ড. রহমান খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন, চিন্তায় প্রায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। তার মাথার উপর একটা পিস্তল তাক করা। পিস্তলটা তার খুবই পরিচিত। গত মাসেই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ ইকবালকে গিফট করেছে। আজ সেই প্রিয় পিস্তল ও প্রিয় মানুষটা তার মুখোমুখি।
-“তুমি আমার জানের দোস্ত, রহমান। কিন্তু কি করমু কও? দুনিয়াডা হইল দাবার মাঠ, তোমারে ছাঁড়লে তো আমি চেকম্যাড হইয়া যামু! কও শেষ ইচ্ছা কি?”
-“তুই কি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবি ?”
ইকবাল ড. রহমানকে থাপ্পড় দিয়ে বলল, “তর সস্তা সেন্টিমেন্ট শোনার সময় নাই। শেষ ইচ্ছা থাকলে ক’ নাইলে দিলাম…” বলে সে পিস্তল লোড করল।
ড. রহমান ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “দাঁড়া, আমার একটা পেপার আছে, এনট্রপি নিয়ে। কাজ প্রায় শেষের দিকে। তুই এইটা আমার ছাত্র মাহির কাছে পৌঁছে দিবি?”
-“কই? দে, রাখলাম তোর শেষ কথা। বন্ধু মানুষ একটু তো ফেবার করাই যায়!”
ড. রহমান উঠে টেবিলের দিকে গিয়ে নিচু হলো, কিছুক্ষণ পর ঘাটাঘাটি করে একটা ফাইল হাতে নিয়ে ইকবালের কাছে দিল। ইকবাল ফাইলটায় চোখ বোলালো, কিন্তু কিছু বুঝলো না। আর খানিক্ষনের মধ্যেই তার চোখ কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। এই চোখে তীব্র বিভ্রান্তি, শূন্যতা। অথচ দুই মিনিট আগেই সেখানে ছিল ভয়ংকর লোভ ও তীব্র বিভৎসতা! ড. রহমান ইকবালের দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দে হেসে ফেলল!
-“ইউ আর চেক ম্যাড, ইকবাল! তোর পিস্তলটা দিয়ে এখন তোর মাথায় গুলি কর।”
ইকবাল নির্দ্বিধায় পিস্তলটা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করল। তার ঘিলু চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যার খানিকটা আছে ড. রহমানের গালে!
কাগজটা হাতে নেয়ার পর কেন ইকবাল বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, সেটা হয়তো আপনারা আঁচ করতে পারছেন। এর কারণ হলো স্কোপলামিন। আপনাদের কি মনে হয় ইকবাল যদি হিপনোটাইজ না হতো তবে সে ড. রহমানের সেই প্রস্তাবে রাজি হতো? না, কারণ মানুষ মৃত্যুর সময় খড়কুটো আঁকড়ে ধরে হলেও বাঁচতে চায়। ইকবাল নিজের সত্তাকে যখন নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছিল, তখন সে কোনোভাবেই নিজেকে শেষ করে দিতে পারতো না! এই ধরনের ঘটনা কিন্তু জৈব যৌগও সম্ভব। আর যে জিনিসটা কোনো যৌগের ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে কার্যকরী মূলক বা ফাংশনাল গ্রুপ।
কার্যকরী মূলক
এখন আমরা কোনো যৌগের ফাংশনাল গ্রুপ সম্পর্কে জানব।
C2H6 (ইথিন) থেকে ১টা H সরিয়ে OH যুক্ত করলে পাওয়া যায় C2H5OH (ইথানল) । এখানে H কে সরিয়ে শুধুমাত্র OH আনার কারণে যৌগের ধর্ম সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়।
C2H6 +OH → C2H5OH + H
এখানে, C2H6 কক্ষ তাপমাত্রায় গ্যাস হিসেবে থাকে। তাই এর গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক ও খুবই কম। আর এটা পানিতে দ্রবণীয় হয় না সহজে। C2H6 পানিতে দ্রবণীয় না হওয়ার কারণ হল C ও H এর তড়িৎ ঋণাত্মকতা প্রায় সমান। তাই পানির H δ+ ও O 2δ–, C ও H কে আকর্ষণ করতে পারে না। তাই C2H6 পানিতে অদ্রবণীয়। আবার, C2H5OH রুম টেম্পারেচারে তরল। তাই গলনাংক ও স্ফুটনাংক C2H6 এর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এরা পানিতে দ্রবণীয়। কারণ এখানে C ও H এর পাশাপাশি OH থাকে। OH এর তড়িৎ ঋণাত্মকতা C ও H এর সমান না। তাই C2H5OH কে H δ + ও O 2δ– আকর্ষণ করতে পারে ।
এখন দেখো, শুধুমাত্র OH জন্য C2H6 এর ধর্ম পুরো বদলে গেল। তাই এখানে OH হলো কার্যকরী মূলক বা ফাংশনাল গ্রুপ।
তার মানে যে সকল জিনিস একটা জৈব যৌগে উপস্থিত থেকে যৌগের পুরো ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে, তাই-ই ফাংশনাল গ্রুপ। ফাংশনাল গ্রুপ কিন্তু শুধুমাত্র পরমাণুর গুচ্ছ না, কার্বন-কার্বন বন্ধনের প্রকৃতিও ফাংশনাল গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে। সেটা পরে আলোচনা করা যাবে। জৈব যৌগে এরকম আরও অনেক কার্যকরী মূলক আছে। যেমন: –OH, –CHO, –COOH ইত্যাদি। এদের আলাদা আলাদা নাম ও গঠন আছে।
সমগোত্রীয় শ্রেণি
কিছুক্ষণ আগে আমরা কার্যকরী মূলক সম্পর্কে জেনেছি। এবার আমরা আলোচনা করব হোমোলোগাস সিরিজ বা সমগোত্রীয় শ্রেণী নিয়ে। আমার কাছে একটা প্যাকেটে কলা আর অন্য প্যাকেটে আপেল আছে। এখন একটা জিনিস খেয়াল করো, একটা কলা আর একটা আপেল কি একই? না, কারণ তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই। তারমানে তারা দুইটা ভিন্ন জিনিস। এখন আমি পাশাপাশি দুইটা কলা নিই। কলা দুইটার মধ্যে অনেক মিল আছে। কিন্তু তারা কি হুবহু একই ধরনের হবে? না, অনেক মিল থাকলেও তারা হুবহু একই না। তাদের মধ্যে কিছুটা তফাৎ থাকবেই। হয়তো একটা বড়ো অন্যটা ছোটো। পাশাপাশি দুইটা আপেলের বেলাতেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। এটাই মূলত সমগোত্রীয় শ্রেণির মূল ধারণা। যেসব যৌগের ধর্মে অনেক মিল থাকে তারা একত্রে একটা সমগোত্রীয় শ্রেণি। একটা বিষয়ে বোঝা দরকার, একই হোমোলোগাস সিরিজ এর দুইটা হোমোলোগ এর মাঝে অনেক মিল থাকলেও তারা হুবহু এক না। তাদেরও তফাৎ আছে। সেটা হল কার্বন সংখ্যায়।
তো আমরা সমগোত্রীয় শ্রেণি বা হোমোলোগাস সিরিজ মূল ধারণাটা বুঝেছি, কিন্তু তাকে এখনো সংজ্ঞায়িত করিনি ৷ দেখো, আমরা কিন্তু জানি যে যৌগের কার্যকরী মূলক তার ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। আবার যারা একই ধর্মের তারা একটা নির্দিষ্ট সমগোত্রীয় শ্রেণির সদস্য। তাহলে সমগোত্রীয় শ্রেণির সংজ্ঞা হবে এমন—
“যেসব যৌগের কার্যকরী মূলক একই থাকার কারণে তাদের সকল সদস্যদের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই থাকে তাদেরকে সমগোত্রীয় শ্রেণী বলে। ”
এখানে একটা কথা বলে নিই, কার্যকরী মূলকে আমরা ফাংশনাল গ্রুপ কেন বলছি? কারণ কার্যকরী মূলক যৌগের ধর্মকে কার্যকর করে। অনেকটা মোবাইল সেটিংস এর মতো।
এখন আমরা আবার কলা ও আপেলের প্যাকেটে ফিরে যাই। কিন্তু সেখানে কলার জায়গায় আছে সেসব যৌগ যাদের কার্যকরী মূলক ‘–OH’ আর আপেলের জায়গায় আছে সেসব যৌগ যাদের কার্যকরী মূলক –COOH।
অ্যালকোহল কার্বোক্সিলিক এসিড
CH3OH HCOOH
C2H5OH CH3COOH
এখানে ইথানল (C2H5OH) এবং মিথানয়িক এসিড (HCOOH) একই না। ইথানল হল অ্যালকোহল আর মিথানয়িক এসিড হল এসিড। তাই তারা আলাদা হোমোলগ । আবার, মিথানল ( CH3OH) ও ইথানল (C2H5OH) এর ধর্ম প্রায় এক হলেও তারা হুবুহু একই না । তাদের পার্থক্য কার্বন সংখ্যার। সমগোত্রীয় শ্রেণির নাম রাখা হয় ফাংশনাল গ্রুপ বা কার্যকরী মূলকের সাথে মিলিয়ে। যেহেতু জৈব যৌগ হলো হাইড্রোকার্বন ও তাদের থেকে উদ্ভুতজাতদের নিয়ে আলোচনা, তাই এবার আমরা কিছু সহজ হাইড্রোকার্বনের সমগোত্রীয় শ্রেণি (Homologous series) নিয়ে আলোচনা করব। হাইড্রোকার্বন কে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়,
১. অ্যালিফেটিক হাইড্রোকার্বন (চর্বিজাতীয়)
২. অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (সুগন্ধীযুক্ত)
অ্যালিফেটিক ও অ্যারোমেটিক এর বাংলা নাম গুলো অর্গানিক কম্পাউন্ডস বা ‘জৈব যৌগ’ নামটার মতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বময়। কারণ জৈব যৌগ কৃত্রিমভাবে বানানো যায়।
অ্যালিফেটিক আবার চার ভাগে ভাগে বিভক্ত:
১. অ্যালকেন
২. অ্যালকিন
৩.অ্যালকাইন
৪. চাক্রিক অ্যালিফেটিক যৌগ ( Cycle Aliphatic Compound)
আমরা অ্যালকিন, অ্যালকেন ও অ্যালকাইন নিয়েই মূলত আলোচনা করব।
অ্যালকেন হলো সম্পৃক্ত যৌগ । অ্যালকিন ও অ্যালকাইন হলো অসম্পৃক্ত। অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনও অসম্পৃক্ত। তাহলে তাদের আলাদা ভাবে ভাগ করা কেন হলো? সেটা জানার আগে সম্পৃক্ততা আর অসম্পৃক্ত সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। রসায়নে আমরা সম্পৃক্ত দ্রবণ টার্মটা অনেক শুনে থাকি। আমি একটা গ্লাসে পানি নিয়ে সেখানে চিনি যোগ করলাম। একটু পর চিনিটা পানিতে মিশে যাবে। এভাবে বারবার চিনি যোগ করার একটা পর্যায়ে আমরা যত চিনিই দিই না কেন, তা আর পানিতে মিশবে না। গ্লাসের তলায় জমে থাকবে। তখন আমরা ওই চিনির দ্রবণকে বলব সম্পৃক্ত দ্রবণ।
সম্পৃক্ত দ্রবণ হল এমন একটা দ্রবণ যেখানে পানির (দ্রাবক) যতটুকু চিনির (দ্রবের) সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা আছে, তার সবটাই ব্যবহার করে ফেলা। তাহলে সম্পৃক্ততা মানে কী? সম্পৃক্ততা মানে হলো কোনো কিছুর সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে ফেলা। অ্যালকেন সম্পৃক্ত মানে হল বন্ধন দ্বারা সম্পৃক্ত। আমরা জানি অর্গানিক কম্পাউন্ডের কেন্দ্রে থাকে কার্বন আর চার পাশে থাকে হাইড্রোজেন । কার্বনের যোজনী চার, তার মানে সে তার চারপাশে চারটা জায়গা জুড়ে পরমাণু ধারণ করতে পারে। যেসব যৌগ অ্যালকেন, তাদের চারপাশে চারটা জায়গা জুড়ে পরমাণু থাকে। যেমন: CH4, C2H6
এখন একটা প্রশ্ন, আমরা যে অ্যালকেন, অ্যালকিন, অ্যালকাইন কে আলাদা সমগোত্রীয় শ্রেণির বলছি তাহলে তাদের কার্যকরী মূলক (Functional group) কি ? তাদের কার্যকরী মূলক হলো কার্বন-কার্বন বন্ধন প্রকৃতি। তাই আমি বলেছিলাম, কার্যকরী মূলকে শুধু পরমানু গুচ্ছ থাকে না।
অ্যালকেন এর কার্বন-কার্বন বন্ধন তাহলে কেমন হয়? দেখো, একটা হাইড্রোকার্বন তখনই সম্পৃক্ত হবে বা সর্বোচ্চ জায়গা জুড়ে পরমাণু ধারণ করতে পারবে যখন কার্বনগুলোর মধ্যে একটা মাত্র বন্ধন থাকবে বা কার্বন-কার্বন একক বন্ধন (C–C) ।
এখন আসি অ্যালকিন ও অ্যালকাইনদের কার্যকরী মূলকে। হাইড্রোকার্বন সম্পৃক্ত হতে পারে শুধুমাত্র একটা উপায়ে। কিন্তু হাইড্রোকার্বন অসম্পৃক্ত হতে পারে দুইটা উপায়ে। কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন (C=C) এবং কার্বন-কার্বন ত্রিবন্ধন (C≡C)। এখন প্রশ্ন হতে পারে কার্বন-কার্বন চারটা বন্ধনও তো হতে পারে (মানে C2 যৌগ) আসলে এই ধরনের কোনো অণু প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। কেন? সেটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। যেসব যৌগে C=C থাকে তাদেরকে বলা হয় অ্যালকিন (Alkene), মানে তারা একই সমজাতীয়। যেমন: C2H4 (ইথিন)।
অ্যালকেন এর প্রথম যৌগ হলো মিথেন। অ্যালকিনের কিন্তু মিথিন নামের কোনো যৌগ নেই। কারণ কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন হওয়ার জন্য কমপক্ষে ২ টা কার্বন দরকার। আর এই দুইটা কার্বন যাদের থাকে তাদের নামের মূল হয় ‘ইথ’ থেকে। (নামকরণ নিয়ে আশাকরি আলাদা পর্ব হবে)
অ্যালকিন অসম্পৃক্ত কারণ তার চারপাশে তিনটা জায়গায় পরমাণু আছে। আবার যারা C≡C বন্ধনে থাকে, তাদেরকে আলকাইন বলা হয়। যেমন: C2H2। এখানে C এর ২টা জায়গায় পরমাণু আছে। তাই অসম্পৃক্ত।
অ্যারোমেটিক যৌগরাও অসম্পৃক্ত। কিন্তু তারা কেন আলাদা ভাবে থাকে সেটা আগামী পর্বে আলোচনা হবে।
Leave a Reply