ইটা কারিনা। দাপ্তরিকভাবে ইটা আর্গাস নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হলো ইটা রোবরিস, বা ইটা নাভিস।
ইটা কারিনা হলো কারিনা নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত অন্তত দুইটি নক্ষত্র নিয়ে গঠিত একটি নাক্ষত্রিক ব্যবস্থা। এর একটি ইটা কারিনা-A, অন্যটি ইটা কারিনা-B। এই উভয় নক্ষত্রই বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করছে।
এই নক্ষত্রমণ্ডলের আলো আমাদের সূর্যের চেয়ে বেশি। ইটা কারিনা-A আমাদের সূর্যের চেয়ে ৫ মিলিয়ন গুন বেশী উজ্জ্বল এবং কারিনা-B ১ মিলিয়ন গুন বেশী উজ্জ্বল। ইটা কারিনা-A এবং ইটা কারিনা-B প্রতি ৫.৫৪ বছরে একবার একে অপরের চারপাশে একটি কক্ষপথ সম্পূর্ণ করে।

এই নক্ষত্র ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্ফোরণের একটি বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে। যা এটিকে কয়েকবার উজ্জ্বল নক্ষত্র তালিকায় স্থান করে দিয়েছিলো। উভয় নক্ষত্রের বয়স প্রায় ৩ মিলিয়ন বছর বলে মনে হচ্ছে। দুটি নক্ষত্র মোটামুটি একই সময়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই নক্ষত্র ব্যবস্থার অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে।

আমাদের ছায়াপথে এখন পর্যন্ত যত নক্ষত্র আবিস্কার হয়েছে, ইটা কারিনা এদের মধ্যে সবথেকে অদ্ভুত। এই নক্ষত্রটির অস্বাভাবিক আচরণের জন্য পেশাদার এবং সৌখিন সব জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এই নক্ষত্রটি চরম কৌতুহলের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নক্ষত্রটি জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম রহস্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি এখন পর্যন্ত অধ্যয়ন করা অনন্য নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি।
ইটা কারিনা হলো লুমিনুস ব্লু ভ্যারিয়েবল স্টার (সংক্ষেপে এলবিভি)। এটি এই শ্রেণীবিভাগের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইটা কারিনা-B একটি তরুণ O-টাইপ নক্ষত্র বলে মনে করা হয়। আবার কেউ কেউ এটিকে একটি বিবর্তিত সুপারজায়ান্ট নক্ষত্র বলে মনে করেন। ইটা কারিনা হল একমাত্র পরিচিত নক্ষত্র যা অতিবেগুনী লেজার নির্গমন করে।

ধারণা করা হয় ইটা কারিনা আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি বড়। শুরুতে এর ভর ছিল সূর্যের ১৫০ গুণ, উপরিতলের তাপমাত্রা ১৫০০০ কেলভিন। এটি আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি বিকিরণ করে।
ইটা কারিনা নক্ষত্র সিস্টেমটি সূর্য থেকে প্রায় ৭.৫০০ আলোকবর্ষ (২.৩০০ পারসেক) দূরে অবস্থিত। ইটা কারিনা একটি শক্তিশালী এক্স-রে এবং গামা-রে উৎস। শনাক্ত করা সর্বোচ্চ শক্তির গামা-রশ্মি 100 MeV-এর উপরে। উভয় তারাই বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করছে।

