আমার বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জগতে আনাগোনার শুরু হয় মূলত হুমায়ূন আহমেদ এর কল্পকাহিনীর বই দিয়ে। অনন্ত নক্ষত্রবীথি, তারা তিনজন, ফিহা সমীকরণ দিয়ে। তারপরে একে একে বিজ্ঞান লেখক জাফর ইকবাল এর কল্পগল্পের বই গুলো পড়া শুরু করেছিলাম। ওয়েলসের টাইম মেশিন, আসিমভ এর বিজ্ঞান ফিকশন গুলোও একে একে পড়া হয়েছিলো। তবে সবগুলো পড়া শেষ হয় নি। দীপেন ভট্টাচার্যের কল্পকাহিনীর বই পড়া শুরু হয়েছিল অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো দিয়ে। তার লেখায় শব্দ নিয়ে খেলা করার অসামান্য দক্ষতা আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করেছিল বলা যায়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর ভেতরেও সাহিত্যরসটা কমতি থাকে না এতটুকু।
সম্প্রতি তার লেখা আরেকটা কল্পগল্পের বই “অদিতার আঁধার” পড়ে শেষ করলাম। আমার কাছে দীপেন স্যারের লেখা কল্পকাহিনীর সবচেয়ে সুন্দর দিক হল কাহিনীর বৈচিত্র্যতা। সচরাচর লেখা কল্পকাহিনী গুলো থেকে বেরিয়ে ভিন্ন ধরণে এগোতে থাকে গল্প। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী গুলোতে সাধারণত দেখা যায় বাস্তব বিজ্ঞানের আর কাহিনীর সাথে একটা রাত দিন ফারাক। কিন্তু দীপেন স্যারের লেখা কল্পকাহিনী গুলো সেদিক থেকে একেবারেই ভিন্ন। গল্পের প্রেক্ষাপট যেন একদমই আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। বাস্তবতার নিরিখে বিজ্ঞানের যুক্তি ঠিক রেখে গল্প এগোতে থাকে। আরেকটা চমৎকার বিষয় হচ্ছে, গল্পের মূল চরিত্র, ঘটনা গুলো সব ঘটতে থাকে আমাদের দেশীয় আবহেই। ফলে কল্পকাহিনীকে মনে হয় না একদম অচিনপুরের কোন ঘটনা।
অদিতার আঁধারও ঠিক সেরকম জরানারই একটা ফিকশন। গল্পের মূল চরিত্র অদিতা সান হচ্ছেন একজন বনবিজ্ঞানী। কাহিনী যে সময়ের কথা বলছে সেটা আজ থেকে আরও দুই হাজার বছর পরের, চার হাজার তিনশো ঊনষাট সাল। একসময়কার জৌলস শহর ঢাকা, কলকাতা সহ বেশির ভাগই বিলুপ্ত। দেশ নামক যেই ধারণা ছিল তা আর নেই। সকল দেশের সীমানা উঠে গেছে। পৃথিবীর মানুষেরা এখন একটাই দেশে বাস করে আর সেটা হল পৃথিবী। গল্পের নগরীর নাম হল বিশালগড়। আর সেই নগরের নির্জনতম বন ডামুরীর গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হলেন অদিতা সান। খুন, ধর্ষণ, যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় সংঘাত সহ হাজার বছর ধরে যেসব পাশবিক আচার মানুষের সহজাত আচরণ ছিল তা আজ নেই বললেই চলে। মৃত্যু নামক যেই অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ধারনায় মানুষ বিশ্বাসি ছিল তা বিলুপ্ত হয়েছে সেই কবেই।
মানুষ বোঝতে শিখেছে এই মহাবিশ্বের বিশালতায় তার অস্তিত্বের গুরুত্ব। মানুষ জেনে গেছে এই বিশাল উদাসীন মহাবিশ্বে তাদের একমাত্র ঠিকানা আসলে এই পৃথিবীই। আর কোথাও আসলে পৃথিবীর মতন কোন ঠিকানা নেই। আর মানুষের অস্তিত্বের স্থিতির প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেই মৃত্যুকে নেই করে দিতে হয়েছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে। মানুষ মস্তিষ্ক কপি করার কৌশল শিখেছে অনেকদিন আগেই। প্রতিটি জীবিত মানুষের বাধ্যতামূলক ভাবে তার মস্তিষ্ক কপি করাতে হবে। আর সেটা করা হয় তিন বছর অন্তর অন্তর। কপি করা মস্তিষ্ক গুলোকে সংরক্ষিত করা হয় নিলয়ে। মস্তিষ্ক কপি করার কেন্দ্রের নাম নিলয়। প্রতিটি নিলয়ে একজন মানুষের মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ দুটি কপি রাখা হয়। কোন মানুষ কোন কারণে নিহত হলে তার পুরনো শরীরের মধ্যে কপি করা মস্তিষ্ক বসানো হয়। এভাবে সে মানুষটার পুনর্জন্ম হয়।
মস্তিস্ক কপি করার এই কৌশল আবিষ্কারের পেছনে যে মানুষটার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে তার নাম বিষাণ। বিষাণ পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কবিশারদ। বিষাণ অদিতা সানের সহমানুষ। তাদের সেনভা নামে একটা ছেলে সন্তান আছে। বিষাণ আর অদিতার মধ্যে বিচ্ছেদ হয় অনেক বছর আগে। তাদের পুরনো প্রেম হারিয়ে গিয়েছিল রোমান্টিকতার বিমূর্ত প্রতীক চাঁদের মাটিতে। সেবার বিষাণ, অদিতা আর তার ছেলে সেনভা চাঁদে ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানে হঠাৎ তারা সেনভাকে হারিয়ে ফেলে। আর খুঁজে পাওয়া যায় নি সেনভা কে। পরবর্তীতে পৃথিবীতে ফিরে তারা সেনভাকে ফিরিয়ে এনেছিল তার কপি করা মস্তিষ্ক কে প্রতিস্থাপিত করে। কিন্তু এই সেনভা আর হারিয়ে যাওয়া সেনভার মধ্যে একটা ফারাক থেকেই গেছিল। তাই নতুন সেনভা কোনদিন মেনে নিতে পারে নি তার মা-বাবা কে। অদিতাও পারে নি নতুন সেনভাকে সহজভাবে নিতে।
মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন পদ্ধতি মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ঠিকই। কিন্তু সে নতুন এক মানুষ হয়ে আসে। সেনভা কে হারানোর বিষণ্ণতাই অদিতা আর বিষাণ এর মধ্যকার প্রেমকে অর্থহীন করে তোলে। সেই বিষণ্ণতা অদিতাকে ঘুমোতে দেয় না। তার কাছে বার বার ফিরে আসে অন্ধকার এক মেঘ হয়ে। সেই আলো আধারিরি মেঘ অদিতাকে নিয়ে যায় নির্জন, নিবিড় ডামুরীর বনে। অদিতা হারিয়ে যায় ডামুরীর ঝোনাকিদের আলোর মেলায়।
মানুষের এই অসামান্য অর্জন মেনে নিতে পারে নি অনেকেই। কেননা শয়ে শয়ে বছর বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে হতে থাকে কিছু মানুষের। তারা মনে করে মৃত্যু মানুষের অধিকার। মানুষ মরতে চায়। কিন্তু এই সময়ে মৃত্যু স্বপ্নের মত। শরীরে কোন দুর্ঘটনা জনিত কারণে ক্ষতের সৃষ্টি হলে সেই ক্ষত সাথে সাথে সারিয়ে তুলতে কাজে লেগে যায় অসংখ্য ন্যানো রোবটেরা। দেহের শিরায় শিরায় এই জৈবিক ন্যানো রোবট ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারো বয়স অন্তত দুইশো বছর না হলে সে মৃত্যুর জন্যে দরখাস্ত করতে পারে না। মানুষের এই অতৃপ্তিকর বেঁচে থাকা একসময় প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। আর সেই স্ফুলিঙ্গকে নেতৃত্ব দেয় লোহিতক নামের গোপন সংগঠন। লোহিতক এর কেন্দ্রীয় নেতা প্রফেসর রাস্কো। রাস্কোর নেতৃত্বেই বিষাণ মস্তিস্ক প্রতিস্থাপন গবেষণায় সফলতা পায়। বলা যায় সে-ই পৃথিবীর মানুষের অমরত্ব নিয়ে ভেবেছে সবচাইতে বেশি।
অদিতাও রাস্কো আর বিষাণের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। সেই থেকেই ধীরে ধীরে রাস্কোর মনে অদিতার জন্যে প্রণয় জাগতে শুরু করে। কিন্তু অদিতা সাড়া দেয় নি রাস্কোর প্রেম আবেদন এর প্রতি। সে চলে গেছে বিষাণের হাত ধরে। অদিতাকে না পাওয়ার প্রতিহিংসা জেগে থাকে রাস্কোর মনে। সেই হিংসার আগুন পরিণত হয় এক ধ্বংসাত্মক বিপ্লবে। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন গবেষণায় সফলতা পাবার পরে বেকে বসেন রাস্কো নিজেই। এই পদ্ধতিতে মানুষকে ফিরিয়ে আনার ঘোর বিরোধিতা শুরু করেন প্রফেসর রাস্কো। তিনি দাবী করেন এই পদ্ধতিতে আগের মানুষটাকে ফেরানো সম্ভব না কোনো ভাবেই। যে আসে সে আসলে অন্য এক সত্তা। কিন্তু বিষাণ রাস্কোর মানা সত্ত্বেও তার গবেষণা তুলে দেয় কর্তৃপক্ষের হাতে। একদিকে পুরনো প্রেম কে না পাওয়ার হিংসা আর অন্যদিকে বিষাণের বিশ্বাসঘাতকতা-ই রাস্কোকে চালিত করে লোহিতক নামের এই সংঘটন বানাতে।
লোহিতক এর সদস্যরা চূড়ান্ত ভাবে মনে করে মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের এর পদ্ধতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলাই তাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য। সেই সাথে ধ্বংস করে দিতে হবে নিলয়ে থাকা সবগুলো কপি করা মস্তিষ্ককে। সেই বিধ্বংসি বিপ্লব অবশেষে সফল হয়। রাস্কোর নেতৃত্বে ধ্বংস করে দেয়া হয় সবগুলো নিলয়কে। পুরনো প্রেমের আগুন নেভাতে হত্যা করা হয় অদিতা সানকে। সেই সাথে বিষাণ, সেনভা কাউকেই বাঁচিয়ে রাখা হয় নি। এভাবেই হয়ত মানবজাতির অক্লান্ত শ্রমে অর্জিত সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে।
সবশেষে সাহিত্যরস, কাহিনীর প্রেক্ষাপট, রহস্য আর মানুষের জটিল মনের বৈচিত্র্যতার এক অনাবিল সুন্দর মেলবন্ধন পেলাম ফিকশনটায়।
- বইয়ের নামঃ অদিতার আঁধার
- প্রকাশনীঃ প্রথমা
- মুদ্রিত মুল্যঃ ২৬০ টাকা
Leave a Reply