নীলুদের খেলার জায়গাটা নির্দিষ্ট। বাড়ি থেকে দূরের যে জঙ্গল আছে তার মাঝখানে মাঠটা। পাশে একটা ভাঙাচোড়া পোড়া জমিদার বাড়ি। এই বাড়ি আর জঙ্গল নিয়ে এলাকায় নানা ভয়ানক গল্প প্রচলিত থাকলেও সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই নীলুদের। বলা যায় দুঃসাহসী একদল বালক এরা। স্কুল ছুটি হলেই বিকালে এই মাঠে ক্রিকেট খেলা ওদের রীতিমত ডাল ভাতের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীলু, ইকু, সাকিব, মুরাদ, মেহেদী ও মারুফ। ছয় বন্ধুর একটা দল। কিছুটা গোয়েন্দা টাইপের। বিকেলবেলা শুরু হল খেলা। নীলু ব্যাটিং করছিল। ইকুর বলিংয়ের হাত ভাল হলেও নীলুকে কাবু করা চাট্টিখানি কথা নয়। একে একে নীলু দুই-চার পিটিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে সে মারলো এক ছক্কা। কিন্তু বিপত্তি এখানেই ঘটে গেল। বলটা মাঠ ছেড়ে সোজা পোড়া বাড়িতে ঢুকে গেল। সবাই তো ভয়ে চুপ! কারণ, এই বল এখন কে আনবে? আর বল ছাড়া ওদের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে।
মারুফ একটু ভিতু টাইপ ছেলে। ও বললো, ‘এখন কী হবে রে নীলু? তুই একি করলি!’
‘আরে চুপ, যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। এখন কথা হল, বলটা কে আনতে যাবে?’ মারুফকে ধমক দিয়ে ইকু সবার দিকে তাকালো।
সাকিব বললো, ‘কেন কেন? যে বল মেরেছে সেই গিয়ে আনবে।’ নীলু বললো, ‘ঠিক আছে আমি যাব বল আনতে। তোরা খুশি তো?’ সবাই সবার দিকে তাকানো শুরু করলো।
কিন্তু মেহেদী সবার থেকে একটু আলাদা। ও বললো, ‘না, এই ভুল করা যাবে না। নীলু হোক আর যেই হোক, একা একা ওখানে এই শেষবেলা যাওয়া ঠিক হবে না। চলো সবাই একসাথে যাই। আর দেখি আসলে কি রকম দেখতে পোড়া বাড়ির ভেতরটা।’
সবাই একসাথে হাঁটা শুরু করলো। দোতলা বাড়িটার ইট ও পলেস্তারা সব খসে খসে পড়ছে। বাড়ির সামনে একটা বড় জলাশয়, হাজার বছরের পরিত্যক্ত এই জলাশয়। প্রচুর লাল, নীল ও গোলাপী পদ্ম ফুলে জলাশয়টা পূর্ণ। শান বাঁধানো ঘাট। চারপাশে প্রচুর ঘাস ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ। দেয়ালের যেখানে সেখানে ফাটল ধরে গেছে। রুমগুলো ময়লা-আর্বজনায় পূর্ণ। কতকাল না জানি এখানে মানুষের পা পড়েনি। দরজা ও জানালাগুলো ভাঙ্গা ও মরিচা ধরা। গোটা পোড়া বাড়ির অন্ধকারের ভেতর কেমন যেন একটা ভয়ের হীম অনুভূতি বয়ে গেলো ছয় কিশোরের মনে। প্রতিটি দরজার সামনে একটি করে নারীমূর্তি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে ওরা রুমগুলো দেখতে লাগল। প্রায় দু’ঘন্টা খোঁজাখুজি করেও বলটা পেল না। হঠাৎ নীলু হকচকিয়ে গেল। কারণ, উপর তলায় একটা বুড়ো বয়সি মানুষ। লোকটা ভয়ানক দৃষ্টিতে নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ানক দু’টো লাল চোখ। মনে হয় কোনো অশরীরী।
লোকটা রেগে বললো, ‘এই ছোকরার দল, এখানে কী চাই?’ সবাই ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। মেহেদী সাহস করে বললো, ‘কাকু, আমরা মাঠে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই আমাদের বলটা…।’
-‘থাক থাক, আর বলতে হবে না। এই নাও বল। ভুল করেও আর এখানে এসো না। দূর হও।’ লোকটা অবাক করে দিয়ে ওদের বলটা ফেরত দিল। এদিকে চারপাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে। সবাই একসাথে হাঁটা শুরু করলো, ভয়ে একবারও পিছনে তাকালো না। লোকটা বিশ্রী করে কী যেন বলছিল। নীলুরা সেটা বুঝতে পারল না।
ছোট চাচা রাশিয়া থেকে আসছেন। দু’মাস বাংলাদেশে থাকবেন। তিনি RASA এর একজন কর্মকর্তা। মহাকাশ নিয়ে আর ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে রাশিয়া সরকার। আর চাচা এই প্রজেক্ট এর দায়িত্বে আছেন। ছোট চাচা আসবে এই নিয়ে নীলুর আনন্দের শেষ নেই। অবশেষে চাচা ঢাকায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে ফোন দিলেন বাসায়। ফোনটা নীলু রিসিভ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা থেকে বাড়ি আসবেন চাচা। দাদু অনেক খুশি।