সতেরশ-শতকের আগে ইটা কারিনা পরিচিত ছিল না। ইটা কারিনার প্রাচীনতম রেকর্ডগুলির মধ্যে একটি হলো ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এডমন্ড হ্যালি প্রথম এই নক্ষত্রটিকে তালিকাভুক্ত করেন। ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে এটি চতুর্থ মাত্রা উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল।
তারপর এটি আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের এর উজ্জ্বলতা আবার পুনরায় বৃদ্ধি পায়। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে জন হার্শেল জানান যে, এই নক্ষত্রটির উজ্জ্বলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উইলিয়াম হার্শেলের এই পর্যবেক্ষণ যথার্থই ছিল।
১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের এর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে প্রথম মাত্রায় পৌছায়। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে এর উজ্জ্বলতা -০.৮ মাত্রায় পৌঁছায়। ধারণা করা হয় এই সময় নক্ষত্রটি বিস্ফোরণ হয়েছিল। এই বিস্ফোরণকে “গ্রেট ইরাপশন” বলা হয়।
অল্প সময়ের জন্য এটিকে রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছিলো যা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মতো প্রায় দৃশ্যমান আলো ছেড়ে দেয়। এই সময় উজ্জ্বলতার দিক থেকে এই নক্ষত্রটি সমগ্র মহাকাশে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল। ১৬৯ বছরেরও বেশি পরে, নোভার দুটি লোব এখনও মহাকাশে প্রসারিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য তখন উজ্জ্বলতার বিচারে লুব্ধক ছিল প্রথম। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে ষষ্ঠ মাত্রায় পৌঁছায়। উজ্জ্বলতার এই হ্রাস বৃদ্ধির কারণে এই নক্ষত্রটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা অব্যাহত ছিল।
আর এই গবেষণার এক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার কর্ডোভা মানমন্দিরের জ্যোতির্বিদ এনরিক গাভিওলা ঘোষণা দেন উজ্জ্বলতা পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হল গ্যাস এবং ধূলিকণার একটি ছোট নীহারিকা, যাকে বলা হয় হোমুনকুলাস নেবুলা, যা বিস্ফোরণের সময় উৎক্ষিপ্ত হয়ে নক্ষত্রের আলোকে অবরুদ্ধ করেছে। ইটা কারিনা মূলত একটি নীহারিকা পরিবেষ্টিত নক্ষত্র। এই নক্ষত্রটি ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে বিস্ফোরিত হয়েছিল। সে কারণে সে সময়ে নক্ষত্রটির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
১৮৪৩ সালের বিস্ফোরণটি বিস্তারিতভাবে দেখার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিল না। তবে এর প্রভাবগুলি আজ গবেষণা করা হচ্ছে। সেই দেড় শতাব্দী আগে হোমুনকুলাস নেবুলা নামে পরিচিত নিক্ষিপ্ত পদার্থের বিশাল মেঘ হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৯৯৪ সাল থেকে বিষদভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু হয়।

ইটা কারিনাকে ঘিরে থাকা মহাজাগতিক মেঘ এবং ধূলিকণার কারণে নামকরণ করা হয় কারিনা নীহারিকা। ১৯৯৪ সালে হাবল দূরবীনের সাহায্য নিয়ে নক্ষত্রটিকে এই পর্যবেক্ষণের ফলে যা জানা যায় তা হলো মূলত এই নক্ষত্রের বাইরের দিকে বিশালাকার ঘূর্ণায়মান মেঘের একটি আস্তরণ রয়েছে। এখান থেকে গ্যাসপুঞ্জ বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে।

প্রথম দিকে জ্যোতির্বিদরা মনে করেছিলেন এই গ্যাসীয় পিণ্ডগুলো হয়তো ফাঁপা। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেলো এগুলোর ভিতরে রয়েছে প্রচুর মহাজাগতিক ধূলিকণা। এই মেঘের রাশিকে দেখতে অনেকটা মানুষের ফুসফুসের মতো। আর এই পিণ্ড দুটি নক্ষত্রটির দুই মেরু থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উৎক্ষিপ্ত গ্যাসীয় অংশ এইভাবে পিণ্ডাকার লাভের পিছনে জ্যোতির্বিদরা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে থাকেন।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে নক্ষত্রটির প্রচণ্ড চৌম্বক ক্ষেত্র, তীব্র ঘুর্ণন গতি, এবং অন্যান্য নক্ষত্রের প্রভাব। বিস্ফোরণের পর থেকে এর বিষুবীয় অঞ্চল থেকে বস্তু সরাসরি উৎক্ষিপ্ত না হয়ে দুই মেরু থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে।
এই গ্যাসীয় পিণ্ডে ঘূর্ণায়মান কিছু পাখার মতো অংশ লক্ষ্য করা যায়। এতে তিনটি রহস্যময় ফুটকি দেখা যায়। এই ফুটকি তিনটি প্রতি ঘণ্টায় ১,০০,০০০ মাইল বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। এছাড়া এই মেঘে রয়েছে কিছু ক্ষুদ্রাকার বস্তুপুঞ্জ।
যেহেতু ইটা কারিনা ব্যবস্থার নক্ষত্রগুলি হোমুনকুলাস মেঘ দ্বারা আবৃত, তাই তাদের সঠিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা কঠিন।
এটি পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি যা তুলনামূলকভাবে নিকট ভবিষ্যতে একটি সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যখন এটি ঘটবে, তখন পৃথিবী থেকে একটি চিত্তাকর্ষক দৃশ্যে দেখা যাবে। যা এর শেষ বিস্ফোরণের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বলঃ SN-2006gy, এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে উজ্জ্বল সুপারনোভা, একই ধরণের একটি নক্ষত্র থেকে এসেছে।
ইটা কারিনা শুধুমাত্র তার অতীতের কারণেই আকর্ষণীয় নয়, তার ভবিষ্যতের কারণেও। ইটা কারিনা ক্যারিনা নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত।

ক্যারিনা আর্গো নাভিস নামে একটি বৃহত্তর নক্ষত্রমণ্ডলের অংশ ছিল। আরগো নাবিস (Argo Navis) আরগো মানে জাহাজ। ক্যারিনা শব্দটি ল্যাটিন, যার অর্থ keel of a ship। Keel মানে জাহাজের তলি যা সাগরের ঢেউয়ের হাত থেকে জাহাজকে স্থিতিশীল রাখার নিমিত্তে নির্মিত ধাতব খন্ড বিশেষ। এই নক্ষত্রমন্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্যানোপাস জাহাজের কিলকে চিহ্নিত করেছে।
অনেক বড় নক্ষত্রমন্ডল হবার কারনে এই নাম বিলুপ্ত করে পরবর্তীতে এই নক্ষত্রমন্ডলটিকে তিনটি ছোট নক্ষত্রমন্ডলে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হলো ক্যারিনা কিল, পাপিস জাহাজের পিছনের ভাগের ডেক এবং ভেলা পাল।
যেহেতু ইটা কারিনা একটি বিরল নক্ষত্র, তাই এর ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন কাজ। এর ভবিষ্যত বিবর্তন অত্যন্ত অনিশ্চিত, কিন্তু তারা অবশ্যই বিশাল পরিমাণ ভর হারাতে থাকবে।

প্রাথমিক নক্ষত্রটি সম্ভবত যে কোনো সময়ে সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হবে। কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এটি এখন থেকে এক মিলিয়ন বছরের মধ্যে যেকোনো সময় ঘটবে।
ইটা কারিনাকে প্রতারক সুপারনোভা হিসেবে গণ্য করা হয়। এর মানে হল যে নক্ষত্রটি আসলে বিস্ফোরিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাটি নক্ষত্রকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর ফলে নক্ষত্রটি গ্যাস এবং ধুলোর মেঘে আবৃত হয়ে পড়ে। ইটা কারিনা নিশ্চয়ই আরেকটি সুপারনোভা ঘটনার মধ্য দিয়ে যাবে।
কোন কোন জ্যোতির্বিদরা অনুমান করেন যে ইটা কারিনার চূড়ান্ত ভাগ্য হল ভেঙে পড়া এবং একটি ব্ল্যাক হোল তৈরি করা। ইটা কারিনা হল সবচেয়ে বৃহদাকার নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি যাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে৷ একে যদি সৌরজগতে স্থাপন করা হয়, তাহলে ইটা কারিনা বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছাবে বা এমনকি অতিক্রম করবে।
সমগ্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে মাত্র ১০টি নক্ষত্রের ভর ইটা ক্যারিনার থেকে বেশি। সবচেয়ে বড়টির নাম R136a1।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply