দ্বিপদী বিস্তৃতির সাথে আমাদের হাতেখড়ি হয়, (a+b)2 এর সূত্র মুখস্ত করতে গিয়ে। তারপর যখন দ্বিপদী বিস্তৃতির প্যাসকেলের ত্রিভুজের যাদুবিদ্যা দেখি, তখন পুরো ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে যাই। দ্বিপদী বিস্তৃতির কাজ হলো দুই পদ যুক্ত রাশি নিয়ে কাজ করা। যেমন-
দ্বিপদী বিস্তৃতি নিয়ে অনেক গণিতবিদ কাজ করেছেন। দেখাই যাচ্ছে, ঘাত যত বড় বিস্তৃতি তত বেশি। তাই এই বড় আর জটিল কাজ সহজ করতে এগিয়ে এলেন যাদুকর প্যাসকেল, আর তার জনপ্রিয় যাদু হলো তার ত্রিভুজ।
প্যাসকেলের ত্রিভুজটা হলো-
এই ত্রিভুজটি কাজ করে মূলত সহগ নিয়ে। এর প্রায় সারিটা হলো শূন্য ঘাতের সহগের, তারপরের সারিটা একঘাতের সহগ। এই সহগগুলো ১,১। কারণ (a+b)1 = a+b। মানে যা আছে তাই। এইজন্য ১,১। এরপর ধীরে ধীরে দুই ঘাত, তিন ঘাত, চার ঘাত, পাঁচ ঘাতের সহগ। আমি চার ঘাত পর্যন্তই লিখেছি।
এর বৈশিষ্ট্য হল, এটার দুই ধারে সবসময় ১ হবে। কারণ প্রথম পদে a এর ঘাত থাকে সর্বোচ্চ, যা একবারই হতে পারে। এটা উপরেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে পাশাপাশি ২ টা সহগ যোগ করে নিচে বসালেই পরের ঘাতের সহগ হয়ে যায়। যেমন–
১+১=২ এটা হলো দ্বিতীয় ঘাতের সহগ।
১+২=৩, ১+২=৩; তৃতীয় ঘাতের সহগ।
১+৩=৪, ৩+৩=৬, ৩+১=৪; এগুলো চতুর্থ ঘাতের সহগ। এভাবে চলতেই থাকবে।
ত্রুটিঃ উপরে দেখলাম যে, প্রতি ঘাতের সহগের জন্য আগের সহগ জানতে হচ্ছে। তাই এটা বড় কোন ঘাতে অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। এইটাই হলো মূল ত্রুটি।
প্যাসকেলের ত্রিভুজে আগের ঘাতেত পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করলে পরের ঘাতে বিস্তৃতির সহগ পাওয়া যায়। এই ফর্মুলাটা কেন কাজ করে?
চলো স্বয়ং প্যাসকেল সাহেব থেকে জেনে নেই…..
– প্যাসকেল সাহেব, প্যাসকেল সাহেব।
– এই তুই কে? তুই জানিস না আমার সময়ের কত দাম! কি চাস?
– না মানে ইয়ে, আপনার নামে যে ত্রিভুজ সেখানে পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করলে নতুন সহগ পাওয়া যায় কেন?
– ও আচ্ছা। ভিতরে আয়, তোদের মতো দু-চারটা কৌতূহলী ছাত্রদের আমার ভালো লাগে। খাতা-কলম নিয়ে আসি, বস এখানে।
– ত্রিভুজটা এমন :
তোর প্রশ্ন যে, এখানে 1+1 কেন হলো? 1-1 কেন হলো না। তাই তো?
– জি
– দেখ,ত্রিভুজের প্রথম সহগ 1। এটা বোঝায় (a+b)0=1, কেন 1 হলো জানিস?
– জানি,কিন্তু বুঝি না।
– বুঝতে হলে ভাবতে হবে। পাওয়ার 0 মানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কিছু নেই। ডানে -বামে, উপরে – নিচে যাওয়া যাবে না, এমন জিনিস হলো বিন্দু। কিন্তু বিন্দুর তো একটা অস্তিত্ব আছে। সেটা প্রকাশ করা হয় 1 দিয়ে। বুঝতে পারছিস?
– জি।
– এখন পরেরটা দেখ 1, 1। এটা হলো a+b। এখানে a ও b এর সহগ 1।
এখন,
(a+b) 2
=(a+b)(a+b)
= (1)a+(1)ab + (1)ab+(1)b
……………….
1a+2ab+1b[যোগ করে ]
এখন সহগ গুলো দেখ, প্রথম লাইনে a এর সহগ 1, ab এর 1। দ্বিতীয় লাইনে ab এর সহগ 1, b এর 1।আরেকটি জিনিস দেখ, ২য় লাইনটা কিন্তু একঘর ডানে সরিয়ে দিয়েছি। কারণ, দুই লাইনের ab সমজাতীয় পদ। তাই ab এর নিচে ab আর b চলে গেল ডানে। এখন a এর সহগ 1, 1 ab ও 1 ab মিলে 2, b এর সহগ 1। এভাবে আরও কয়েকটা করলে দেখা যাবে প্রান্তীয় সহগ হবে 1। আর মাঝখানের সহগ হবে আগের যেই সহগ তাদের যোগফল। তাই লিখা হয়:
1 1
1 2 1
আরেকটা উদাহরণ দেই:-
(a+b)3
=(a+b)(a+b)2
=(a+b)(a2 + 2ab + b2)
=a3 + 2×a2×b + a×b2 + a2 ×b +2×a×b2 + b3
………………………………..
a3+ 3×a2×b +3ab2 +b3
এখানে সহগ গুলো হলো
1 2 1
1 3 3 1
বুঝতে পেরেছিস?
– জি, অনেক মজার জিনিস।
যাদুকরী ত্রিভুজ
এখন দেখি প্যাসকেলের ত্রিভুজের একটা দিক, সম্ভাবনার সাথে প্যাসকেলের ত্রিভুজের একটা সম্পর্ক। প্যাসকেলের ত্রিভুজ আসলে অনেক সুন্দর একটা শিল্পকর্ম! যেমন,
এতোটুকুতেই দেখ, এখানে একটা হকিস্টিকের নকশা আঁকা। তারপর দেখ, যদি হকিস্টিকের হাতলটা ডান দিকে থাকে তাহলে ডান দিকের সব সংখ্যা গুলো যোগ করো তারপর বাঁয়ে মোড় নেও। দেখবে যোগফলগুলো মিলে গেছে। আর হকিস্টিকের হাতল যদি বাম থেকে হয় তাহলে ডানে মোড় নেও। আশ্চর্য, এগুলোও মিলে গেল! (বোঝার সুবিধার জন্য আমি হকিস্টিকের নকশার ভিতর সংখ্যাগুলো লাল রঙে লিখছি)। কিন্তু কেন? এর পিছনের কারণটা তোমরা খোঁজ। আমি একটু ক্লু দেই। এর সাথে পাশাপাশি দুইটা সংখ্যা যোগ করে পরবর্তী সংখ্যা পাওয়ার একটা যোগসূত্র আছে। এটা আমি যেদিন প্রথম “যারা গণিত ভালোবাসে” বইয়ে দেখেছিলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম। আর এর পিছনের কারণ খোঁজার জন্যও চেষ্টা করেছি বহুদিন!
এখন সম্ভাবনার সাথে এর সম্পর্কটা দেখি। যখন আমরা কয়েন টস করি তখন হয়তো হেড আসবে, নাহলে টেল আসবে। এই সম্ভাবনা ১/২। সম্ভাবনা মূলত সংখ্যার মাধ্যমে দেখানো হয়। যার রেঞ্জ থাকে ০-১ এর মধ্যে। একবার কয়েন টস করেলে হেড আর টেল পড়ার সম্ভাবনা সমান। যদি দুইবার টস করি তাহলে যেই ফলাফলগুলো আমরা পাব, সেটা হলো ২বার টেল, ২বার হেড, ১বার হেড অথবা ১বার টেল। তাহলে আমরা যেভাবে ফলগুলো পাব: HH,(HT,TH,),TT। TH আর HT কে ব্রাকেটে দেওয়ার কারণ দুইটা একই জিনিস বোঝায় ১বার হেড যা ১ বার টেলও তা।
আমরা এই ফলাফলগুলোকে (সম্ভাবনার ভাষায় নমুনাক্ষেত্র) তাহলে লিখতে পারি,
২বারই হেড পাব — ১ উপায়ে
১বার হেড অথবা টেল পাব — ২ উপায়ে
২বারই টেল পাব — ১ উপায়ে
এইটাকে ১,২,১ লেখা যায় এটাই প্যাসকেলের ত্রিভুজে দুইয়ের ঘাতের সহগ। দুইবার কয়েন টস করলে এটা পাওয়া যাবে। তিনবার কয়েন টস করলে পাওয়া যাবে, ১,৩,৩,১। কিভাবে এই সম্পর্কটা? এটা হবে, দ্বিপদী রাশির মতো। প্রথম ১ হলো ৩বারই হেড পাওয়ার উপায়। এভাবে একটা করে হেড কমবে আর একটা করে টেল বাড়বে। এভাবে নমুনা ক্ষেত্র পেয়ে গেলে আমরা সম্ভাবনা বের করতে পারি। সেই উপায়টা হলো নমুনাক্ষেত্র গুলো যোগ করে যেইটা আমরা চাই সেটার আর নমুনাক্ষেত্রের অনুপাত।
সম্ভাবনা = যেটা আমরা চাই/নমুনাক্ষেত্রের যোগ ফল
যেমন দুবার টস করলে ১বার হেড অথবা টেল পাওয়ার সম্ভাবনা=২/৪ বা ১/২।
এভাবে প্রায়ই আমরা দ্বিপদী বিস্তৃতী ব্যাবহার করতে পারি! কোন ঘটনাই আসলে ব্যাখ্যাতীত না গাণিতিক এই বিষয়গুলোর মধ্যেও সুন্দর গণিত থাকে। কয়েন টসের ব্যাখ্যাটা হলো–
দ্বিপদী বিস্তৃতী কাজ করে মূলত দুইটা পদের রাশি ও তাদের ঘাত নিয়ে। নিউটনের দ্বিপদী উপপাদ্য ব্যাখার সময় সমাবেশের ঘটনা দেখেছিলাম। (a+b)2 এর ব্যাখাটা হলো দুইটা ঝুড়ি আছে। যাদের মধ্যে আছে a ও b । তাহলে আমি দেখব কিভাবে আর কতভাবে আমি এদের থেকে উপাদান নিয়ে পদ তৈরি করতে পারি। যেমন আমি a2 বা ২ টা a পেতে পারি একবার, ১টা a অথবা ১টা b মানে ab পেতে পারি ২বার, b2 মানে ২টা b পেতে পারি ১ বার। দুইবার কয়েন টস করলে আমরা দুইটা হেড পেতে পারি ১ বার, ১টা হেড অথবা ১টা টেল পেতে পারি ২বার, ২টা টেল পেতে পারি ১ বার। সম্পর্কটা ধরতে পেরেছ? এখানেও ঐ দ্বিপদী উপপাদ্যের মতো সমাবশের খেলা হচ্ছে, একটার ঘাত কমছে অন্যটা বাড়ছে। যেমন প্রথমে দুইটা হেড, তারপর একটা হেড কমল আরেকটা টেল বাড়ল, তারপর দুইটাই টেল। এভাবে নমুনাক্ষেত্র বের করে সম্ভাবনা বের করা যায়।
কিন্তু কেন এই ঘটনাটা ঘটল? এর কারণ হলো দ্বিপদী বিস্তৃতীতে দুইটা পদ নিয়ে কাজ হয়, আর এখানেও দুইটা নমুনাক্ষেত্র তাই সমাবেশের মাধ্যমে সহজে নমুনাক্ষেত্র পাওয়া গেল!
সমস্যাঃ চারবার কয়েন টস করলে কি নমুনাক্ষেত্র পাওয়া যায় সেটা বের করে সেখান থেকে দুইটা হেড আর দুইটা টেল পাওয়ার সম্ভাবনা প্যাসকেলের ত্রিভুজ দিয়ে বের করবেন। (সমাধান করতে পারলে আনন্দ পাবে)
হকিস্টিক পদ্ধতির গণিতটাও বলে দেই, এই যে দেখ আমি ১,৪,১০ পর্যন্ত এসে যখন বামে মোড় নিলাম, পেলাম ১৫ যা ঐ সংখ্যাগুলোর যোগফল। কিন্তু এর কারণ কি? এর কারণ প্যাসকেলের ত্রিভুজের অন্যন্য বৈশিষ্ট্য, পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করে পরের ঘাতের সহগ পাওয়া। আমরা যে ১০ পর্যন্ত এসেছি এগুলো কিন্তু পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করেই। তাই যখন বামে মোড় নিলাম পাওয়া গেল ১৫, এই ১৫ পাওয়া গেল ১০ আর ৫ যোগ করে। যেই ৫ পেয়েছি ১ + ৪ থেকে। তাই ১,৪,১০ পর্যন্ত এসে মোড় নেওয়ার পর পাওয়া ১৫, সেই পাশাপাশি সহগ যোগেরই ফল!
ফটো ক্রেডিটঃ অনামিকা ইসলাম অনামিকা
তথ্যসূত্রঃ-
বইঃ যারা গণিত ভালোবাসে
Leave a Reply