স্বপ্নে পাওয়া আবিষ্কার

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

যুগে যুগে মুনি-ঋষিরা স্বপ্নে নানান কল্যাণকর কিছুর খোঁজ পেতেন- এইরকম গল্প শৈশবে অনেকই শোনেছি। সেসব কতটা সত্যি তার বিচার বিশ্লেষণ করার কথা বলছি না। তবে কিছু নামকরা বিজ্ঞানীদের নামের সাথে কিন্তু এই কথাটি সত্যি সত্যি এঁটে গেছে। তাঁদেরই  মধ্যে একজন হচ্ছেন জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ অগাস্ট কেকুলে। এই বিজ্ঞানী বিখ্যাত হয়ে আছেন যে দুটি বড় আবিষ্কারের জন্যে তার সবকটিই নাকি তিনি স্বপ্নে কল্পনা করতে পেরেছিলেন। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে “বেনজিন” যৌগটি বেশ পরিচিত। জৈব রসায়ন এর ব্যাপারে ভালো দখল না অর্জন করতে পারলেও বেনজিন কে চেনে সবাই-ই। ষড়ভুজাকার এই জৈব যৌগটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়ও বটে। “বেনজিন” শব্দটি এসেছে “গাম বেনজোইন” থেকে। 

Friedrich August Kekule von Stradonitz –inventor of benzene structure
জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ অগাস্ট কেকুলে।

স্টাইরাক্স গণের অন্তর্ভুক্ত কতগুলো গাছের বাকল থেকে পাওয়া যায় এই “গাম বেনজোইন” নামক রাসায়নিক। এই রাসায়নিক সাধারণত বিভিন্ন সুগন্ধি এবং ধূপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর পেছনে কারণ বোধ হয় এর সুমিষ্ট ভ্যানিলা গন্ধ। ভারতে এটি লোবান বা ধূপ নামে পরিচিত। যদিও এই লোবান মূলত এসেছে আরব থেকে। মধ্যযুগে আরবে বিভিন্ন ধরণের সুগন্ধি প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হত এই গাম বেনজোইন। আরবি ভাষায় একে বলা হত লুবান জায়ি। ইউরোপেও বিভিন্ন সুগন্ধি সামগ্রী প্রস্তুত করতে এবং ঔষধশিল্পে ব্যবহৃত হত এই বেনজোইন। ষোলো শতকে ইউরোপীয়রা বেনজোইন এর শুষ্ক পাতন প্রক্রিয়ায় বেনজোয়িক এসিড প্রস্তুত করেন। উনিশ শতকের দিকে রসায়নবিদরা বেনজোইল পরিবারের আরও কিছু রাসায়নিক যৌগ সম্পর্কে জানেন। বলে রাখা ভালো যে, বেনজিন এবং বেনজিন থেকে প্রস্তুত সকল রাসায়নিক যৌগকে একসাথে বেনজোইল পরিবার বলে।

“গাম বেনজোইন” ভারতে লোবান বা ধূপ নামে পরিচিত।

১৮২৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশন এর মাইকেল ফ্যারাডে ছয় কার্বন বিশিষ্ট একটা রাসায়নিক যৌগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হোন এবং তিনি এর নাম দেন বাইকার্বোরেট অব হাইড্রোজেন। ১৮৩০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে ফ্যারাডের পাওয়া বাইকার্বোরেট অব হাইড্রোজেন কে নিয়ে গবেষণা করেন ইলহার্ড মিটসচারলিচ। তিনি এই যৌগটির নামকরণ করলেন “বেনজিন”। পরবর্তীতে বেনজোইল পরিবারের আরও কিছু সদস্য আবিষ্কার করেন ফ্রেডরিখ উহলার এবং জাস্টাস লিবিগ। ১৮৫০ সালের দিকে আলকাতরার আংশিক পাতন এর মাধ্যমে বেনজিন এবং বেনজিন জাতক অন্যান্য সদস্যদের সহজেই উৎপাদন করা যাচ্ছিল। কিন্তু তখনও বেনজিন এর রাসায়নিক গঠন অজানাই থেকে গেল।

Learn Benzene - Structure in 3 minutes.
মাইকেল ফ্যারাডে।

 উনিশ শতকের দিকে বেনজিন রিং এর গঠন কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলেন। ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গেছে যে বেনজিন যৌগটি ছয় কার্বন বিশিষ্ট এবং এর সাথে যুক্ত আছে ছয়টা হাইড্রোজেন (বেনজিন এর আণবিক সংকেতঃ C6H6)। এখানেই যত সমস্যা! কেননা তখন সবাই-ই জানেন যে, কার্বন এর যোজনী হচ্ছে চার। সুতরাং এর সাথে সর্বোচ্চ চারটি হাইড্রোজেন যুক্ত হতে পারার কথা। কোনভাবেই এই সমস্যার সুরাহা যখন হচ্ছিল না তখন ১৮৬৫ সালের দিকে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ অগাস্ট কেকুলে একটা গবেষণা পেপার প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বেনজিন এর একটা চাক্রিক ষড়ভুজাকার গঠনের কথা উল্লেখ করেন। ছয়টা কার্বন নিজেদের মধ্যে সমযোজী বন্ধন করে ষড়ভুজাকার রিং গঠন করে। ছয়টা হাইড্রোজেন রিং এর বাইরের দিকে ছয়টা কার্বন এর সাথে যুক্ত থাকে। রিং এর ভেতরে থাকে তিনটি চক্রাকার পাই সমযোজী বন্ধন। কেকুলের দেয়া বেনজিন এর গঠন গবেষক মহলে বেশ ভালো গ্রহনযোগ্যতা পায়।

কেকূলের স্বপ্নে দেখেছিলেন একটা সাপ যেন নিজের লেজ কামড়ে ধরে আছে।

পরবর্তীতে ১৮৯০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া ২৫তম “বেনজিন সিম্পোজিয়াম” এ কেকুলে তার আবিষ্কার সম্বন্ধে বলেন, “ তিনি বেনজিন এর গঠন স্বপ্নে দেখতে পেয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে বেলজিয়ামে এক শীতে তিনি তাঁর সদ্য লিখতে শুরু করা একটা পাঠ্যবই নিয়ে বসেছিলেন। লেখা এগোচ্ছে না দেখে তিনি তাঁর চেয়ারটা আগুনের সামনে টেনে নিয়ে আরাম করে বসেছিলেন এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি একটা স্বপ্ন দেখেন। অনেক গুলো কার্বন পরমাণু তাঁর চোখের সামনে নাচানাচি করছে। কিছুক্ষন পর সেগুলো একটার সাথে একটা জোড়া লেগে যাচ্ছে। তারপর সেগুলো সাপের মতন সর্পিলাকারে ঢেউ খেলছে। একসময় প্রথম পরমাণুটা শেষ এর পরমাণুটার সাথে জোড়া লেগে যায় ঠিক যেন একটা সাপ তার নিজের লেজটাকেই কামড়ে ধরে আছে।” এই স্বপ্ন থেকেই নাকি কেকুলে বেনজিন এর ষড়ভুজাকার গঠন সম্বন্ধে ধারণা পান।  

১৯৯৬ সালের আগের দ্য নিউইইয়র্ক টাইমসের একটা আর্কাইভ। তখনও অনলাইন ভার্সন চালু হয় নি। আর্কাইভটিতে কেকুলের বেনজিন রিং এর গঠন দেখা স্বপ্ন নিয়ে একটা আর্টিকেল ছাপা হয়েছিল।

এর আগেও কেকুলে স্বপ্নে আরেকটি বড় আবিষ্কার সম্পর্কে নাকি ধারণা পেয়েছিলেন। ১৮৫৪ কি ১৮৫৫ সালের দিকের কথা। এক সন্ধ্যায় তিনি লন্ডনে একটা ঘোড়ার গাড়ি তে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি এবং সেসময় দেখলেন একটা যুগান্তকারী স্বপ্ন। কার্বনের পরমাণুর নাচন। সেগুলো নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে একটা বড় শিকলের ন্যায় গঠন তৈরি করে ফেলছে। কার্বনের এই ধর্মের নাম ক্যাটেনেশন প্রোপারটি। এই স্বপ্ন থেকে কেকুলে কার্বনের টেট্রাভ্যালেন্সি সম্বন্ধে ধারণা পান। কেকুলে আসলেই স্বপ্নে এতসব কিছুর ধারণা পেয়েছেন কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু তার গবেষণা গুলো আধুনিক জৈব রসায়ন বিশেষ করে কার্বন ভিত্তিক রসায়নের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এভাবেই রসায়নে বিখ্যাত হয়ে আছে ফ্রেডরিখ অগাস্ট কেকুলের নামটি।

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 275-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers