যেমন গুরু তেমন শিষ্য

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত
ভালো করে বাঁচবার আছে যত দিক
বিজ্ঞান অবদানে হল মৌলিক
সভ্যতা বিকাশের ধারাগুলো জোড়া
আগাগোড়া বিজ্ঞান দিয়ে তা মোড়া

বিজ্ঞান নিয়ে এমনই এক বাস্তব কবিতা রচনা করেছিলেন সাহিত্যিক আলী ইমাম। আমি তারই কয়েক পঙক্তিই উল্লেখ করলাম। যুগে যুগে সভ্যতার বিকাশে ও মানুষের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করতে বিজ্ঞান যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে চলেছে তা কমবয়সী বালকমাত্রও জানে। কিন্তু যারা বিজ্ঞানের এ সকল আবিষ্কার সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে তারা হলেন বিজ্ঞানীরা। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ড নয় বরং সারা বিশ্বে তারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের আবিষ্কারের দ্বারা। সমাদৃত হয়েছেন সর্বমহলে।

‘বিজ্ঞানী’ কথাটি উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখ চলে যায় নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা মাদাম কুরি ও রাদারফোর্ডের মতো বিজ্ঞানীদের দিকে। কিন্তু আমরা কি কখনো আমাদের গর্বের প্রতীক বাঙালি বিজ্ঞানীদের কথা ভেবেছি একবার? কখনও জেনেছি তাদের আবিষ্কারের কথা। যে আবিষ্কারগুলো বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে। এ সপ্তাহেই রয়েছে আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই এ লেখাটি লেখা হয়েছে আমাদের সেই সব মহান বাঙালি বিজ্ঞানীদের নিয়ে। তাহলে চল শুরু করা যাক।

তিনি মোদের আচার্য্য

আমি পূর্বেই লেখাটির শিরোনাম দিয়েছিলাম গুরু-শিষ্য। তাহলে গুরুর পরিচায়টাই আগে দেয়া যাক। তিনি আমাদের সবার প্রিয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের সন্তান। ২রা আগস্ট ১৮৬১ সালে তৎকালীন যশোর জেলার (বর্তমানে খূলনার পাইকগাছা উপজেলা) রাড়ুলি-কাটিপাড়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬১ সালটা কিন্তু আরেকটা কারণে স্মরণীয়। কারণ বিশ্ব সাহিত্যের রত্ন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মও একই সালে। যাই হোক। ফিরে আসি প্রফুল্লচন্দ্রের কথায়। তিনি অত্যন্ত বনেদি পরিবারের সন্তান ছিলেন। পিতা হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন। তার (হরিশচন্দ্রের) প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলেই ছেরের পড়াশোনার হাতেখড়ি।

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও তুখোড় ছিলেন তিনি। তার অধিকাংশ সময়ই কাটতো গ্রন্থাগারের বই পড়ে। ১৮৭৮ সালে তিনি স্কুল ফাইনাল তথা প্রবেশিকায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বাংলা ভাষার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল যৌবনের শুরু থেকেই। তিনি যখন শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন তখন তাকে সর্বসাধারণ আচার্য্য নামে অভিহিত করতো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী। অধিক জ্ঞানের তাগিদে তিনি ইউরোপ যান। সেখানে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ সরকারও তাকে নাইট উপাধি দিয়েছিল।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

কিন্তু এতসব কিছু পাবার পরও তিনি নিজ দেশকে ভুলে যাননি। ছুটে আসেন দেশে। সারাজীবনই বলেগেছেন, ‘আমার সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দুই এদেশের মানুষ ভালো থাকবে বলে।’ তিনি দেশে ফিরে যখনই কোন ক্লাসে যেতেন তখন বাংলায় লেকচার দিতেন। তখনকার ব্রিটিশশাসিত ভারতে বাংলায় লেকচার দেবার বিষয়টি কল্পনা করা যেত না। কিন্তু তিনি বিজ্ঞানের অনেক সুকঠিন বিষয়গুলো বাংলা ভাষার মাধ্যমে সহজে বুঝিয়ে দিতেন ছাত্রদের। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উৎসাহ দিতেন তার ছাত্রদের। ফলে ছাত্রদের মন খুব সহজেই জয় করে নিতেন তিনি। তার কিছু ছাত্র তো রীতিমতো বিজ্ঞানী হয়ে সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন। তাদের কথায় আসছি পরে।

বিজ্ঞানী হবার পাশাপাশি প্রফুল্লচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। এমনকি বাংলাদেশের আরেক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ড. কুদরাত ই খুদা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়নে ১ম বিভাগ পেলে অনেক শিক্ষক এর বিরোধীতা করেছিলেন। তখন প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ও যোগ্য। ও অবশ্যই পাবে। ওর মেধার পরিচয় ওর খাতায়। ধর্মে নয়। ধর্ম কখনো মেধার নির্ণায়ক না।’ তনি কখনো বিলাসি ছিলেন না। মাসিক আয় পৌনে দুই হাজার টাকা হওয়া সত্ত্বেও সকালের নাস্তার জন্য তিনি মাত্র ১ পয়সা রাখতেন। এর বেশি খরচ হলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো- তিনি কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে তার নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’। স্বদেশ ও মাতৃভাষা বাংলাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন এই মহামান্য বিজ্ঞানী।

আইনস্টাইনের নামের পাশে নাম তার

১৯২৪ সাল। মহামতি আইনস্টাইন টেবিলে বসে ঠেস দিয়ে। না তিনি আর কিছু না বরং বসুর লেখাটাই পড়ছিলেন। প্রবন্ধটির নাম ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দি লাইট কোয়ান্টাম হাইপথেসিস’। কিছু সময় পর আইনস্টাইনের মুখে ফুটল হাসির রেখা। চমৎকার। আইনস্টাইনের মুখ ফুটে উঠে বসুর প্রশংসা। পরবর্তীকালে এটি ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব নামে পরিচিতি লাভ করে। এই বসুই আমাদের সবার প্রিয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু

১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার গোয়া বাগান অঞ্চলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম। রেলওয়ের হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করা পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু কি তখন জানতেন যে তার ছেলে একদিন বিশ্বমাঝে খ্যাতি এনে দিবে! সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নর্মাল স্কুলে। ১৯১১ সালে আই.এস.সি পাশ করেন প্রথম স্থান অধিকার করে। এরপর তিনি সান্নিধ্যে আসেন প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্যারের মত অধ্যাপকদের। গুরুর সান্নিধ্যে এসে তিনি দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের দীক্ষা লাভ করেন। এহেন সুশিক্ষা লাভের কারণেই হয়ত তিনি উচ্চারণ করেছিলেন তার সেই স্মরণীয় উক্তিটি-

“যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয়না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।”

সত্যেন বসু

যে সময়ে প্রায় সকল স্কুল-কলেজে চলছিল ইংরেজি শিক্ষার মহোৎসব সেই সময় তিনি তার গুরুর পদাংক অনুসরণ করেই বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারার সূত্রপাত ঘটান। প্রথম কাজটি তো প্রফুল্লচন্দ্র করেই দিয়েছেন এখন শুধু এর সুন্দর পরিসমাপ্তি টানাটাই বাকি ছিল। সেটাও টেনে দিলেন। প্রতিপাদন করলেন প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয় নীতির।এক্কেবারে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই! ভাবা যায়? এরপর এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ রচনা করে বিজ্ঞানমহলে পাঠিয়ে দেন। শুধু তারাতিা প্রত্যাখ্যান করে দেয়্ পরে আইনস্টাইনের কাছে পাঠালে নিবন্ধটি দেখে তার যে রকম অভিব্যক্তি হয়েছিল তা তো পূর্বেই বললাম! এমনকি পরবর্তীতে নিবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। গবেষণার কাজ আরো প্রসারিত করতে তিনি বিদেশ যান এবং মেরি কুরি, আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করেন। এ সময় তিনি আপেক্ষিক তত্ত্বের কতগুলো জটিল গাণিতিক সমীকরণেরও সমাধান করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেন। অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয় যখন পরমাণুর এক কণিকার নাম তার নামানুসারে রাখা হয় ‘বোসন কণা’। তাইতো সত্যেন্দ্রনাথ বসু ইতিহাসে আজও একজন বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে অমর হয়ে আছেন।

অনেক বড় হয়ে গেল। তাই না? শুধুমাত্র তাঁরাই যে বাঙালি হিসেবে বিজ্ঞানে ভূমিকা রেখেছিলেন তা নয়। বরং মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্রের মতো এরকম আরো অনেক বাঙালি বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানমহলে অবদান রেখেই চলেছেন। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রাক্কালে আমরা যেন ভুলে না যাই বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব – এই অনুরোধটুকু রাখতে চাই।

লেখাটি 1,341-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Response

  1. tareq rahman samin Avatar
    tareq rahman samin

    Valo hoyeche onk ojana tottho peyechi Ami
    Egiye jao Rahmatulla Al Arabi

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading