শীতটা বোধহয় এবার একটু বেশিই জেঁকে বসেছে। বলা চলে, একবারে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। কুয়াশার ঘন চাদরে ঢেকে গিয়েছে পরিবেশ। যখনই নিশ্বাস ছাড়ছি, যেন ছোট ছোট কুয়াশার স্তুপগুলো পাঁক খেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। চাদরটা ভাল ভাবে পেঁচিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠান্ডায় জমে যাবার ভয়ে চেয়ারে পা তুলে বসলাম৷ হাতে গরম কফি, এই তীব্র ঠান্ডায় কফির কাপের উষ্ণতা বেশ আরামদায়ক মনে হল। ছোট একটা চুমুক দিয়ে তাকালাম ওই আকাশপানে। এই কুয়াশার ঘন চাদর ভেদ করেও কয়েকটি তারার ঘোলাটে আলো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই মাথায় আজব প্রশ্নটি উঁকি দিল৷
আচ্ছা, আমি তো একটা প্রাণী, প্রাণ আছে। খাই, দাই, সারাদিন এদিক ওদিক টো টো করে ঘুরে বেড়াই। আবার ঘুম পেলে সটান বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। পৃথিবী নামের এই গ্রহের এক কোণে বাস করি। এই মুহূর্তে চাদর মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে আরাম করে কফি খাচ্ছি। দূর আকাশের ওই তারাদের দেখছি৷
এমন কি হতে পারে না, ওই তারাদের কোন একটায় আমারই মত, কিংবা আমার থেকে ভিন্ন গঠনের প্রাণীর বসবাস রয়েছে? সেও আমার মত খায়, দায়, ঘুরে বেড়ায়! এমনও তো হতে পারে, সে ঠিক এই মুহুর্তে আমার মত কফির কাপ হাতে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে?
আমাদের পৃথিবীর বাইরে কোন প্রাণের অস্তিত্ব থেকে থাকলে তাদের আমরা এলিয়েন বলি। তারা কি আমাদের মতই দেখতে? এই যেমন আমার দুটো হাত আছে। তাই বলে কি তারও দুটো হাত থাকতে হবে?
আদতে ব্যাপারটি আসলে এমন নয়। পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে তাদের সবকিছু আমাদের মত হবে, এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই। তারা আমাদের থেকে একেবারেই ভিন্ন গঠনের হতে পারে। হতে পারে অ্যামিবার মত কোন এককোষী জীব! এদিক থেকে হলিউডের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রগুলো যেন এককাঠি এগিয়ে। নানা ধরনের কাল্পনিক এলিয়েন চরিত্রের সৃষ্টি তাদের কাছে ডালভাতের মত ব্যাপার।
আমরা অনেকদিন ধরেই এলিয়েনের সন্ধানে মহাবিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছি। নতুন নতুন মহাকাশযান পাঠাচ্ছি মহাকাশে, রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে দূরবর্তী গ্রহে সংকেত পাঠাবার চেষ্টা করছি। একটু কল্পনা করে দেখুন, যদি এমন হয় আমাদের সংকেত পেয়ে কোন দূরগ্রহবাসীর ইচ্ছে হল আমাদের সাথে পরিচিত হবার। তখন সেও তো চাইলে একইভাব পৃথিবীর উদ্দেশ্যে এমন রেডিও সিগন্যাল পাঠাতে পারে।
এমনই এক আজব ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৭ সালর ১৫ই আগষ্টে। জ্যোর্তিবিজ্ঞানী জেরি আর এহম্যান তখন ভলিন্টিয়ার হিসেবে ঢুকেছেন ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি রেডিও অবজারভটরিতে। সে টি এর একটি কর্মশালার অংশ হিসেবে যেটিকে বিগ ইয়ার নামে ঢাকা হত।
একে আমরা কখনোই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ হিসেবে দাবি করতে পারব না, এর সেন্সরগুলো অন্যান্য টেলিস্কোপের মত অতি মাত্রায় স্পর্শকাতরও ছিল না।
তবে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণের জন্য এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে, যার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নি।
বিগ ইয়ারের প্রধান কাজ ছিল আইবিএম ১১৩০ কম্পিউটার থেকে প্রাপ্ত প্রজেক্টের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং লাইন প্রিন্টারে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা। সেদিন কাজ করতে করতে একটু ঝিমুনি চলে এসেছে এহম্যানের। মনে মনে ভাবছেন, এই মুহুর্তে এক কাপ গরম ধোঁয়া উঠা কফি পেলে নেহাত মন্দ হত না!