-‘যাক বাবা, শাহরিয়ার তাহলে আসছে। কতদিন দেখিনি ছেলেটাকে।’ দাদুর চোখগুলো ভিজে উঠলো। খবরটা ছড়িয়ে পড়লো বাকি পাঁচজনের কানে। কারণ নীলুরা চাচাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর চাচাও দেশে আসলে ওদের নানা রকম বৈজ্ঞানিক কল্পকথা শোনাতেন। সেবার রাশিয়া চলে যাওয়ায় তারা এতদিন চাচাকে খুব মিস করেছে।
যদিও চাচা অবশ্য ফোনে ওদের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতেন। চাচা বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। নীলুর মা রান্নাঘড়ে ভীষণ ব্যস্ত। কাজের বোয়া রহিমার মা নীলুর মাকে সাহায্য করছে। আজ বাসায় বিভিন্ন পদের রান্না হচ্ছে। সব বাঙালি খাবার। আসলে ছোট চাচা রাশিয়াতে সেভাবে দেশি খাবার খেতে পারেন না। চাচা এসে গোসল করে ফ্রেশ হলেন। নীলু সরাক্ষণ চাচার সাথে সাথে। রাশিয়া থেকে চাচা অনেক কিছু এনেছেন। একে একে সবাই যার যার উপহার নিলো। এবার নীলুর পালা। কী আছে প্যাকেটগুলোর ভিতর। ছোট চাচা প্রথমেই নীল প্যাকেটটা খুললেন। কালো রঙের একটা যন্ত্র।
চাচা বললেন, ‘শোন নীলু, এটা হলো ড্রোন-ক্যামেরা। এটা প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা উড়ে গিয়ে নিখুঁত ভিডিও এবং ছবি তুলতে পারে। আর এটা রিমোট-কন্ট্রোলার সিস্টেম। ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর চাচা বড় লাল প্যাকেট থেকে একটা এইচপি ব্রান্ডের ল্যাপটপ বের করলেন। সর্বশেষ প্যাকেটটা হলো, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি-র যন্ত্র। হেড ডিসেপ্ল, গ্লাভস ও বডি সুট।
আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। তাই নীলুরা সকাল থেকেই খেলা শুরু করলো। আজ তারা একা নয়। ছোট চাচাও ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ওরা চাচাকে সেদিনের সব কথা খুলে বললো। এমনকি ঐ রহস্য বুড়োর কথাও। ছোট চাচার মনে কথাটা শুনে যেন একটা খটকা লাগল। আসলেই কি পোড়া বাড়ির বুড়োটা মানুষ নাকি অশীরিরী কোন আত্মা? যদিও চাচা এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেন না। তারপরও প্যারানরমাল সাইকোলজি নিয়ে তিনি অনেক বই পড়েছেন দেশে ও বিদেশে। তাই এতটুকু আশঙ্কা করা অবান্তর নয়। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। নীলু ব্যাপারটা খেয়াল করলো। সে চাচাকে বললো-
‘কী ভাবছো ছোট চাচ্চু? কোন সমস্যা?’ চাচ্চু বললো, ‘নারে নীলু। আচ্ছা, তোরা কি আমাকে নিয়ে যাবি ঐ পোড়া বাড়িতে? আমি ওই বুড়ো লোকটার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘ওরে বাবা, তুমি কি বলছো ছোট চাচ্চু! কে যাবে ওই ভয়ানক বাড়িতে! শেষমেষ প্রাণটাও চলে যাক!’ নীলু প্রায় আতঙ্কমাখা চোখে কথাগুলো বললো।
চাচ্চু বললো, ‘শোন নীলু, পৃথিবীতে ভয় বলে কোন শব্দ নেই। আর অনেক দিনের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে একটা বুড়ো লোকের উপস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই ভয় পেলে আমরা সত্যটা উদঘাটন করতে পারবো না। যা হোক, আমি তাহলে একাই যাবো সেখানে। তোরা কেউ যাবি আমার সাথে?’ চাচ্চু সবাইকে ডাকলেন।
সবাই রাজি হলো। অবশেষে ভরদুপুরেই তারা রওয়ানা দিল জঙ্গলের ভিতর। তারা হাঁটছে আর চারপাশে তাকাচ্ছে। একটা বুনো শেয়াল ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। শেয়ালটার লাল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। চাচা ড্রোন-ক্যামেরাটা ছেড়ে দিলেন। রিমোট-কন্ট্রোলার দিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রন করে তিনি সামনে এগুতে লাগলেন। সবাই চাচার কাজ দেখে অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। চাচা ওদের মুচকি হেসে আশ্বস্ত করলেন।
জমিদার বাড়ির দরজার সামনে এসে চাচা সবাইকে বললেন, ‘শোন, তোমরা কেউ কোন কথা বলবে না। আর হাসাহাসি তো একদম না। আমি যা বলার বলবো। দেখি ওই বুড়োর মতলবটা কী?’
সবাই জমিদার বাড়িতে ঢুকলো। চাচা তো অবাক। এতবড় বাড়ি। চারপাশের জঙ্গলের জন্য সেটা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। চাচ্চু বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা বলতে পারবি এটা কোন জমিদার বানিয়েছে? জমিদারটার নাম কি?’ ইকু চট করে বলে ফেললো, ‘জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ। সম্ভবতঃ আজ থেকে আটশ বছর আগে।’
চাচা চোখ বড় বড় করে বলে ফেললেন, ‘কি, আটশ বছর! তাও বাড়িটা প্রায় অক্ষত?’ নীলু বললো, ‘হয়ত নির্মাণ কৌশল অনেক শক্তিশালী ছিল। তাছাড়া শুনেছি এই জমিদার নাকি অনেক প্রতাপশালী ছিলেন।’
হঠাৎ ‘ও মাগো…’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কী হয়েছে বলতেই বললো, ‘দেখ আমি একটা ব্যাঙের উপর পা দিয়ে ফেলেছি!’ আসলে মুরাদ এমন একটা ছেলে যে কিনা তেলাপোকা দেখলেও ভয় পায়। সবাই একসাথে হাসা শুরু করলো। এতে মুরাদ খুব লজ্জা পেল।
বারান্দায় আসতেই তারা দেখল বুড়োটা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে। চাচ্চু বুড়োটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। বুড়ো চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী চাই আবার। কোন সমস্যা?’ এই প্রথম বুড়ো হাসিমুখে কথা বললেন।
চাচ্চু বললেন, ‘কিছু নয় কাকু। আমরা শুধু জমিদার বাড়িটা দেখতে এসেছি।’
বুড়ো তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘তাই নাকি? তা কেমন দেখলে?’
চাচ্চু বললো, ‘খুব ভাল।’ কাকু যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা বলতে চাই। বলবো নাকি?’
বুড়ো হেসে বললো, ‘অবশ্যই। কী জানতে চাও?’
চাচ্চু বললেন, ‘আপনি কি এখানে একা থাকেন? মানে, এই পুরনো জমিদার বাড়িতে আপনার একা থাকতে ভয় করে না বুঝি!’ -বুড়ো হেসে উঠল। হাসিতে এতটাই রহস্য ছিল যেন তিনি অন্য জগতের কেউ।
বুড়ো বললো, ‘ভয়! কিসের ভয়, কার জন্যে ভয়? তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে কে আর আসবে আমার ক্ষতি করতে। লোকের খেয়ে দেয়ে বুঝি কাজ নেই! যাক সে কথা। তোমরা একটা কাজ কর। এসো, আমার গরিবের ঘরে। আর শোনো, আমার মতো এক অভাগার গল্প।’
আসলে তারা লোকটাকে যত খারাপ ভেবেছে আসলে লোকটা তত খারাপ নয়। হয়ত তাদের কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সবাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো।
ছোট্ট একটা ঘর। সম্ভবত এই ঘরটা প্রাসাদের অন্য ঘরগুলো থেকে অক্ষত। একটা খাটে বিছানা পাতা, একটা টেবিল ও পুরনো দিনের কিছু ফার্নিচারে ঘরটা ভর্তি। কিছু নকশা করা টবে ফুল ও মোমবাতির আলোতে ঘরটা আরো ভৌতিক মনে হচ্ছে। সবাইকে বুড়ো বসতে বললেন। সবাই বসলো। এবার বুড়ো শুরু করলেন তার কাহিনী। সবাই মনেযোগ সহকারে শুনতে শুরু করলো। বুড়ো বলতে লাগলেন, ‘আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। আমি তখন তাগড়া জোয়ান। সবেমাত্র বিয়ে করেছি। আর্মি তে থাকতাম। হঠাৎ ১৯৭১ সালে শুরু হল যুদ্ধ। গোটা দেশ কান্না-হাহাকারে ভরে গেল। চারদিকে লম্পট পাকসেনাদের ধ্বংসলীলা বিশ্ববিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। বাঙালি জাতির রক্তে লাল হয়ে গেল বাংলার মাটি। ২৫শে মার্চের কালো রাত। বাবা ও তিন ভাইকে পাকসেনারা গুলি করে মারলো। মা ও সালেহা, মানে তোমাদের চাচিমাকে ওরা ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমি তখন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীতে ছিলাম। খবর পেলাম জয়নাল মারফত। কান্নায় পাগলের মতো হয়ে গেলাম। অবশেষে নয়টি মাস যুদ্ধ করার পর দেশ স্বাধীন হলো। আর আমি একা হয়ে গেলাম। স্বজন হারানোর কষ্ট আর সালেহার স্মৃতি নিয়ে এই রাজবাড়িতে আশ্রয় নিলাম। এখানেই কাটল দীর্ঘ চল্লিশটা বছর।’
চাচ্চু বললো, ‘আপনার একা থাকতে খারাপ লাগে না?’
বুড়ো বললো, ‘তা তো লাগে। কিন্তু কী করবো? সারাদিন ইবাদত-বন্দেগি আর রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সপ্তাহে একদিন লোকালয়ে যাই। মানুষদের সাথে কথা বলি ও বাজার করে হালকা হই। যাক বাবারা, তোমরা কিন্তু দুপুরে খেয়ে যেও এই গরিবের বাড়িতে। না হলে আমি রাগ করবে।’
চাচ্চু বললেন, ‘কী রেঁধেছেন কাকু?’
বুড়ো বললো, ‘এই তো, বনমোরগের ভুনা আর কুঁচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক।’ বন মোরগের ভুনার কথা শুনে নীলুর জিভে পানি এসে গেল।
বুড়ো বলতে লাগলেন, ‘সালেহা খুব সুন্দর করে কুঁচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক রাঁধতো। আহা! কী স্বাদ ঐ রান্নার, না জানি ওরা কী বেঁচে আছে? মা ও সালেহা যদি বেঁচে থাকে তবে তারা কোথায়?’ বুড়ো দাদু চোখ মুছে আবার বললেন, ‘যাক সে কথা তোমরা খাওয়া শুরু কর তো বাবারা।’
নীলু বললো, ‘আপনি খাবেন না কাকু?’
-‘হ্যাঁ খাচ্ছি। আচ্ছা, তরকারি বুঝি স্বাদ হয়নি?’
চাচ্চু হেসে বললেন, ‘কি বলেন কাকু! অসাধারণ স্বাদ। খাঁটি বাঙালি রান্না।’
একজন আর্মি অফিসারকে অশরীরী ভেবে সবাই খুব লজ্জা পেল। আসলে একটা মানুষকে কাছ থেকে না দেখলে মনে হয় না সে আসলে কী। চাচ্চু নিজের পরিচয় দিলেন। বুড়ো দাদু পরিচয় শুনে অবাক। কারণ তিনিও ভিনগ্রহ নিয়ে অনেক কিছু জানেন। শুধু তাই নয়, এই রাজবাড়িতে তিনি ফ্লাইং সসারের মতো কিছু উড়তে দেখেন প্রায় মধ্যরাতে। চাচ্চুকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন দাদু। আর মধ্যরাতে ফ্লাইং সসারের মতো কিছু জমিদার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যায়। এটা সবার জন্য একটা মোক্ষম সুযোগ। বিশেষ করে চাচ্চুর। চাচ্চু ড্রোন-ক্যামেরাটা নিয়ন্ত্রণে এনে সেটাকে তার ব্যাগে পুরলেন। সবাই দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিল। একজন আর্মি অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধার এই অবস্থা দেখে সবাই খুব কষ্ট পেল।
মুরাদ চাচ্চুকে বললো, ‘আচ্ছা চাচ্চু, ড্রোন-ক্যামেরা থেকে আমরা কী তথ্য পাবো?’
চাচ্চু বললেন, ‘রাতে সবাই এসো আমার রুমে। ভিডিও ফুটেজ চেক করবো। আর তবেই বুঝা যাবে আসলে কী নতুন তথ্য আছে আমাদের জন্য।’
ইকু, মুরাদ, মারুফ, সাকিব সবাই ঘাটে এসে বিদায় নিলো। আর নীলু, মেহেদী ও চাচ্চু সোজা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো।
রাত আটটা। সবাই চাচ্চুর ঘরে জমায়েত হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, পোড়া বাড়িতে মধ্যরাতে কী ঘটে? চাচ্চু ল্যাপটপ অন করলেন। ক্যামেরার ডাটা ক্যাবল কম্পিউটারে লাগালেন। ডাটা ইনপুট হলে ডেস্কটপে সেটা কপি করলেন। সবাই আগ্রহ সহকারে দেখেছে আর পরস্পর একে অন্যকে দেখছে কী ঘটতে যাচ্ছে?
চাচ্চুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভিডিও প্লে করা হলো। ভিডিওতে দেখা গেল রাজবাড়ির তোরণ, জলাশয় আর ছাদের উপর কিছু কবুতর ও একটা বিড়াল। রাজবাড়ির ঠিক পেছনে একটা পুকুর আর পাশে খোলা মাঠ। মাঠের ঠিক মাঝখানে গভীর একটা গর্ত। মনে হচ্ছে ভারি কোন বড় জিনিসের চাপে গর্তটা সৃষ্টি হয়েছে।
চাচ্চু বললো, ‘মনে হচ্ছে কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে। তোমরা কি বলো?’
সবাই বলে উঠল, ‘এটা কোন ভিন্নগ্রহের প্রাণীদের দ্বারা সৃষ্টি নয়তো? চাচ্চু তুমি কী বলো?’ সবাই গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কাজের মেয়ে রহিমা সবার জন্য পিঠা আর চা নিয়ে আসলো। খেতে খেতে চাচ্চু বললেন, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমাদের উচিত জায়গাটা পরিদর্শন করা। তাই নয় কি?’
-‘হ্যাঁ তাই।’ সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
চাচ্চু বললেন, ‘আর শোন, ঐ বুড়ো আর্মি অফিসারকে আমাদের প্রয়োজন হতে পারে। আর আমি RASA এর ওয়েবসাইটে ভিডিওটি আপলোড করে দিচ্ছি।’
চাচ্চু গুগলে গিয়ে সার্চ দিচ্ছেন আর একটা করে তথ্য খাতায় লিখছেন। আসলে গত আঠারো শতক প্রর্যন্ত এলিয়েনদের নিয়ে নানা গুজব থাকলেও উনিশ শতকে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করছেন। বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পানির অস্তিত্ব এটাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। NASA, RASA সহ বিভিন্ন মহাকাশ গবেষনা সংস্থা বিভিন্ন সময় মহাকাশে রকেট পাঠাচ্ছে। বেড়িয়ে আসছে সব নতুন নতুন তথ্য।
চাচ্চু স্কাইপি-তে রাশিয়ায় ড. রুস্তম ভাগিরভ এর সাথে কথা বললেন। রাশিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী, যিনি পৃথিবী থেকে ২০,০০, ০০০ আলোকবর্ষ দূরে কোয়াসার গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। টেলিস্কপে কিছু উড়ন্ত পিরিচের মত কিছু পৃথিবীর দিকে আসতে দেখেছেন। ড. ভাগিরভ ভিডিওটি দেখে ধরে নিলেন এই গর্ত আসলে কোয়াসার গ্রহেরই কোন যানের দ্বারা সৃষ্টি। তার মানে, জমিদারবাড়িতে ভিনগ্রহের প্রাণীরা আসে। হয়তবা তারা মানুষের থেকে অনেক বুদ্ধিমান আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে বহুদূর। নীলুরা খুশিতে উত্তেজিত। আবিস্কারের নেশা তাদের মনে দোলা দিচ্ছে। নীলু এতদিন শুধু বইয়ে এসব কল্প-বিজ্ঞানের কাহিনী পড়েছে কিংবা চাচ্চুর কাছে শুনেছো সবাই বিদায় নিয়ে যে যার মত বাড়ি চলে গেল। (চলবে)
আগামী মাসে সমাপ্য
Leave a Reply