি দেয়া এবং একটু একটু দাঁড়ানো শিখলো। তখন আর ইনকিউবেটরে রাখা সম্ভব হলোনা। তার জন্য একটি “বাবল” তৈরি করা হল যার মধ্যে সে স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করতে পারতো। এর সাথে যুক্ত স্টেরাইল গ্লাভসের মাধ্যমে পরিবারের লোকজন তার সাথে খেলাধুলা এবং আদর যত্ন করতে পারতেন। এভাবেই সে “বাবল বয়” নামটি পেলো।  

ছয় বছর বয়সে নাসা তার জন্য একটি স্পেস স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলো যা পড়ে সে বাবলের বাহিরেও যেতে পারতো। তবে বছর খানেকের মধ্যেই সে আরও বড় হয়ে গেলো। এরপর তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। যেখানে সে বাবলের মধ্যে থেকেই পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠতে থাকে। ঘরে থেকেই সে লেখাপড়া শিখা শুরু করে। সে ছিল বেশ মেধাবী আর কিছুটা দুষ্ট, সমবয়সী আর দশজনের মতোই। শুধু তার ইমিউন সিস্টেম কখনো বিকশিত হয়নি। তার জীবন ও মৃত্যুয়র মধ্যে ব্যবধান শুধু কয়েক মিলিমিটারের প্লাস্টিক শিট আর অত্যাধুনিক এয়ার ফিল্টার।          

এভাবেই বয়স বাড়তে বাড়তে সে ডেভিড বারো তে পড়ল। বাবলের ভেতর দিব্যি সুস্থ্য কিন্তু এখন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময় হয়ে এসেছে। এভাবে কতদিন? ২০ বছর? ৩০ বছর? ৫০ বছর? এছাড়াও তার মধ্যে যৌন পরিপক্বতার প্রথম লক্ষণগুলো ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছিলো। ডেভিডের নিজের জন্যও ওই দুরন্ত বয়সে বাবলের মধ্যে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠছিলো। কোন SCID শিশুই এতদিন বাঁচার সুযোগ পায়নি, তাই কেউ এতকিছু ভেবেও রাখেনি। তার মেডিকেল টিম বিশাল এক দ্যোটানায় পড়ে যায়।  

অবশেষে ডেভিডের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা ঐক্যমতে পৌঁছলেন যে ডেভিডের দেহে তার বোনের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হবে। কিছু জটিলতা থাকলেও সেসব অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সম্পন্ন হয়। এর পরে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। তবে তার কয়েক সপ্তাহ পরেই ডেভিডের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। ওজন কমে যায়, জ্বর, বমি এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়। ধারণা করা হয়েছিলো সে Graft Vs Host রোগে আক্রান্ত, এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসাও দেয়া হয়। তবে লাভ হলোনা। এর মধ্যে আবার দেখা দিলো ভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ। শেষ পর্যন্ত ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের ১২৪ দিন পরে ডেভিড তার বন্দিদশা থকে চিরতরে মুক্তি পায়। 

পরবর্তীতে দেখা গেলো সে মোটেই GVH এ আক্রান্ত ছিলোনা। বরং তার বোনের বি কোষে সুপ্তাবস্থায় ছিল এপ্সটেইন বার ভাইরাস(Epstein-Barr Virus), যা ডেভিডের দেহে সৃষ্টি করেছিলো প্রাণঘাতী লিম্ফোমা। 

ডেভিডের মৃত্যুর আগে তার দেহ থেকে কিছু টি কোষ সংগ্রহ করে রেখে দেয়া হয়েছিলো গবেষণার স্বার্থে। ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানীরা সেই টি কোষের ডিএনএ থেকে SCID এর জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ন জিনটি শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই জিন অপরিপক্ব টি কোষের একটি রিসেপ্টরকে এনকোড করে, যা থাইমাসের একটি গুরুত্বপূর্ন সাইটোকাইনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে। জিনের ত্রুটির কারণে যখন রিসেপ্টর কার্যকর হয়না, তখন সাইটোকাইন থাকলেও টি কোষ সেটা বুঝতে পারেনা যার ফলে আর পরিপক্ব হয়ে উঠেনা।  

জিন থেরাপি

ডেভিডের মৃত্যুর ৩ বছর পর SCID এর জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ন জিনটি শনাক্ত করা যায়। এরপর আলাদা করে ক্লোন করা হয়। জিনটির ভালো কপি নিষ্ক্রিয় রেট্রোভাইরাসের মাধ্যমে জিন থেরাপিতে ব্যবহার করা শুরু করেন একদিন ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী। 

যেহেতু অন্যের দেহ থেকে সুস্থ অস্থিমজ্জা এনে রোগীর দেহে ঢুকানোতে নানাবিধ জটিলতা থাকে । তাই সেই পথে না গিয়ে আক্রান্তের অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করে, তার স্টেম কোষে সুস্থ জিন ঢুকিয়ে আবার রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। অতঃপর স্টেম কোষ পরিপক্ব হলে সুস্থ টি কোষ তৈরি করা শুরু করলে আজীবন আর কোন চিন্তা 

থাকেনা। 

ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের দল ১১ জন শিশুর দেহে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। সবার ক্ষেত্রেই জিনের ত্রুটি সংশোধন হয় তাদের ইমিউন সিস্টেম ঠিক ঠাক কাজ করতে শুরু করে। ব্যাপারটা খুবই উত্তেজনাকর, কারণ এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে সুস্থ জিন অস্থিমজ্জার স্টেম কোষে স্থানান্তরের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ন জিন সাড়ানো সম্ভব এবং কাঙ্ক্ষিত কার্যকারীতাও পাওয়া যায়। 

তবে এর মধ্যে ৩ জন শিশুর এর পরে লিউকিমিয়া ধরা পড়ে, পরবর্তীতে বুঝা যায় জিন থেরাপি নেয়ার কারণেই সেটা হয়েছিলো। যদিও যে সেই লিউকিমিয়া চিকিৎসাযোগ্য ছিল, তারপরও একজন শিশুর মৃত্যুর কারণে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হতে যাওয়া ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়া হয়। এবার আরেকটি নৈতিক দ্বিধায় পড়ে যান বিজ্ঞানীরা। জিন থেরাপি না দিলে আক্রান্ত শিশুরা মরেই যেতো, থেরাপি নেয়ার ফলে কেউ কেউ মারা যেত। 

অতঃপর এভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে শুধুমাত্র যদি উপযুক্ত অস্থিমজ্জা দাতা না পাওয়া যায় তখনি জিন থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারকে এর ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত থাকতে হবে। আক্রান্তকে জিন থেরাপি দেয়া হবে কি হবেনা সেই সিদ্ধান্তে আক্রান্তের পরিবারের সম্পুর্ণ সম্মতি থাকতে হবে। 

এখন আমরা জানি যে ধরনের রেট্রোভাইরাস SCID এর থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিনের কাছে ডিএনএ সন্নিবেশ করে সেসব জিনকে সক্রিয় করতে পারে। তবে একি রেট্রোভাইরাস আরও শত রকমের জিনগত রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে নিরাপদে। SCID এর ক্ষেত্রেই কেন এমন আচরণ করছে সেটাও বিজ্ঞানীদের বুঝতে হবে। 

Chronic Granulomatus Diesease, Wiscott Aldrich Syndrome প্রভৃতি রোগের জিন থেরাপির ক্লিনিকাল ট্র্যায়াল চলছে। Hyper IgM রোগের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নানাবিধ বাঁধা, জটিলতা কাটিয়ে জিন থেরাপির মাধ্যমে এই ধরনের রোগের মৃত্যুহার একসময় একেবারেই কমিয়ে আনা যাবে। তবে জিন থেরাপি কিন্তু মানুষের জিনোম বদলে দেয়া নয়। এই থেরাপির মাধ্যমে আপ্ত পরিবর্তন পরবর্তি প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়না। মানব ক্লোনিং এবং অন্যান্য আতংকের যুগে সম্ভাব্য উপকারী প্রযুক্তিকে ভুল বুঝলে চলবেনা।      

লেখাটি 154-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers