কালপুরুষ নক্ষত্রমন্ডলের নাম আমরা কম বেশী সবাই শুনেছি। বিশেষ করে যারা রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসেন। গ্রাম বাংলায় একে অনেকে আদমসুরত নামেও চিনে।
এই নক্ষত্র মন্ডলে খুব বিখ্যাত একটি নীহারিকা আছে। এর নাম এম-৪২ (মেসিয়ার-৪২) বা বিখ্যাত কালপুরষের নীহারিকা। দ্যা গ্রেট ওরিয়ন নেবুলা। মায়ান সংস্কৃতিতে ওরিয়ন নেবুলাকে সৃষ্টির মহাজাগতিক আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই নাক্ষত্রিক নার্সারিটি মানব ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির কাছে পরিচিত।
কালপুরুষের তরবারির নক্ষত্র অরায়নিসের চারিদিকে এই নীহারিকাটির অবস্থান। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বৃহৎ নক্ষত্র-গঠনকারী অঞ্চল, যা ওরিয়ন মলিকুলার ক্লাউড কমপ্লেক্স নামে পরিচিত (ওরিয়ন কমপ্লেক্স)।
প্রায় ১৫০০ আলোকবর্ষ দূরে এবং ২৫ আলোকবর্ষ ব্যাসের এই নীহারিকাটি আকাশে দৃশ্যমান সবচেয়ে সক্রিয় নক্ষত্র গঠনকারী অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। ধারণা করা হয় এটি প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পুরানো।
গবেষকদের মতে, ওরিয়ন কমপ্লেক্সে ল্যাম্বডা ওরিওনিস ক্লাউডস, ওরিয়ন এ-ক্লাউড (যার মধ্যে ওরিয়ন নেবুলা রয়েছে) এবং ওরিয়ন বি-ক্লাউড (যার মধ্যে রয়েছে ফ্লেম নীহারিকা) সহ বেশ কয়েকটি আণবিক মেঘ রয়েছে।
এটি একটি বিক্ষিপ্ত (Diffuse) নীহারিকা। আর এই ধরনের নীহারিকা গুলো খুবই উজ্জল হয়। কারন এরা নিকটবর্তী নক্ষত্রদের থেকে শক্তি শোষন করে। এবং এভাবে পুনঃ পুনঃ দৃশ্যমান উজ্জল আলোর ন্যায় নির্গত হয়ে যা দর্শকের চোখে ধরা দেয়।
এর উজ্জ্বলতা এবং অবস্থানের কারণে এম-৪২ কে পৃথিবী খালি চোখে দেখা যায়। এর আপাত মাত্রা +৪। মানুষের চোখ সবচেয়ে যে ক্ষীণতম বস্তুটি দেখতে পারে +৬। অতএব, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ওরিয়ন নেবুলা সারা বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতাকে মোহিত করেছে।
কিন্ত দুরবীন দিয়ে দেখলে একে অদ্ভুত সুন্দর দেখা যায়। এর ভিতরে অনেক খালি জায়গা দেখা যায়। এর অনেক শাখা প্রশাখা চারিদিকে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এটি দেখতে অনেকটা সবুজ রংয়ের দেখা গেলেও ফটোগ্রাফিতে একে লাল দেখা যায়। সালফারের জন্য লাল দেখায় উত্তপ্ত হাইড্রোজেনের জন্য একে সবুজ এবং নীল দেখায় এর ভিতরে আয়োনিত অক্সিজেনের কারনে।
বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যেমে জানা যায়, এই নীহারিকাটির মধ্যে অনেক উত্তপ্ত অতি দানব নক্ষত্র আছে। এই নীহারিকার উজ্জ্বল কেন্দ্রীয় অঞ্চল চারটি বিশাল, তরুণ নক্ষত্রের আবাসস্থল যা নীহারিকাকে এই আকৃতি দিয়েছে। নীহারিকাটির উজ্জ্বল কেন্দ্রীয় অংশকে ” হুইজেনিয়ান অঞ্চল” বলা হয় যা ১৭শ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেনসের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
যেমন থিটা অরিয়নস এটি একটি মাল্টিপল নক্ষত্র যাকে ট্রাপিজম (Trapezium) বলা হয় কারণ তারা একটি ট্র্যাপিজয়েডাল প্যাটার্নে সাজানো হয়েছে।
এই নক্ষত্রদের আলোতে নীহারিকাটি আলোকিত হয়। এই নক্ষত্র থেকে নির্গত অতিবেগুনী আলো নীহারিকাতে একটি খাদ তৈরি করছে, ট্র্যাপিজিয়াম দ্বারা খোদাই করা বৃহৎ এই খাদটি পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে। যা পর্যবেক্ষকদের নীহারিকাটির গভীরে তাকাতে দেয় যাতে তারা ভিতরে তারা গঠনের সমৃদ্ধ ট্যাপেস্ট্রি দেখতে পারে।
ট্র্যাপিজিয়ামের বৃহদাকার, তরুণ নক্ষত্র থেকে তীব্র অতিবেগুনি রশ্মি নীহারিকা মধ্যে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মতো গ্যাসকে উত্তেজিত করে।
ট্র্যাপিজিয়াম নক্ষত্রের কাছাকাছি অবস্থিত নক্ষত্রগুলি এখনও যথেষ্ট অল্প বয়স্ক এবং তাদের ঘিরে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক রয়েছে। এই ডিস্কগুলিকে “প্রোপ্লাইডস” বলা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলটিকে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির ওরিয়ন নেবুলা বলে অভিহিত করেন। এম-৪৩ এর পাশে রয়েছে ঘন, গাঢ় ধুলো এবং গ্যাসের স্তম্ভ যা ট্র্যাপিজিয়ামের দিকে নির্দেশ করে। এই স্তম্ভগুলি ট্র্যাপিজিয়ামের তীব্র অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ক্ষয় প্রতিরোধ করছে।
নীচে ক্ষীণ লাল নক্ষত্রগুলি হল অগণিত বাদামী বামন। বাদামী বামনগুলি শীতল বস্তু যা সাধারণ নক্ষত্র হতে খুব ছোট। কারণ তারা আমাদের সূর্যের মতো করে তাদের কোরে পারমাণবিক সংমিশ্রণ বজায় রাখতে পারে না।
এই নীহারিকাটির মধ্যে পদার্থ প্রতি সেকেন্ডে ১৫ মাইল বেগে আলোড়িত হয়। এই জাতীয় নীহারিকার মধ্যে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। M42 নীহারিকার মধ্যে জ্যোতির্বিদরা নক্ষত্র সৃষ্টির প্রমাণও পেয়েছেন। তাই এই নীহারিকাটিকে নক্ষত্রদের আতুঁরঘর বলে (Star birth place)।
ওরিয়ন নীহারিকা খুঁজে পেতে, আপনাকে প্রথমে ওরিয়ন বা কালপুরুষ নক্ষত্র মন্ডলটি খুঁজে বের করতে হবে। তারপর ওরিয়নের বেল্ট খুঁজে বের করতে হবে।
ওরিয়নের বেল্টের নীচে, তিনটি ম্লান নক্ষত্র রয়েছে যা ওরিয়নের তরবারি তৈরি করে। আর এই তলোয়ারের মাঝখানে রয়েছে ওরিয়ন নেবুলা। যখন আপনি এর দিকে তাকান, আপনি একটি নক্ষত্রের নার্সারির দিকে তাকাচ্ছেন, এটা এমন একটি জায়গা যেখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। এই নীহারিকাটি রাতের আকাশে সবচেয়ে সুন্দর ফটোগ্রাফি বস্তু।
জানুয়ারী মাসে এই নক্ষত্র মন্ডলটিকে সব থেকে ভালো পর্যবেক্ষণ করা যায়।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply