আমরা সবাই-ই মহাকালের যাত্রী। যেহেতু আমরা সময়ের মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছি, প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। এই অভিজ্ঞতা গুলোকে সংরক্ষণের জন্যে আমাদের মগজের স্নায়ু কোষ গুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে অসংখ্য নিউরাল সংযোগ। এই প্রক্রিয়ায় যেন আমরা নিজেরা নিজেদের পুনরায় বিন্যস্ত করি। এভাবেই আমাদের স্মৃতি গুলো তৈরি হয়। স্মৃতি আমাদের ব্যক্তিত্ব বোধকে ধরে রাখতে অনেকটা আঠার মতন কাজ করে। আমরা কেবল শারীরিক ভাবেই সময় কে ভ্রমণ করি তা নয়, মানসিক ভাবেও আমরা কালের ভ্রমণ পথিক। আমরা স্মৃতির মধ্য দিয়ে অতীত থেকে ঘুরে আসতে পারি আবার কল্পনায় ভর করে ভবিষ্যতে পাড়ি জমাতে পারি। ভাবতে পারি আগামী দিন কিংবা আগামী বছর আমাদের জন্যে কি বয়ে নিয়ে আসছে। আমরা ভাবি বর্তমানের নিজেকে নিয়ে, অতীতেই বা কেমন ছিলাম কিংবা ভবিষ্যতের আমিকে জানতে চেষ্টা করি।
সোসাইল কগনিটিভ এন্ড অ্যাফেক্টিভ নিউরোসায়ন্স জার্নালে প্রকাশিত একটা নতুন গবেষণা বলছে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোন অংশ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের আমিত্ব বোধের মধ্যে যোগ সাধন করে। আমাদের মস্তিষ্কে মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স বলে একটা অংশ আছে যা আমাদের মনোযোগ দেবার ক্ষমতা, অভ্যাস গঠন, দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি ধারণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দুটো ভাগে বিভক্ত- ডরসাল বা পৃষ্ঠীয় মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (dmPFC) এবং ভেন্ট্রাল বা অঙ্কীয় মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (vmPFC)। গবেষণাটি বলছে vmPFC আমাদের ব্যক্তিত্ব চেতনার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং এই চেতনাকে মানসিক সময়ে স্থান দেয়। এটি আমাদের ব্যক্তিত্ব চেতনার উৎস হিসেবে কাজ করে। এই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যক্তিত্ব বোধেও সমস্যা সৃষ্টি হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল করে আসছেন যে, কেউ তার নিজ সম্পর্কিত তথ্য গুলো তার মস্তিষ্কে অন্যান্য স্মৃতি গুলো থেকে আলাদা ভাবে জমা করে রাখে। আমরা আমাদের জীবনের অন্য যে কোন স্মৃতি থেকে নিজ সম্পর্কিত তথ্য গুলো দ্রুত স্মরণ করতে পারি। এই বিষয়টাকে মনোবিজ্ঞানীরা সেলফ রেফারেন্স ইফেক্ট (SRE) বলে থাকেন। আমাদের চিন্তা-ভাবনায় সব সময় আমাদের নিজ সম্পর্কিত তথ্য গুলোর প্রাধান্য বেশি থাকে। আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত মেমরি গুলো এপিসোডিক এবং সেমান্টিক উভয় ধরণের মেমরি থেকেই আলাদা বা স্বতন্ত্র। এপিসোডিক মেমরি হল কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা অভিজ্ঞতার সংগ্রহ আর সেমান্টিক মেমরি বলতে বিভিন্ন সাধারণ নলেজ এর সংগ্রহকে বোঝায়- যেমন ঘাস এর রং কি কিংবা কোন ঋতুর কেমন বৈশিষ্ট্য।
সুতরাং SRE মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের ফলে কীভাবে আমাদের ব্যক্তি চৈতন্য ফুটে উঠে তা বোঝবার একটা পথ হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা fMRI ( functional magnetic resonance imaging) পদ্ধতিতে জানবার চেষ্টা করেন আমাদের মগজের কোন অংশটা SRE এর ফলে সক্রিয় হয়। উল্লেখ্য যে, fMRI প্রসেসে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের পরিমাপ স্বরুপ তার ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ মাপা হয়। এই গবেষণা আমাদের ব্যক্তি চেতনার জন্যে কার্যকরী অংশ হিসেবে মস্তিষ্কের মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স কে শনাক্ত করে। আগেই বলেছি এই অংশটি ডরসাল এবং ভেন্ট্রাল এই দুই ভাগে বিভক্ত। ডরসাল অংশটি অন্যদের থেকে আমাদের নিজেদের আলাদা করে আর ভেন্ট্রাল অংশটি বিভিন্ন আবেগপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ এর সাথে জড়িত। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এ ক্ষত আছে এমন কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে তাদের প্রত্যকের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ব্যক্তি স্বত্ত্বাকে মূল্যায়ন করতে একটা গবেষণা চালান। গবেষণায় তারা SRE ইফেক্ট কে ব্যবহার করেন। তারা সাতজন লোক যাদের ব্রেন এর vmPFC অংশে ক্ষত আছে, তাদেরকে তুলনা করেন আটজন লোকের একটা নিয়ন্ত্রিত দল, যাদের ব্রেন এর অন্যান্য অংশে ক্ষত আছে কিন্তু vmPFC অংশ স্বাভাবিক এবং ২৩ জন সুস্থ মানুষের একটা দল এর সাথে। এদের প্রত্যেককেই যথাযথ পর্যবেক্ষণ এর মধ্যে রাখা হয়। বিজ্ঞানীরা খেয়াল করেন মৌখিক বাকপটুতায় এবং স্থানিক স্বল্প সময়ের স্মৃতি ধারনের ক্ষেত্রে এরা সবাই-ই স্বাভাবিক আচরণ করেছে। পরবর্তীতে গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের তাদের নিজ এবং যেকোন একজন জনপ্রিয় খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে বর্ণনা করে এমন কিছু বিশেষণাত্বক শব্দের তালিকা করতে বললেন। সেই সাথে এমন কিছু শব্দের তালিকা করতে বললেন যেগুলো তাদের বর্তমান এবং আগামী দশ বছরের স্বত্ত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করবে। কিছু সময় পরে গবেষকরা অংশগ্রহণকারিদের একই বিষয় গুলো পুনরায় স্মরণ করতে বললেন।
গবেষকরা খেয়াল করলেন, আটজন লোকের নিয়ন্ত্রিত দলের সবাই একজন জনপ্রিয় খ্যাতিমান ব্যক্তির তুলনায় নিজেদের ব্যক্তি স্বত্ত্বা সম্পর্কিত বেশি বিশেষণাত্বক শব্দ স্মরণ করতে পেরেছেন। সেটা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এর ব্যক্তি স্বত্ত্বা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ SRE ইফেক্ট সব সময়ই কাজ করে। তবে সুস্থ লোকের দলের সবাই-ই এই আটজন এর থেকে আরো বিস্তারিত ভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছেন। যাদের মস্তিষ্কের vmPFC অংশে ক্ষত ছিল তাদের ক্ষেত্রে ফলাফল বেশ স্বতন্ত্র ভাবেই ভিন্ন ছিল। তারা নিজেদের ব্যক্তি স্বত্ত্বা সম্পর্কে কোন কিছুই স্মরণ করতে পারেন নি। এমনকি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের একজন জনপ্রিয় খ্যাতিমান ব্যক্তি সম্পর্কেও তাদের উপস্থাপন ভঙ্গি ছিল খাপছাড়া। অর্থাৎ ব্রেইন এর এই অংশে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তির নিজ ব্যক্তিস্বত্ত্বাকে উপস্থাপন করার ব্যপারে অতটা আত্মবিশ্বাসী নন। এই সকল প্রামাণিক তথ্য ব্যক্তিত্ব গঠন এবং প্রতিপালনের ব্যাপারে vmPFC অংশের কেন্দ্রীয় ভুমিকার বিষয়কে ইঙ্গিত দেয়।
বিভিন্ন কারণে এই গবেষণাকে কৌতূহলউদ্দীপক বলা যায়। ব্রেইন এর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ গুলো আমাদের সেগুলোর স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে। vmPFC অংশের ক্ষতি একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আনে, আবেগকে নিষ্প্রভ করে এবং কর্মসম্পাদনায় উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন আনে। মানুষের মধ্যে কনফাবুলেশনস সৃষ্টির পেছনেও vmPFC অংশের ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থা জড়িত। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি কোন মিথ্যা স্মৃতিকে বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত প্রকাশ করতে থাকে। আরো বিস্তৃতভাবে বললে, এই স্টাডি আমাদের ব্যক্তি চেতনাকে ধারণ করতে আমাদের নিজ সম্পর্কিত স্মৃতি গুলো কতটা জরুরি সেটা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। একটা কৌতূহল উদ্দীপক প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অতীতের ব্যক্তিত্ব চেতনার ব্যাপারে কি বলা যায়?
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে ব্রেইন এর মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স তেমন ভূমিকাই নেই! আমাদের অতীতের আমিত্ব যেন আমাদের কাছে আগুন্তকের মতন। এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ধারণা হচ্ছে, সম্ভবত আমরা আমাদের অতীতের আমির ব্যাপারে বিচার করতে গিয়ে অতটা সহিষ্ণু থাকি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের অতীতের আমিকে ব্যবহার করি বর্তমানের আমির একটা নিষ্পাপ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে। কিংবা অন্য ভাবে ভাবলে, হয়ত আমরা অতীতের আমি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে চাই। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কে আলোচ্য বিষয়ে রাখলে আমাদের সাম্প্রতিক ব্যক্তিত্ব গঠনের পথটার হদিস পাওয়া যায়। অনেক দিক থেকেই এটা পরিষ্কার যে, আমাদের বর্তমান নিজ সম্পর্কিত বিস্তারিত ধারণ করতে এবং ভবিষ্যতের আমিকে কল্পনা করতে মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এর ভূমিকা আছে। এই অংশটি একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে যা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সাথে জড়িত। এই নেটওয়ার্কে ব্রেইন এর হিপোক্যাম্পাস জড়িত, যা এপিসোডিক স্মৃতি তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোকে ক্রমান্বয়ে চিহ্নিত করে।
পূর্বে সম্পাদিত একটা গবেষণা অনুসারে, হিপোক্যাম্পাস এর কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটলে সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যৎ কল্পনা করার সক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। হিপোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের স্মৃতি গুলোকে অবলম্বন করে ভবিষ্যৎ ভাবতে সাহায্য করে। মানব সভ্যতার জন্যে ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারার তাৎপর্যতা গ্রিক মিথোলজীর শিল্প ও বিজ্ঞানের দেবতা প্রমিথিউস এর সাথে জড়িত। প্রমিথিউস নামের অর্থ সম্মুখ-দ্রষ্টা। গ্রীক কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি মানুষকে মৃত্তিকা দিয়ে গড়েছিলেন আর তাদের কারুকার্যের দক্ষতা দিয়েছিলেন। এই মিথোলজী মানুষের কল্পনা করার শক্তিকে চিত্রিত করে। কেবল মানুষেরই এই ক্ষমতা আছে, এই বাক্যটি বিতর্কের জন্ম দেয়, কেননা ওয়েস্টার্ন স্ক্রাব জেস এর মতন পাখিরা ভবিষ্যতের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে পারে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্যাপিয়েন্সদের বিবর্তনে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এই ক্ষমতা ভাষার বিকাশে এবং পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এই বিষয়টিই আমাদের মস্তিষ্কের vmPFC অংশের প্রতি সামাজিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সেই হিসেবে নতুন এই গবেষণাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়াই যায়।
তথ্যসুত্রঃ How Our Brain Preserves Our Sense of Self.
Leave a Reply