আপনার দিনের পুরোটা সময় কি একই ভাবে কাটে? সব সময় আনন্দে? এই হয়ত বন্ধুবান্ধবের সাথে হৈ হুল্লোড় করছেন, পরক্ষণেই আবার ঘরের কোণে মুখ কালো করে বসে রয়েছেন। আপনার এই মন খারাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল এক আশ্চর্য ব্যাপার। একেবারে বিনা কারণেই আপনার মনটা খারাপ।
যে কোন কাজে আপনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এতে করে আপনি শারীরিক এবং মানষিক উভয় ক্ষেত্রেই নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে আপনি এতটাই মানুষিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন যে জীবনটাকে নিতান্তই অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার কোন মানে খুঁজে পাচ্ছেন না।
![monochrome photo of man covering his face](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/pexels-photo-1556716.jpeg?resize=1880%2C1165&ssl=1)
এটাই হল বিষন্নতা, আমাদের এক অতিপ্রাচীন শত্রু। এই বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন অপরাধ, অসংখ্য আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।
ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিল বিষন্নতা জিনিসটাকে বরাবরই ভীষণ ভয় পেতেন। তিনি বিষন্নতাকে “ব্ল্যাক ডগ” বা কালো কুকুর নামে একটি রুপক নামকরণ করেছিলেন।
যখনই তার সামনে এই ব্ল্যাক ডগ রুপকের বিষন্নতা আসত, তিনি যেন বিছানা থেকেই নড়বার কোন শক্তি পেতেন না। তখন তিনি অবসন্নতায় আছন্ন হয়ে কোন বিষয়ে আগ্রহ পেতেন না, কাজ করবার জন্য যেন কোন শক্তিও তার শরীরে থাকত না। এমনকি বিষন্ন থাকলে তাঁর খাবারের রুচিও একেবারে চলে যেত!
![Here's Why Winston Churchill Did NOT have Depression. - Churchill Central](https://i0.wp.com/www.churchillcentral.com/wp-content/uploads/2019/02/1061979091.jpg?ssl=1)
প্রাক্তন এই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বিষন্নতার এই ব্ল্যাক ডগ নামের রুপকটিকে শুধু উদ্ভাবনই করেন নি, একই সাথে নামটিকে জনসাধারণের মাঝে পরিচিত করিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ এই ব্ল্যাকডগ থেকে রোগীকে উপশম দিতে নানা ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এদের ভেতর রয়েছে নানা ধরনের ওষুধ এবং সাইকোথেরাপি। তবে এত সব পদ্ধতি অনুসরণ করবার পরেও অনেক রোগীর ভেতর বিষন্নতা থেকেই যায়, তারা পুরোপুরি সুস্থ হন না। গবেষকরা তাই চেষ্টা করছেন পুরনো ওষুধ এবং সাইকোথেরাপির উন্নয়ন ঘটাতে। পাশাপাশি তারা চেষ্টা করছেন যাতে বিষন্নতার নতুন ধরনের ওষুধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটানো যায়।
বর্তমানে এই গবেষণার ক্ষেত্রে এক আশাজাগানিয়া পদ্ধতি হল মাইক্রোবায়োম- গাট-ব্রেন এক্সিস। আমাদের শরীরের ভেতরে কিংবা বাইরে যে মাইক্রোঅর্গানিজম বা অনুজীবগুলো বসবাস করে, তাদের সামগ্রিকভাবে মাইক্রোবায়োম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যেমন উদাহরণস্বরূপ আমরা ইন্টেসটাইনাল ফ্লোরা বা অন্ত্রের পরজীবির কথা বলতে পারি। এই অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে।
![Microbiome Probiotic Supplements | Biom Probiotics](https://i0.wp.com/biomprobiotics.com/wp-content/uploads/2021/08/Biom-gut-flora-1.png?ssl=1)
সাম্প্রতিক গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অব বাসেল এবং ইউনিভার্সিটি সাইক্রিয়াট্রিক ক্লিনিক বাসেল এর গবেষকেরা লক্ষ্য করেন, প্রোবায়োটিকস যদি এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের সাথে একই সময়ে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে রোগ উপশমে সেটি দারুণ ভাবে সহায়তা করে। সম্প্রতি তাঁরা দ্য জার্নাল ট্রান্সলেশনাল সাইকিয়াট্রিতে এই গবেষণার ফলাফলগুলো প্রকাশ করেছেন।
বিষন্নতা কিংবা বিভিন্ন ধরনের মানষিক রোগীদের উপর পূর্বের বিভিন্ন গবেষণা থেকে একটা বিষয় অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেটা হল এধরনের রোগীদের কম বেশি প্রায় সবারই অন্ত্র এবং পরিপাকের সমস্যা থাকে। বিষন্নতা কিংবা বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির অন্ত্রের অনুজীব বা ইন্টেসটাইল ফ্লোরাকে যদি পরীক্ষাগারে বড় করা ইদুরের শরীরে প্রবেশ করানো হয়, দেখা যাবে তারাও বিষন্নতার বিভিন্ন লক্ষ্মণ দেখাতে শুরু করবে!
উদাহরণস্বরুপ তারা তাদের জোড়ার স্বাভাবিক ইদুরটি থেকে কম শক্তিশালী হবে, তাদের পারিপার্শ্বিকতার দিকে আগ্রহ কমে যাবে। এসব থেকে গবেষকেরা সন্দেহ করছেন অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াদের বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণে বিষন্নতার এসব লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে।
![Bifidobacterium Bifidum - Bifidobacterium Longum - Supplements Global](https://i0.wp.com/www.supplementsglobal.com/wp-content/uploads/2013/08/e-coli-bacteria-optibac-probiotics.jpg)
ড. আন্দ্রে স্কিমিড এবং প্রফেসর আনডিন ল্যাং সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। সেখানে তাদের দ্বারা পরিচালিত গবেষক দল বিষন্নতায় আক্রান্ত রোগীদের উপর বিভিন্ন প্রোবায়োটিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের এই গবেষণার বেশিরভাগ রোগীই ছিলেন ইউনিভার্সিটি সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিক বাসেলের।
তাদের ভেতর ২১ জনের শরীরে প্রোবায়োটিক এবং ২৬ জনের শরীরে প্লাসিবো হিসেবে প্রায় ৩১ দিন ধরে দেয়া হয়। পাশাপাশি সবার ক্ষেত্রেই বিষন্নতা প্রতিরোধী ওষুধ বা এন্টিডিপ্রেসেন্ট প্রয়োগ করা হয়।
গবেষণাটি পরিচালিত হবার সময় এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করা রোগী বা এখানকার কর্মচারীদের কেউ কিন্তু জানত না, কোন রোগীকে কোন ওষুধ কতটুকু পরিমাণে দেয়া হয়েছে। গবেষকরা এই গবেষণাটি শুরু হবার ঠিক আগে, ৩১ তম দিন পার হবার পর এবং এর ঠিক ৪ সপ্তাহ পর রোগীদের উপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করেন।
তাদের এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, অংশগ্রহণ করা প্রতিটি রোগীর অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভাল হয়েছে, তার কারণ হিসেবে বলা যায় তারা সবাই এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ গ্রহণ করেছিলেন। তবে যারা প্রোবায়োটিক নিয়েছেন, তারা সেই প্লাসিবো গ্রুপটির তুলনায় অনেকগুণ বেশি তাড়াতাড়ি সুস্থ হচ্ছেন।
উপরন্তু দেখা গেছে তাদের ইন্টেসটাইনাল ফ্লোরার গাঠনিক উপাদানগুলো কিছু সময়ের জন্য হলেও বদলে গিয়েছে। প্রোবায়োটিক সেবনকারী রোগীদের মল পরীক্ষা করে দেখা যায়, গবেষণার নিদির্ষ্ট সময় পরে তাদের মলে ল্যাকটিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি তাদের বিষন্নতার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
![Do probiotics actually do anything? – 60 Minutes - CBS News](https://i0.wp.com/assets3.cbsnewsstatic.com/hub/i/r/2020/06/28/e409abc5-d0f0-497b-9e48-6e67ba6d6cf4/thumbnail/1200x630/c32777152e265dc39b3d8c84764203f4/60-probiotics0-2071467-640x360.jpg?resize=640%2C360&ssl=1)
যাইহোক, ৪ সপ্তাহ পরে যখন আবার গবেষকরা এই রোগীদের উপর পরীক্ষা চালান, তখন দেখা যায় তাদের অন্ত্রে আবার এই উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে গেছে!
“হয়ত এই চার সপ্তাহের প্রোবায়োটিকের চিকিৎসা রোগীদের জন্য যথেষ্ট নয়। ইন্টেসটাইনাল ফ্লোরার নতুন উপাদানগুলোকে স্থির৷ অবস্থায় আনতে হয়ত এই চিকিৎসা আরও দীর্ঘ সময় ধরে হওয়া প্রয়োজন! “
বলছিলেন অ্যানা চিয়ারা, তিনি এই গবেষক দলের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন।
আরেকটি আগ্রহউদ্দীপক বিষয় হল বিজ্ঞানীরা এই প্রোবায়োটিক গ্রহণের সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যক্রমের একটি ক্ষীণ যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন। তারা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ( fMRI) ব্যবহার করে এই গবেষণাটি করেন। এতে দেখা যায় বিষন্নতার ভোগা মানুষগুলোর মস্তিষ্কের কিছু নিদির্ষ্ট অংশ, যেগুলো আবেগ তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণের কাজ করে, সেগুলো ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
একারণেই তারা স্বাভাবিক মানুষ থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, চার সপ্তাহ ধরে প্রোবায়োটিক নেয়া রোগীগুলোর মস্তিস্কের কার্যক্রম অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু অপরদিকে সেই প্লাসিবো বা ট্রায়াল গ্রুপের রোগীদের মানসিক অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
“যদিও মাইক্রোবায়োম- গাট- ব্রেন এক্সিসের বিষয়টি অনেক বছর ধরে চলে গবেষণার একটি অংশ, এদের আসল কার্যক্রমটি ঠিক কিভাবে ঘটে সেটা নিয়ে আমাদের পরিষ্কার হবার প্রয়োজন রয়েছে। “ অ্যানা বলছিলেন।
![Nutrients | Free Full-Text | Nutrition, Microbiota and Role of Gut-Brain Axis in Subjects with Phenylketonuria (PKU): A Review](https://i0.wp.com/www.mdpi.com/nutrients/nutrients-12-03319/article_deploy/html/images/nutrients-12-03319-g001.png?ssl=1)
গবেষকরা বিষন্নতার নতুন চিকিৎসা হিসেবে এমন অসংখ্য ব্যাকটেরিয়াকে প্রোবায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যাতে আরও নির্ভূল ফলাফল আসে।
বর্তমানে বাজারে এমন বহুল ব্যবহৃত অসংখ্য ধরনের প্রোবায়োটিক রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ল্যাক্টোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস, বাইফিডোব্যাকটেরিয়াম লংগাম, বাইফিডোব্যাকটেরিয়াম বাইফিডাম, ল্যাক্টোব্যাসিলাস র্যামনোসাসের কথা বলা যায়। বর্তমানে এগুলো ডায়রিয়া সহ বিভিন্ন রোগে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষকরা বলেন, “যদি নিদির্ষ্ট প্রকৃতির ব্যাকটেরিয়াগুলো সম্পর্কে আমরা আরও ভাল ভাবে জানতে পারি, তাহলে সেগুলোর পরিমিত মিশ্রণ ঘটিয়ে আমরা বিষন্নতার নতুন চিকিৎসার পথে হাটতে পারি।”
তবে তারা শুধুমাত্র এই প্রোবায়োটিক ওষুধগুলোকে বিষন্নতার একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান না। এক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
Journal Reference:
Leave a Reply