মেঘমুক্ত রাতের আকাশে দিকে তাকালে বিভিন্ন রঙের অনেক নক্ষত্র দেখতে পাবেন। দেখা যায় হলুদ, নীল সাদা বর্ণের নক্ষত্র আকাশে মিটমিট করছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন এর মধ্যে কিছু নক্ষত্র আছে হালকা থেকে টকটকে লাল রঙের।
এই নক্ষত্রগুলো কেন লাল?
খুব সহজ করে বললে, তাপমাত্রা হচ্ছে কোন বস্তুর অণু-পরমাণুর গড় ত্বরণের সমষ্টি। যে নক্ষত্রের গ্যাস যত বেশী গরম,ততো বেশী আলোড়িত হয় তার অণু-পরমাণু।
নক্ষত্রের তাপমাত্রা অনুযায়ী এদেরকে বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়। সবচেয়ে গরম নক্ষত্রগুলো O শ্রেণীর। এরপরে B,A,F,G,K,M। এরমধ্যে M শ্রেনীর নক্ষত্রগুলো সবচেয়ে শীতল। এগুলোর তাপমাত্রা ৩,০০০ ডিগ্রী কেলভিন।
পারমাণবিক ফিউশনের জন্য একটি নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার পরে একটি লাল দৈত্য পরিণত হয়। এর মাধ্যমে একটি নক্ষত্রের মারা যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর শীতল এই নক্ষত্রগুলোকেই লাল দেখা যায়। কারণ এদের জ্বালানী শেষ পর্যায়ে।
কালপুরুষ (ওরিয়ন) নক্ষত্র মন্ডলে এই রকম একটি লাল নক্ষত্র আছে। এই নক্ষত্রটির নাম বেটেলজিউস। বাংলায় আদ্রা, আরবি আল-যাউজা ও আকাশের ম্যাপ অনুযায়ী আলফা ওরিওনিস। ওরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলের দ্বিতীয় উজ্জ্বল নক্ষত্র এটি যা শিকারীর পূর্ব কাঁধকে চিহ্নিত করে। এর নামটি এসেছে আরবি শব্দ বাত আল-জাওজা থেকে, যার অর্থ “দৈত্যের কাঁধ”।
এই নক্ষত্রটি আকাশের দশম উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বেটেলজিউস হল রাতের আকাশের সবচেয়ে সুপরিচিত নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি। এটি একটি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র। সাধারণত আপাত মাত্রা প্রায় ০.৬ থাকে।
এটি একটি বিশাল দৈত্যাকার লাল (Red supergiant) M-শ্রেণীর নক্ষত্র। এটি সূর্যের থেকে প্রায় ৭৬৪ গুণ বড়। নক্ষত্রটি এতটাই বিশাল যে একে যদি সূর্যের স্থানে বসানো হয়, তাহলে এটি বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
এর ভর সূর্যের চেয়ে ১২-গুণ বেশী। বেটেলজিউসের আনুমানিক ব্যাস ৭৬৭ মিলিয়ন মাইল (প্রায় ১.২ বিলিয়ন কি.মি.)। আমাদের সূর্যের বয়স প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছরের বিপরীতে নক্ষত্রটির বয়স নয় থেকে দশ মিলিয়ন বছরের মধ্যে অনুমান করা হয়।
আমাদের সূর্য কেবল মধ্যবয়সী, যখন বেটেলজিউস তার জীবনের শেষের দিকে। এর কারণ হল বেটেলজিউসের মতো বৃহদাকার সুপারজায়ান্ট নক্ষত্রগুলি আমাদের সূর্যের মতো মাঝারি আকারের নক্ষত্রের চেয়ে আরও দ্রুত তাদের থার্মোনিউক্লিয়ার জ্বালানী পোড়ায়।
এর পৃষ্ঠতাপমাত্রা ৩,৬০০ কেলভিন, দৃশ্যমান উজ্জলতা ০.৪২। আমাদের থেকে ৬৪২ আলোকবর্ষ দুরে এর অবস্থান এই নক্ষত্রটির লাল রংয়ের জন্য এই নক্ষত্রটির জ্বালানি শেষ পর্যায়ে। আর বর্তমানে এই নক্ষত্রটি জ্যোতির্বিদদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। চলুন কারণটা জানার চেষ্টা করি।
২০১৯ সালের শেষের দিকে বেটেলজিউস ম্লান হতে শুরু করে। এটি ২০২০ সালের শুরুর দিকে ১.৬ এর আপাত মাত্রায় পৌঁছেছিল এবং সেই বছরের পরেই আবার তার আসল উজ্জ্বলতায় ফিরে আসে।
বেটেলজিউস একটি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র। অর্থাৎ যার উজ্জ্বলতা সময়ের সাথে সাথে ওঠানামা করে। নক্ষত্রটির ম্লান হওয়ার একাধিক চক্র পাওয়া গেছে। একটি ৫.৯ বছরের প্রধান চক্র এবং এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট চক্র আছে। কাজেই উজ্জ্বলতার ভিন্নতা দেখা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু বেটেলজিউসের উজ্জ্বলতা প্রত্যাশিত তুলনায় অনেক নীচে নেমে যাচ্ছিল। এর ম্লান হওয়া এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে রাতের আকাশে এটি চোখেও দেখা যাচ্ছিল।
এই দাবী করার দুই সপ্তাহের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিগুয়েল মন্টারগেসের নেতৃত্বে একটি দল ইউরোপীয় সাউদার্ন অবজারভেটরির ভেরী লার্জ টেলিস্কোপের স্পেকট্রো-পোলারিমেট্রিক হাই-কন্ট্রাস্ট এক্সোপ্ল্যানেট রিসার্চ (SPHERE) যন্ত্রের সাহায্যে বেটেলজিউস পর্যবেক্ষণ করার সিন্ধান্ত নেয়।
স্পেকট্রো-পোলারিমেট্রিক হাই-কন্ট্রাস্ট এর উচ্চ কৌণিক রেজোলিউশন ক্ষমতা বেটেলজিউসের পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়। যার মানে নক্ষত্রটিকে আর বিন্দু উৎসের মতো দেখায় না এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যগুলিকে আলাদা করতে পারে। এই পর্যবেক্ষনে এটি পরিষ্কার যে নক্ষত্রের দক্ষিণ অংশে উজ্জ্বলতা হ্রাস পেয়েছে।
কিন্তু বেটেলজিউসের উজ্জ্বলতায় এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কী হতে পারে?
রেড সুপারজায়েন্ট সর্ম্পকিত অনেক তথ্য অজানা তাই একাধিক কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ভূপৃষ্ঠের কিছু অংশ শীতল তাপমাত্রায় থাকার বিষয়টি নক্ষত্রের পরিবাহী ক্রিয়াকলাপের কারণে হতে পারে। অথবা ধুলোর ঝুঁটি বের হয়েছে সেই জন্য হতে পারে। এই ধূলিকণা তত্ত্বটি খুব অপ্রত্যাশিত হবে না। কারণ বেটেলজিউসকে ইতিমধ্যেই অন্যান্য অনেক লাল সুপারজায়েন্টের মতো বাইরের দিকে ধূলিপূর্ণ বাতাস পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখা গেছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে নক্ষত্রটি তার দৃশ্যমান পৃষ্ঠের একটি বিশাল অংশ উড়িয়ে দিয়েছে৷ এই “গ্রেট ডিমিং” গ্যাসের একটি দৈত্যাকার ইজেকশনের কারণে ঘটেছিল। এটি ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে নির্গত পৃষ্ঠ থেকে অস্পষ্ট ধূলিকণার একটি বিশাল মেঘ তৈরি হয়, যা নক্ষত্রের আলোকে অবরুদ্ধ করে।
নক্ষত্রটি এখনও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। ফটোস্ফিয়ার নিজেকে পুনঃনির্মাণ করছে। অভ্যন্তরটি একটি ঘণ্টার মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, মনে হয় যেন একটি স্লেজহ্যামার দিয়ে আঘাত করা হয়েছে যা নক্ষত্রের স্বাভাবিক চক্রকে ব্যাহত করছে। এর মানে এই নয় যে দানব নক্ষত্রটি শীঘ্রই যে কোনও সময় বিস্ফোরিত হতে চলেছে। তবে নক্ষত্রটির জীবনের শেষ অধ্যায়গুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করবে।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এবং অন্যান্য মানমন্দির থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে উজ্জ্বল লাল সুপারজায়ান্ট নক্ষত্র বেটেলজিউস আক্ষরিক অর্থেই ২০১৯ সালে তার শীর্ষকে উড়িয়ে দিয়েছে। তার দৃশ্যমান পৃষ্ঠের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়েছে এবং একটি বিশাল সারফেস ম্যাস ইজেকশন (SME) তৈরি করেছে। এটি এমন কিছু যা আগে কখনও একজন সাধারণ নক্ষত্রের আচরণে দেখা যায়নি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কখনও মহাকাশে একটি নক্ষত্রের দৃশ্যমান পৃষ্ঠের এত বড় পরিমাণে বিস্ফোরিত হতে দেখেননি। অতএব, পৃষ্ঠ ভর নির্গমণ এবং করোনা-ভর নির্গমন ভিন্ন ঘটনা হতে পারে
আমাদের সূর্য নিয়মিতভাবে তার ক্ষীণ বাহ্যিক বায়ুমণ্ডলের (করোনা) কিছু অংশ উড়িয়ে দেয়। এটি করোনাল ম্যাস ইজেকশন (CME) নামে পরিচিত। কিন্তু বেটেলজিউস এসএমই একটি সাধারণ সিএমইর থেকে ৪০০ বিলিয়ন গুণ বেশি ভরের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে!
সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের আন্দ্রেয়া ডুপ্রি বলেন, “দানব নক্ষত্রটি এখনও ধীরে ধীরে এই বিপর্যয়কর উত্থান থেকে সেরে উঠছে। এই নতুন পর্যবেক্ষণগুলি সুপারনোভা হিসাবে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে তাদের পারমাণবিক ফিউশনের সাথে সাথে কীভাবে লাল নক্ষত্রগুলি তাদের ভর হারায় সে সম্পর্কে সূত্র দেয়”। ভর ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের ভাগ্য প্রভাবিত করে।
যাই হোক, বেটেলজিউসের আশ্চর্যজনকভাবে পেটুল্যান্ট আচরণ এটা প্রমাণ করে না যে নক্ষত্রটি শীঘ্রই যে কোনও সময় নিজেকে উড়িয়ে দিয়ে সুপার নোভায় পরিনত হবে।
ডুপ্রি বলেন যে হাবল ডেটা রহস্যটি খুঁজে বের করতে সহায়তা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
“আমরা এর আগে কখনও একটি নক্ষত্রের পৃষ্ঠের বিশাল ভর ইজেকশন দেখিনি। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা যা আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং হাবলের সাথে পৃষ্ঠের বিশদ সমাধান করতে পারি।
কিন্তু কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে বেটেলজিউস সুপারনোভা হবে, কিন্তু তা আরো লক্ষ লক্ষ বছর পরে। যে সমস্ত সুপারজায়েন্ট, নক্ষত্র লাল বা নীল যাই হোক, সুপারনোভা হিসাবে তাদের জীবন শেষ হবে।
বেটেলজিউসের ক্ষেত্রে, ২০২১ সালের গবেষণা অনুসারে এটি এক লক্ষ বছরের মধ্যে যে কোনও সময় ঘটতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
যাইহোক, একদিন বেটেলজিউস বিস্ফোরিত হবে এবং পৃথিবীবাসী একটি আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখতে পাবে। এটি পৃথিবীর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে উজ্জ্বল হবে এবং দিনের বেলায় দেখা যাবে!
সমস্ত নথিভুক্ত ইতিহাসে খালি চোখে মাত্র দশটি সুপারনোভা দেখা গেছে। এখন আমরা উজ্জ্বল SN1006 (1006 AD সালে প্রত্যক্ষদর্শী) এর মতো সুপারনোভা অবশিষ্টাংশগুলি টেলিস্কোপের সাহায্যে আবার পর্যবেক্ষন করতে পারি। SN1006 একটি সুপারনোভা যা সম্ভবত রেকর্ড করা ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্যবেক্ষিত নাক্ষত্রিক ঘটনা, যা আনুমানিক −৭.৫ ভিজ্যুয়াল ম্যাগনিটিউডে পৌঁছায় এবং শুক্রের উজ্জ্বলতার প্রায় ষোল গুণ বেশি।
এই বিস্ফোরণ আকাশে দেখা সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুগুলির মধ্যে একটি৷ এই সুপারনোভাকে চীন, জাপান, আধুনিক ইরাক, মিশর এবং ইউরোপ জুড়ে পর্যবেক্ষকদের দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছিল।
এবং সম্ভবত রেকর্ড করা হয়েছিল উত্তর আমেরিকার পেট্রোগ্লিফগুলিতে। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এটি দিনের বেলায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন পৃথিবী থেকে এর দূরত্বকে প্রায় ৭,২০০ আলোকবর্ষ বলে মনে করেন।
নক্ষত্রটি খালি চোখে দেখে নিতে পারেন দুরবীনে খুব সুন্দর দেখা যায়।
জানুয়ারী মাসে ওরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলটিকে সব থেকে ভালো দেখা যায়।
তথ্যসুত্রঃ
Betelgeuse: What’s up? | Space | EarthSky
Supergiant Betelgeuse had a never-before-seen massive eruption
Hubble Sees Red Supergiant Star Recovering After Blowing Its Top | NASA
Betelgeuse | Facts about the red giant star in Orion | BBC Sky at Night Magazine
Leave a Reply