হঠাৎ করেই তিনি খেয়াল করলেন, মহাকাশ থেকে আগত একটি সংকেতের তীব্রতা ও প্রাবল্য বেশ অদ্ভুত ধরণের। তিনি ও তার সহকর্মীরা সংকেতটির ধরণ দেখে প্রচন্ড আশ্চর্য হলেন। সংকেতটি ছিল বেশ শক্তিশালী, নির্দিষ্ট বিরতিতে ৭২ সেকেন্ডের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। এহম্যান এতটাই আশ্চর্য হলেন যে, তিনি কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করা ফলাফলটিকে গোল করে দাগালেন এবং পাশে শুধু একটি শব্দই লিখলেন, ওয়াও ( WoW) ! সেই থেকে বর্তমানে সংকেতটি এই নামেই জনপ্রিয়।
ধারণা করা হয়, সংকেতটি সম্ভবত সাগিট্টারিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এসেছে এবং বর্হিজাগতিক প্রাণের ব্যাপার সংকেত বহন করছে। এটি ছিল শক্তিশালী ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সংকেত, ১০ কিলাে হার্জ এর কম। অনেকেই বলে থাকেন সংকেতটি প্রাকৃতিক ভাবে কিংবা মানুষের দ্বারাই হয়ত সৃষ্টি। কিন্তু কেউই সঠিকভাব সংকেতটিকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।
রেডিও অবজারভেটরিটির পরিচালক জন ক্রাউচ পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণটির বিস্তারিত বর্ননা দিয়েছিলেন।
তার মতে ওয়াও সিগন্যালকে আমরা বহির্জাগতিক বুদ্ধিমত্তার কোন নিদর্শন হিসেবে প্রাথমিক ভাবে ধরে নিতে পারি। তবে এই বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইলে আরও বিস্তারিত গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এমনকি এই বিষয়টি নিয়ে তিনি জনপ্রিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগানকে একটি চিঠি পর্যন্ত লিখেছিলেন।
এখন পর্যন্ত এই ওয়াও! সিগন্যাল এলিয়েন রেডিও যােগাযােগ ব্যবস্থার একটি অন্যতম মূল্যবান উপাত্ত হিসেবে বিবেচিত। সিগন্যালটি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিলেও সেগুলোর কােনটাই সর্বজনগ্রাহী হয় নি। ধারণা করা হয়েছিল, সংকেতটি প্রথমবার আসার প্রায় ৩ মিনিট পর এটির পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এহম্যান ১ম বার সংকেত পাবার পর পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা চালান, কিন্তু পুনরায় এই সংকেতটি আর কখনােই পৃথিবীতে ফিরে আসেনি।
১৯৯৫ সাল এইচ. পল স্নুচ একটি গান রচনা করন এই বিখ্যাত ওয়াও! সিগন্যাল নিয়ে। নাম দেন ব্যালাড অফ ওয়াও! সিগন্যাল। বিখ্যাত সাই ফাই টিভি সিরিজ
দ্যা এক্স ফাইলস এর একটি পর্ব, লিটিল গ্রিন মেন এ এই সিগন্যালর কথা বলা হয়। পপ কালচারে সিগন্যালটি খুবই বিখ্যাত, সাধারণ মানুষ একে এলিয়েন সংকেত বলেই মনে করেন।
রহস্যময় এই মহাজাগতিক সংকেত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আলােড়ন সৃষ্টি করা একটি খবর দিয়ে শেষ করা যাক। আমাদের সৌরজগত থেকে বহুদূরের একটি ছায়াপথ থেকে আসা আরও একটি রহস্যময় সংকেত পাবার ব্যাপারে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গনমাধ্যমে জানিয়েছেন। কানাডার একটি টেলিস্কোপে কিছুদিন আগে সংকেতটি ধরা পড়েছে। তবে সংকেতটির অর্থ কিংবা উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে বিজ্ঞানীরা কিছু বলতে পারেন নি। এর মধ্য ১৩টি দ্রুত গতির বিষ্ফােরণের মত বেতার তরঙ্গ রয়েছে, সেটি বারবার ঘুরে যেন ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসছে। একে বিজ্ঞানীরা ফাস্ট রেডিও বার্স্ট বা এফ আর বি বলে বণর্না করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে শব্দটি প্রায় দেড় হাজার আলােকবর্ষ দূরের কােন উৎস থেকে এসেছে ।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়র জ্যাের্তিবিজ্ঞানী ইনগ্রিড স্টয়ারস বলেন, “এটা জানবার পর আরাে একবার এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে ,এই মহাবিশ্বের অন্য কােথাও কিছু একটা নিশ্চয়ই রয়েছে, যা থেকে নিয়মিত বিরতিতে শব্দটি উৎপন্ন হচ্ছে। “
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ওকানাগান উপত্যকায় ১০০ মিটার লম্বা এন্টেনা নিয়ে শাইমি গবেষণাগারটি অবস্থিত। মূলত এই গবেষণাগারের এন্টেনাতে সাম্প্রতিক সময়ে সংকেতটি ধরা পড়েছে। সম্প্রতি এটি কাজ শুরু করবার পর মহাবিশ্বের ১৩টি মহাজাগতিক বিষ্ফারণের শব্দ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি তরঙ্গ কয়েকবারই ফিরে ফিরে এসেছে।
হয়ত এই সংকতগুলাে আমাদের এই পৃথিবীবাসীদের জন্য বিশেষ কিছুর বার্তা বহন করছে। এমন কি হতে পারে না, কোন ভীনগ্রহবাসী সেদিন এই ওয়াও সিগন্যালের মাধ্যমে হয়ত আমাদের বলতে চেয়েছিল,
" হ্যালো দেয়ার! এসো এক কাপ গরম ধোঁয়া ওঠা কফি হয়ে যাক! "
হতেও তো পারে, কে জানে………….
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply