বড় ছুটিতে ছিলাম। ভাবলাম রকমারি থেকে কয়েকটা বই কিনি। যেই ভাবনা সেই কাজ! তিনটে বই অর্ডার দিলাম। তার মধ্যে একটি হলো প্রাণের বিজ্ঞান: সাম্প্রতিক জীববিজ্ঞানের ভাবনা ভাষান্তর। বইটা আসলেই অসাধারণ! শুধু অসাধারণ বললেই তো আর হবে না, কিছু আকর্ষণীয় বিষয়ও তুলে ধরা উচিৎ।
বইটি মূলত সমকলীন প্রাণবিজ্ঞান বিষয়ক একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের অনুবাদ-সংকলন। গ্রন্থটির সম্পাদক ও অনুবাদক আরাফাত রহমান অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, গবেষক এবং একনিষ্ঠ বিজ্ঞানকর্মী। নির্বাচিত লেখাগুলো চিন্তার দিক দিয়ে গুরুভার হলেও বোধগম্য ও সুখপাঠ্য, অনুবাদও প্রাঞ্জল। এমন কৌতূহল জাগানো প্রবন্ধের সাথে পরিচয় একদিকে ভবিষ্যতের গবেষক-উদ্ভাবকদের অনুপ্রাণিত করে, সাথে আর সব পাঠকেরও মনের খোরাক মেটাবে বলে আমি মনে করি।
বিষয়বস্তু ও পাঠ-প্রতিক্রিয়া
বইয়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অপেক্ষাকৃ্ত ছোট হওয়ায় বইটা হাতে নিয়ে পড়তে লেগে গেলাম। প্রথমেই পেলাম স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি যৌক্তিক নিবন্ধ। ঐ নিবন্ধে একদিকে যেমন যুক্তি-উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তবমুখী যুক্তি-উদাহরণের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। এরপর বুঝলাম যে স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের মাঝে একটা প্যাঁচ আছে। আর এই প্যাঁচের লাস্ট রেজাল্ট হলো কাকতালীয়ভাবে স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখে ফেলা।
সত্যিই বিষ্ময়কর! এরপরে এলো বায়োকেমিস্ট্রির বিরাট আলোচনা। লেখাটা অনেক মজার ছিল। আমি জীববিজ্ঞানের পুত্র আর রসায়নের ভক্ত। তাই 18 পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি পড়তে একটুও বিরক্ত লাগে নি। আশা করি আমার মত অন্য পাঠক বন্ধুদেরও ভাল লাগবে কারণ এখানে জীববিজ্ঞান ও রসায়নের বেশকিছু বিশ্লেষণমূলক আকর্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো প্রাণের অস্তিত্ব ও জীবের জীবনের সাথে সম্পর্কিত।
এরপরের বিষয়টি পরে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। বাস্তুসংস্থানের নেতিবাচক কৃত্রিম পরিবর্তনের প্রভাবে একটি ভাইরাস মালয়েশিয়ার মিলিয়ন মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতি করে ফেলল। অনেকটা contagion সিনেমার MEV-1 নামক জীবাণুর মত নিপাহ ভাইরাস মালয়েশিয়াকে গ্রাস করেছিল। ভাইরাস মশাইয়ের ব্যাখ্যা পড়তে পড়তে ব্যাকটেরিয়ায় চলে এলুম। আপনি কি জানেন, ব্যাকটেরিয়া মাঝে মধ্যে নিরীহ থেকে বিধ্বংসী হয়ে যেতে পারে? আমি জানতাম না, কিন্তু “কাকতালীয় ঘাতক” নামক প্রবন্ধটি পড়ার পরে জানতে পারি।
আচ্ছা, আমরা তো এমন একটা যুগে বাস করছি, যে যুগে crispr cas9 প্রযুক্তির মাধ্যমে জিনোম এডিট করা যায়। তাহলে কি এখন জিনোম থেকে রোগ-ব্যাধির সংকেত মুছে ফেলা যাবে? উত্তর জানতে হলে চলে যেতে হবে বইটির ৬৬নং পৃষ্টায়। এই প্রবন্ধে জেনেটিক্স সম্পর্কে বেশ কয়েকটি নতুন বিষয় হলো, যদি জিনোম এডিটিংকে আরো বহুদূর নিয়ে যাওয়া যায়,তাহলে জিনোম অনেকটা প্রোগ্রামিং-এ রূপান্তরিত হতে পারে; মানে জিনোমকে এবং জিনোমের মাধ্যমে মানবদেহকে বদলে দেওয়া যেতে পারে। আর এটাই হবে শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার।
বইয়ের পরবর্তী অংশগুলো পড়ে ধাপে ধাপে জীববিজ্ঞানের মধ্যে বিশেষ গাণিতিক সমীকরণ এবং গণিতের সূত্র দিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানতে পারলাম। আসলে বিজ্ঞান যে কতটা বিচিত্র এবং বিস্তৃত, তা বলে বোঝানো যাবে না। এরপর এলো কিছু অদ্ভুত উক্তি ও ঘটনা। যেমনঃ
১. জ্যারেড ডায়মন্ডের মতে, কৃ্ষিকাজের সূচনাই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল।
২. আগামী শতাব্দীই হবে মানবসভ্যতার সমাপ্তি লগ্ন।
৩. প্রকৃতিতে কিছু পোষক জীব পরজীবীর দাস হিসেবে কাজ করে।
৪. যদি কখনো জীবাশ্ম জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন সভ্যতার বিনির্মাণ যেমন হতে পারে।
৫. সারা বিশ্বের জিনোম তথ্য দিয়ে যা কিছু করা যেতে পারে।
এই পাঁচটি বিষয় পড়তে পড়োতে আপনি নিজেকে কল্পনার রাজ্যে আবিষ্কার করবেন, যদিও সেগুলো যৌক্তিক!
এখন বলি, পুরো বইটা পড়ার পরে আমার প্রতিক্রিয়া কেমন হলো! সাধারণত বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ার পরে হয় জ্ঞান সঞ্চয় হয়, আর না হয় জ্ঞানার্জনে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে আমি বইটি পড়ার পরে দু’টিকেই আলিঙ্গন করেছি। genetics, Microbiology এবং Environmental Science ছিল আমার অর্জিত জ্ঞানের শাখা। আর যে বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম, তা হলো Climate Change. সবশেষে যে কথাটি বলতে হয়, তা হলো বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং লেখকদের জন্য এই বইটি অন্যতম উৎকৃ্ষ্ট বন্ধু।
জাননাম-শিখলাম
বইটির আদ্যোপান্ত সবকিছুই অনেক ভালো লেগেছে। তারপরও কিছু কথা উল্লেখ না করলেই নয়ঃ
১. বাস্তুসংস্থানে যখনই আমরা গায়ের জোর প্রয়োগ করতে চাইবো, তখন খেয়াল রাখা দরকার যে সেতা উল্টো কামড়ও দিতে পারে
২. সাধারণ অণুজীবেরা বিবর্তনের ধারায় মানবঘাতী জীবাণু হয়ে উঠতে পারে
৩. রোগ হলো পোষক ও পরজীবীর মধ্যকার সম্পর্কের আদিম দশা
৪. জিনোম এডিটিং এর ক্ষমতাটি হলো এর মাধ্যমে খুব দ্রুত জীবের DNAতে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আনা যায়
৫. আপনি নিজের সম্পর্কে আরো অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবেন যদি নিজের স্বপ্নের মাধ্যমে নিজেকে বুঝতে পারেন
৬. প্রাণ হলো সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বে শক্তির নিরবচ্ছিন্ন ধারার একটি অংশমাত্র
বইটি যে যে ভাবনার জন্ম দেয়ঃ
১. ভবিষ্যতের পৃথিবী যেমন হতে পারে
২. গণিত ও রসায়নকে যেভাবে জীববিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ও প্রত্যক্ষ ঘটনায় কাজে লাগানো বা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে
৩. জিনোম এডিটিং এর মাধ্যমে আমরা যা যা করতে পারি
৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও তার বিধ্বংসী প্রভাব
৫. মানবসভ্যতার উদ্ভব, জীবনধারা ও সমাপ্তি
বইটির মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়েছিঃ
১. কীভাবে পরিবেশের পরিবর্তন জীবাণুর সংক্রমণের উৎপত্তি ঘটায়?
২. কিছু মানুষ কেন মাঝেমধ্যে কাককাতালীয়ভাবে ভবিষ্যতকে স্বপ্নে দেখে?
৩. অণুজীবের ক্ষমতা কতটুকু হতে পারে?
৪. কীভাবে গণিত ও রসায়ন প্রাণের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে?
৫. জিনোম এডিটিং কতদূর এগিয়েছে?
তো, সবশেষে একটা কথাই বলব, বইটা আসলে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের সমাহার। আমি যেকোনো বুক রিভিউতে বইয়ের কিছু ত্রুটি বা সমালোচনা ভিত্তিক কথা তুলে ধরি। কিন্তু এই বইয়ের ব্যাপারে এমন কিছুই বলব না। তো, দেরি কীসের? বইটি সংগ্রহ করে পড়া শুরু করুন। একজন পাঠক হিসেবে আমার মতো আপনিও বইটি পড়ে উপকৃ্ত হবেন! Happy Reading!
Leave a Reply