ধুমকেতু নিয়ে মানুষের কৌতুহল ও বিস্ময়বোধ প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো।
প্রাচীনকালে ধুমকেতু নিয়ে মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবীর আকাশে ধুমকেতু দুর্ভিক্ষ, মহামারী যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি সাথে করে নিয়ে উদয় হয়। সৌরজগতের এক বিচিত্র বস্তু হল ধুমকেতু। মধ্যযুগ অবধি মানুষ বুঝতেই পারেনি ধুমকেতুর ব্যাপারটি আসলে কি?
বর্তমানে আমরা প্রবেশ করেছি ধুমকেতু নিয়ে গবেষণার যুগে। এই লেখায় ধুমকেতু সম্পর্কে বিষদ জানার চেষ্টা করবো। ইংরেজীতে ধুমকেতুকে বলে কমেট (Comet)। এই কথাটা এল কেমন করে?
ঝাঁকরা চুলকে গ্রীক ভাষায় বলে “কমেটিজ”। তার সাথে এর রুপের সাদৃশ্য মিলিয়ে নামকরণ করা হয়েছে “কমেট”। বাংলায় একে বলে “ধোঁয়ার নিশান” আবার অনেকে একে “ঝাঁটা তারা” ও বলে।
খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকে রোমান দার্শনিক সেনকা সর্বপ্রথম বললেন যে ধুকেতুরা পৃথিবীর সম্পূর্ন বাইরের বস্তু এবং নির্দিষ্ট পথে এরা গমনাগমন করে। এ্যারিস্টটল বলেন যে, পৃথিবীর মাটি থেকে বাস্পীভবনের ফলে ধুমকেতুর উৎপত্তি।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-18.png?resize=144%2C196&ssl=1)
মধ্যযুগে কেপলারের মত দিলেন, ধুমকেতু মহাকাশে সরলরেখায় চলাচলের সময় হঠাৎ করে সৌরজগতের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং পৃথিবীর কাছ দিয়ে চলে যাবার সময় একবার দেখা দিয়ে সেই যে চলে যায় আর কখনো ফিরে আসে না। গ্যালিলিও মনে করতেন, পৃথিবী থেকে বাষ্প আকাশে উঠে সূর্যের আলোর প্রতিসরণের ফলে ধুমকেতুর উৎপত্তি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই ধারনা পোষন করে গেছেন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-19.png?resize=394%2C394&ssl=1)
ফরাসী গনিতবিদ ল্যা-প্ল্যাস এর মতে, ধুমকেতুর সৃষ্টি হয়েছে বহু বছর আগে আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ থেকে।
ধুমকেতু সম্পর্কে গুরত্বপূর্ন তথ্য দিয়েছিলেন বিখ্যাত জ্যেতির্বিদ টাইকো ব্রাহে। বাল্টিক সাগরের ভেন দ্বীপে তার একটি মান মন্দির ছিল। গণিতে তার তেমন দক্ষতা ছিল না, কিন্ত তার আকাশ পর্যবেক্ষণের দক্ষতা ছিল নিঁখুত ও নির্ভূল। তিনি এই মানমম্দির থেকে ২০ বছর আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন এবং আকাশের নক্ষত্রদের মানচিত্র ও গ্রহদের গতিবিধির তথ্য লিপিবদ্ধ করে যান।
১৫৭৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি আকাশে একটি উজ্জল ধূমকেতুকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এবং রাতের পর রাত তিনি সেই ধুমকেতুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-20.png?resize=132%2C98&ssl=1)
এখান থেকেই তিনি প্রথম আবিস্কার করেছিলেন যে ধুমকেতুরাও সূর্যের চারদিকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের মতো। এরাও সৌরজগতের আদি বাসিন্দা। এই হলো ধুমকেতু সম্পর্কে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ধারনা।
একটি ধুমকেতু সূর্যের কাছে আসার সাথে সাথে এটি উষ্ণ হয়। এই উষ্ণতার সময়, ধুমকেতুর বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র অংশ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন:
- নিউক্লিয়াস
- কোমা
- হাইড্রোজেন আচ্ছাদন
- ধুলো লেজ
- আয়ন লেজ
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-21.png?resize=328%2C262&ssl=1)
ধুমকেতুর শারীরিক গঠন
ধূমকেতু হল হিমায়িত গ্যাস, শিলা এবং ধূলিকণার বরফের দেহ। বিজ্ঞানীরা কখনও কখনও ধূমকেতুকে নোংরা তুষার বল বা তুষারময় ময়লা বল বলেন। একটি ধূমকেতু প্রাথমিকভাবে একটি নিউক্লিয়াস, কোমা, ধুলো এবং প্লাজমা লেজ নিয়ে গঠিত।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-22.png?resize=492%2C328&ssl=1)
নিউক্লিয়াস: ধুমকেতুর নিউক্লিয়াস হল পানি, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া সহ অন্যান্য অজৈব এবং জৈব অণুর ধুলো সহ হিমায়িত কণা সমন্বিত একটি ধূমকেতুর কঠিন কেন্দ্র। নিউক্লিয়াস হল ধূমকেতুর প্রধান, কঠিন অংশ। নিউক্লিয়াস সাধারণত ১ থেকে ১০ কিলোমিটার ব্যাস হয়, তবে ১০০ কিলোমিটারের মতো বড় হতে পারে। এটি শিলা দ্বারা গঠিত হতে পারে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-23.png?resize=164%2C164&ssl=1)
কোমা: একটি ধূমকেতু সূর্যের কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথে সূর্যের তাপে নিউক্লিয়াসের পৃষ্ঠের বরফ গ্যাসে পরিণত হতে শুরু করে। এবং ধুমকেতুর চারপাশে একটি মেঘ তৈরি করে যা কোমা নামে পরিচিত। কোমা হল বাষ্পীভূত গ্যাস (জলীয় বাষ্প, অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইড) এবং নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকা ধূলিকণার একটি হ্যালো। কোমা প্রায়ই নিউক্লিয়াসের চেয়ে ১,০০০গুণ বড় হয়। এমনকি এটি বৃহস্পতি বা শনির (১০০,০০০ কিলোমিটার) মতো বড় হতে পারে। কোমা এবং নিউক্লিয়াস একসাথে ধূমকেতুর মাথা তৈরি করে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-24.png?resize=328%2C328&ssl=1)
হাইড্রোজেন আচ্ছাদন: কোমাকে ঘিরে একটি একটি অদৃশ্য হাইড্রোজেন আচ্ছাদন থাকে যা ৬.২ মিলিয়ন মাইল (১০ মিলিয়ন কিলোমিটার) পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে তৈরি হাইড্রোজেন পানির অণু থেকে আসতে পারে। এটি সাধারণত একটি অনিয়মিত আকার ধারণ করে, কারণ এটি সৌর বায়ু দ্বারা বিকৃত হয়। ধুমকেতু সূর্যের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে হাইড্রোজেন আচ্ছাদনটি বড় হতে থাকে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-25.png?resize=132%2C130&ssl=1)
লেজ: এই লেজের জন্যই ধুমকেতু দেখতে এত সুন্দর। ধুমকেতুর লেজ না থাকলে ধুমকেতু দেখতে কোনই আর্কষনীয় বস্তু নয়। ধুমকেতু যখন সূর্য থেকে অনেক দুরে থাকে তখন এর কোন লেজ থাকে না, ধুমকেতু যখন সূর্যের কাছে আসতে থাকে তখন এর লেজ সৃষ্টি হয়। ধুমকেতুর দুই ধরনের লেজ হয় একটি ডাস্ট টেইল অন্যটি আয়ন টেইল বলা হয় (এটিকে প্লাজমা বা গ্যাস লেজও বলা হয়)। ডাস্ট টেইল দেখতে হালকা হলুদাভ আর আয়ন টেইল দেখতে নীলাভ। একটি ধুমকেতুতে ডাস্ট অথবা আয়ন যে কোন একটি লেজ থাকতে আবার একসাথে দুই ধরনের লেজও থাকতে পারে, যেমন হেল-বপ ধুমকেতুতে ডাস্ট এবং আয়ন দুই ধরনের লেজ ছিলো।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-26.png?resize=328%2C262&ssl=1)
ধূমকেতুর ধুলোর লেজ সর্বদা সূর্য থেকে দূরে থাকে। লেজটি ছোট (এক মাইক্রন) ধূলিকণা দিয়ে তৈরি যা নিউক্লিয়াস থেকে বাষ্পীভূত হয়েছে এবং সূর্যের আলোর চাপে ধূমকেতু থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ধূমকেতুর ধুলোর লেজটি দেখতে সবচেয়ে সহজ কারণ এটি সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে এবং কারণ এটি দীর্ঘ, কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটার (আকাশের বেশ কয়েকটি ডিগ্রি)। ধুলোর লেজটি বাঁকা হয়।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-27.png?resize=420%2C578&ssl=1)
আয়ন লেজটি বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত গ্যাসের অণু দিয়ে তৈরি যা সৌর বায়ু দ্বারা নিউক্লিয়াস থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। কখনও কখনও, আয়ন লেজ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পরে আবার আবির্ভূত হয় যখন ধূমকেতু একটি সীমানা অতিক্রম করে যেখানে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক বিপরীত হয়।
ধুমকেতুর কক্ষপথ:
ধূমকেতু সৌরপরিবারের সদস্য হলেও আকাশ পথে এদের চলাফেরা খুবই রহস্যময়। সৌরজগতের গ্রহগুলো একটি উপবৃত্তাকার পথে সুনির্দিস্ট বেগে এবং শৃঙ্খলার মধ্যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
অন্যদিকে ধুমকেতুর চলার পথ এক একটি বিশাল লম্বা উপবৃত্ত। অনেকটা পটলের আকৃতির মতো। এই রকম লম্বা পথের কারনে এক একটি ধুমকেতুর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিন করতে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ বছর সময় লাগে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-28.png?resize=184%2C138&ssl=1)
এমন অনেক ধুমকেতু আছে যাদের এখনো পর্যন্ত একবারই দেখা গিয়েছে, তারপর মহাকাশে উধাও হয়ে গিয়েছে। যে সব ধুমকেতুর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (Ellipse) তাকে ঠিক নির্দিষ্ট সময় পরপর সৌরজগতে ফিরে আসতেই হবে, এদেরকে বলে প্রত্যাবর্তনশীল (Periodic) ধুমকেতু। এইসব ধুমকেতুর গতিমাত্রা কেপলারের সুত্র মেনে চলে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-29.png?resize=264%2C328&ssl=1)
আবার কোন কোন ধুমকেতুর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রকতা বৃদ্ধি পেয়ে এমন একটি অবস্হায় পৌছাতে পারে, তখন এর কক্ষপথ বন্ধ না হয়ে মুক্ত হয়ে পড়ে। তখন একে বলা হয় অধিবৃত্ত (Parabola) অথবা পরাবৃত্ত (Hyperbola)।
এরকম ধুমকেতুর বেলায় এ অবস্থার সৃষ্ট হলে সেই ধুমকেতুকে হয়তো বা এখনো পর্যন্ত একবার দেখা গিয়েছে, সে আবার আদৌ আসবে কিনা সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা চলে না। এই রকম ধুমকেতুকে বলা হয় অপ্রত্যাবর্তনশীল (Non-periodic) ধুমকেতু।
আজ পর্যন্ত যত ধুমকেতুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে তাদের এই দুই শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ধুমকেতুর পরিক্রমণ পথ ও পরিক্রমণকাল নির্নয় করা খুব কঠিন। একে নির্ণয় করতে হলে একটা সময়ের ব্যাবধানে আকাশে ধুমকেতুটির অন্তত তিনটি অবস্হান নির্ভূলভাবে জানা খুবই জরুরী।
এর মধ্যে প্রত্যাবর্তনশীল ধুমকেতুদের আবার তিন শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। যেমন:
১. স্বল্পমেয়াদী (Short-Period) ধুমকেতু: এরা ৩.৩ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে, ধুমকেতু যখন সূর্যকে পরিক্রমণ করে, তখন কিন্ত সূর্যকে ঠিক মাঝখানে রেখে ঘোরে না। সূর্য থাকে উপবৃত্তের একটু কোনের দিকে, যাকে বলা হয় উপবৃত্তের নাভি (Focus)।
এই স্বল্পমেয়াদী ধুমকেতুগুলো হল অনুজ্জল এবং এদের কোন লেজের উৎপক্তি হয় না। এই রকম একটি স্বল্পমেয়াদী ধুমকেতু হল “এন্কের ধুমকতু” যা ১৭৮৬ সালে আবিস্কার করা হয়েছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-30.png?resize=394%2C222&ssl=1)
আজ পর্যন্ত যত ধুমকেতু আবিস্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে এই ধুমকেতুটির পরিক্রমনকাল হল সবচেয়ে কম ৩.৩ বছর। এটি আবিস্কারের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫০ বারেরও বেশী এটি পৃথিবীর আকাশে দেখা দিয়েছে। এই সব ধুমকেতুর অপসূর (Aphelion) অবস্হান কখনো বৃহস্পতির কক্ষপথের বাইরে যায় না।
২. মধ্য মেয়াদী (Medium-period) ধুমকেতু: এদের কক্ষপথ আরও বিস্তৃত হয়ে থাকে এবং অপসূর (Aphelion) অবস্হান ইউরেনাস গ্রহের কক্ষপথের কাছাকাছি চলে যায়। এদের কক্ষপথ পরিক্রমণকাল সাধারনত ২০ বছর থেকে আরম্ভ করে প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়। এরকম একটি ধুমকেতু হলো “ক্রমেলিন” (Crommelin) এর পরিক্রমণ কাল ২৮ বছর।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-31.png?resize=118%2C148&ssl=1)
৩. দীর্ঘমেয়াদী (Long-Period) ধুমকেতু: এইসব ধুমকেতুর পরিক্রমনকাল ৬০ বছর থেকে আরম্ভ করে ১৬৪ বছর পর্যন্ত। এই শ্রেনীর ধুমকেতুর মধ্যে “হ্যালীর” ধূমকেতু হলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-32.png?resize=250%2C312&ssl=1)
এটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ফিরে আসে। ১৯৮৬ সালে এটি শেষ সূর্যকে প্রদক্ষিন করে গেছে আবার দেখা যাবে ২০৬১ সালে।
অপ্রত্যাবর্তনশীল ধুমকেতু: এই শ্রেনীতে আছে অনেক উজ্জল এবং অনুজ্জল ধুমকেতু। এই শ্রেনীর ধূমকেতুর মধ্যেও এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্ত পথে পরিক্রমন না করে উপবৃত্তকার পথেই পরিক্রমণ করছে।
কিন্ত পরিক্রমনকাল কখনো কখনো কয়েক কোটি বছর পেরিয়ে যায় তাই এরকম ধুমকেতুকেও অপ্রত্যাবর্তনশীল শ্রেণীতেই ফেলা হয়। তার কারণ এদের পুনরাগমনের পূর্বাভাস দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই এদের পরিক্রমণপথ ঠিক কি রকম তা বলা সহজসাধ্য হয়ে উঠে না।
এই রকম দুটি ধুমকেতু হলো ১৯৭৩ সালে আবিস্কৃত কোহুতেক (Kohoutek) এটি সূর্যকে একবার পরিক্রমন করতে ৭৫,০০০ হাজার বছর সময় নেয়।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-37.png?resize=148%2C100&ssl=1)
১৯১৪ সালে দেখা গিয়েছিল ধূমকেতু ডেলাভ্যান (Delaven) এর পরিক্রমনকাল নির্নয় করে দেখা গেছে, এটি আবার ২৪.০১৬৪৩৮ মিলিয়ন বছর পরে আবার ফিরে আসবে। কাজেই এর সম্পর্কে এইটুকু বলা যায় যে বহু বহু বছর পর্যন্ত একে আর পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে না।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-39.png?resize=254%2C354&ssl=1)
এমন দেখা গেছে যে কোন বৃহৎ গ্রহের টানে ধুমকেতুর অধিবৃত্তকার কক্ষপথ ছোট হয়ে গিয়ে উপবৃত্তকার হয়ে গিয়েছে। এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখে গ্রহরাজ বৃহস্পতি। সৌরজগতের সব গ্রহের সম্মিলিত ভরের চেয়ে বৃহস্পতির একার ভর প্রায় আড়াইগুন বেশী, আর পৃথিবীর ভরের ৩১৮ গুন বেশী।
এই গ্রহের টানে বেশ কয়েকটা ধুমকেতু এমন দশা প্রাপ্ত হয়েছে। প্রত্যাবর্তনশীল-স্বল্পমেয়াদী প্রায় ২৪টিরও বেশী ধুমকেতু এই গ্রহ পরিবারের অন্তর্গত।
এইসব ধুমকেতুর অপসূর অবস্হান কখনোই বৃহস্পতির কক্ষপথ পেরিয়ে যায় না। এদের বৃহস্পতি তার নিজের কক্ষের মধ্যে বন্দী করে রেখে দিয়েছে।
আবার এমনও হতে পারে বৃহৎ কোন গ্রহের টানে কোন ধুমকেতু একবারে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে
যায়। এই রকম একটি ধুমকেতু হলো বিয়েলা (Biela`s)। ১৮৪৫ সালে দেখা গেল ধুমকেতুটি ভেঙ্গে দুখন্ড হয়ে গিয়েছে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-41.png?resize=84%2C102&ssl=1)
মানব ইতিহাসের বিখ্যাত কিছু ধুমকেতু:
১৬৮০ সালের বিখ্যাত উজ্জ্বল ধূমকেতু এটি জার্মান জ্যেতির্বিদ গটফ্রায়েড কার্চ এটি আবিস্কার করেন। এটি এতই উজ্জ্বল ছিল যে একে দিনের বেলায়ও দেখা গেছে, এবং এর লেজটি আকাশের অর্ধেক জায়গা জুড়ে ছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-42.png?resize=230%2C182&ssl=1)
১৭৪৩ সালে ডি চেস্যু নামে একটি ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল, এবং এটির ছয়টি আলাদা আলাদা লেজ ছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-43.png?resize=124%2C86&ssl=1)
১৮১১ সালে যে ধুমকেতুটি দেখা গিয়েছিল, সেটি আজ পর্যন্ত যত ধুমকেতু দেখা গেছে তাদের মধ্যে এর কোমার ব্যাস ছিল সবচেয়ে বড় প্রায় ২০ লক্ষ কিমি। এর লেজের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৫ কোটি কিমি, আর সেটি চওড়ায় ছিল প্রায় আড়াই কোটি কিমি। এর পরিক্রমণকাল হল ৩,০০০ বছর। এটি আবিস্কার করেন Honoré Flaugergues।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-44.png?resize=336%2C222&ssl=1)
১৯১০ সালে ট্রান্সভ্যালের হীরকখনির শ্রমিকেরা দিনের আলোতে একটি ধুমকেতু দেখতে পান, এই জন্য ধুমকেতুটির নাম দেয়া হয় দিবালোকের ধুমকেতু (Daylight comet)।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-45.png?resize=82%2C56&ssl=1)
১৯৬৫ সালে দেখা যায় ধুমকেতু ইকিয়া-সেকি, এর লেজের দৈর্ঘ্য এতই বড় ছিল যে তা আকাশের ছয় ভাগের এক ভাগ জায়গা দখল করে ছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-46.png?resize=98%2C148&ssl=1)
গত শতক এবং সাম্প্রতিক সময়ের কিছু উজ্জল ধুমকেতু হল-হেল-বপ C/1995 O1, হায়াকুতাকা C/1996 B2, সবুজ C/2009 R1, (McNaught)।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-47.png?resize=420%2C420&ssl=1)
এর মধ্যে শতাব্দীর সব চেয়ে উজ্জল ধুমকেতু হেল-বপ।এই ধুমকেতুর দুটি লেজ ছিল একটি গ্যাস টেইল অন্যটি ডাস্ট টেইল।
যারা রাঁতের আকাশে ধুমকেতু খোঁজ করে তাদেরকে কমেট হান্টার (Comet hunter) বলে।
এদের দুটি উদ্দেশ্য থাকে – নতুন কোন ধুমকেতু আবিস্কার অথবা প্রত্যাবর্তনশীল কোন ধূমকেতুর পুনরাগমন হচ্ছে কিনা তা স্থির করা।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-48.png?resize=420%2C280&ssl=1)
ধুমকেতু খুজে বের করা খুব কঠিন কাজ এর জন্য প্রয়োজন অসীম ধৈর্য্য।
বলতে পারেন ধুমকেতু খুঁজে বের করে লাভ কি?
লাভ হল এই যে আপনি যদি নতুন কোন ধুমকেতু আবিস্কার করেন তবে ধূমকেতুটির নাম আপনার নামে হবে।
প্রতি বছরই নতুন নতুন ধুমকেতু আবিস্কার হয়, আর আজ পর্যন্ত যত ধুমকেতু আবিস্কার হয়েছে তার বেশিরভাগ আবিস্কার করেছে সৌখীন জ্যেতির্বিদরা। তাই আন্তর্জাতিক আ্যস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU) ধুমকেতুর নাম রাখার জন্য একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে।
যে ব্যাক্তি নতুন ধুমকেতু আবিস্কার করবেন তার নামে ধূমকেতুটির নামকরন করা হবে, তবে সর্বোচ্চ দুইজনের নামে (একটি নতুন ধুমকেতু যদি একইসাথে দুজন ব্যাক্তি আবিস্কার করে তা পৃথিবীর যে প্রান্তে বসেই করুক না কেন) নামকরণ করা হয়।
এর অধিক হলে তখন তার নামকরন করা হয় যেই বছরে ধুমকেতুটি আবিস্কার হয়েছে সেই বছর এবং তার সাথে এক একটি ইংরেজী অক্ষর যোগ করে যেমন-1976a,1976b মানে হল 1976 সালে আবিস্কৃত প্রথম ও দ্বিতীয় ধুমকেতু।
এর পরে ধুমকেতুটির পরিক্রমণপথ ও অনূসর (Perihelion passage) অবস্থান যখন সঠিকভাবে নির্নয় করা হয়, তখন এদের নামকরন করা হয় সালের সাথে রোমান হরফ জুড়ে।
আবার যে সব ধুমকেতু নির্দিষ্ট সময় পরপর সূর্যের নিকটতম অবস্থানে আসে, সেইসব প্রত্যাবর্তনশীল (Periodic) ধুমকেতুকে বোঝাবার জন্য ধুমকেতুটির নামের আগে P অক্ষরটি (Periodic) যুক্ত করা হয় যেমন-P/Halley।
তবে নামকরনের বেলায় এর ব্যাতিক্রম ও হয়েছে হ্যালীর ধুমকেতুর বেলায়, ঘটনাটি একটু খুলে বলি।
১৬৮২ সালে জার্মান জ্যেতির্বিদ জর্জ ডর্ফেল রাতের আকাশে একটি ধুমকেতু পর্যবেক্ষন করেন। এই ধুমকেতুটি ছিল অনেক বড় এবং উজ্জল সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে বিখ্যাত জ্যেতির্বিদ এডমন্ড হ্যালিও একে লক্ষ করলেন তখন তার বয়স ২৬ বছর।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-49.png?resize=196%2C196&ssl=1)
তখন তিনি চিন্তা করলেন ধুমকেতুর চলাফেরার কি কোন নিয়ম আছে, যেমন আছে গ্রহদের বেলায় এই ভেবে তিনি সেই ধুমকেতুটির সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করলেন। এবং এইসব তথ্য নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান আইজ্যাক নিউটনের কাছে গেলেন, নিউটন ইতিমধ্যে মহাকর্ষের বিধি আবিস্কার করে ফেলেছেন।
নিউটনের সাহায্যে নিয়ে হ্যালি সেই ধুমকেতুটির পরিক্রমন পথ পরিক্রমনকাল ইত্যাদি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সর্মথ হলেন। তিনি গণনায় দেখতে পেলেন এই ধুমকেতুটির সূর্যকে একবার পরিক্রমন করতে ৭৫-৭৬ বছর সময় লাগতে পারে। এরপর শুরু হলো অন্যরকম গবেষণা। তিনি সেইসময় দেশ বিদেশের ইতিহাস খুজতে লাগলেন যে অতীতে এই রকম কোন বড় এবং উজ্জ্বল ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল কিনা। তিনি খুজে পেলেন যে অতীতে ১৫৩১ ও ১৬০৭ সালে এমন দুটি উজ্জ্বল ধুমকেতুর আবির্ভাবের বিবরণ, যাদের সাথে ১৬৮২ সালের ধূমকেতুটির মিল আছে।
এরপরেই হ্যালি ঘোষনা করলেন তার গবেষণার চূড়ান্ত ফল। তিনি বললেন ১৫৩১ এবং ১৬০৭ সালে যে দুটি ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল। তারা আলাদা কোন ধূমকেতু নয়, ১৬৮২ সালে যে ধুমকেতুটি পৃথিবীর আকাশে দেখা গিয়েছিল তা নতুন কোন ধুমকেতু নয়। এটি ১৫৩১ এবং ১৬০৭ সালে দেখা যাওয়া ধুমকেতুটির পুনরায় আর্বিভাব। হ্যালী তখন বললেন এই ধুমকেতুটিকে আবার ১৭৫৮ সালে দেখা যাবে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-50.png?resize=118%2C148&ssl=1)
এবং ১৭৫৮ সালে বড়দিনের রাতে সেই ধুমকেতুটি আবার পৃথিবীর আকাশে দেখা দেয়, এবং হ্যালির গণনা র্নিভূল প্রমান হয়। কিন্ত হ্যালি এটা দেখে যেতে পারেনি তার আগেই ১৭৪২ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। আর হ্যালির এই র্নিভূল গণনার জন্য এই ধুমকেতুটির নামকরন করা হয়েছে তার নামে। ধুমকেতু যিনি আবিস্কার করেন তার নামেই ধুমকেতুর নাম রাখার প্রথা প্রচলিত। শুধুমাত্র হ্যালির ধুমকেতুর বেলায় এর ব্যাতিক্রম হয়েছে।
প্রত্যাবর্তনশীল ধুমকেতুর মধ্যে হ্যালি ব্যাতিক্রম। এটি আবিস্কারের পর থেকে ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের পর পর পৃথিবীর আকাশে আসে। এটি শেষ এসেছিল ১৯৮৬ সালে, এবং আবার আসবে ২০৬১। আর এই পর্যন্ত যত ধুমকেতু আবিস্কার করা হয়েছে তার বেশিরভাগই আবিস্কার করেছে সৌখিন জ্যোতির্বিদরা।
ধমকেতুর উৎপত্তি ও বির্পযয়ঃ ধুমকেতুরা মহাকাশের কোথা থেকে আসে, এই তর্কের সঠিক উত্তর আজো পাওয়া যায়নি। তবে পৃথিবীতে যতগুলি তত্ত্ব চালু আছে তার মধ্যে জ্যেতির্বিদ জন ঊর্টের তত্ত্বটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। তার মতে সৌরজগতের সীমানার বাইরে বস্তুর এক বিশাল এলাকা আছে যাকে ওর্ট ক্লাউড (Ort cloud) বলে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-51.png?resize=242%2C238&ssl=1)
দূরত্ব বেশী হবার কারণে এখানে সূর্যের আর্কষণ খুবই কম। এর পাশ দিয়ে অন্য কোন গ্রহ বা নক্ষত্র যাবার সময় তাদের মাধ্যার্কষণ শক্তির টানে এখান থেকে বস্তু ছিটকে সৌরজগতের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সূর্যের আর্কষণে আটকা পড়ে ধুমকেতু হিসাবে আর্বিভূত হয়।
নাসার মতে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, পরিচিত ধূমকেতুর বর্তমান সংখ্যা ৩,৭৪৩। যদিও আরও বিলিয়ন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে নেপচুনের বাইরে কুইপার বেল্টে এবং দূরবর্তী ওর্ট ক্লাউড প্লুটো ছাড়িয়ে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-52.png?resize=202%2C126&ssl=1)
ধুমকেতু কি পৃথিবীর জন্য কোন বিপদের কারণ হতে পারে?
ইতিহাস তাই বলে। ১৯০৮ সালে ৩০শে জুন রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের তুঙ্গুস্কা জঙ্গলে প্রচন্ড শব্দ ও আলোর ঝলকানি দিয়ে একটি বস্তু মাটিতে আছড়ে পরে এতে প্রায়, ৩২ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে সব বন জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন যে ঐ স্থানের ৬ কিঃমিঃ ওপরে একটি ধুমকেতুর সাথে পৃথিবীর সংর্ঘষ হয়েছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2022/06/image-53.png?resize=210%2C162&ssl=1)
কাজেই বড় আকারের কোন ধুমকেতু পৃথিবীর বিপদের কারন হতে পারে যদি তা জনবহুল কোন এলাকায় পড়ে, তবে তা হবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
ধুমকেতুদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ অনেক তাদের মতে এই ধুমকেতুতে চড়ে মহাকাশ থেকে পথিবীতে প্রাণের বীজ এসেছিল, এবং এছাড়া ও ধুমকেতুতে এমন কিছু মৌলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা পৃথিবীতে নেই। কাজেই ধুমকেতু পৃথিবীর জন্য যতই বিপদের কারন হোক না কেন এদেরকে অস্বীকার কোন উপায়, নেই কারন এরাও সৌরজগতের আদি বাসিন্দা।
Leave a Reply