মানুষ পৃথিবীতে এসেছে অপরিমেয় কৌতূহল নিয়ে। সে সবকিছুকে জানতে চায়, সব কিছু চিন্তা ভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে চায়। একারণেই সে অন্যান্য প্রাণীদের অপেক্ষা ভূ-পৃষ্ঠে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসার যোগ্য দাবীদার। নিজের দাদা-দাদির কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে যাবার সময়টাতেও সে তার দাদা-দাদিকে প্রশ্ন করতে ভুলে না, আচ্ছা দাদি/দাদা! সত্যিই কি চাঁদের বুড়ি আছে? সত্যিই কি আকাশ পাড়ি দিয়ে আমরা যেতে পারবো দিগ দিগন্তে? এরকম স্বপ্ন মানুষের বহুদনি আগের। দেখা গেল, মহাশূন্যে প্রথম নভোযানটি পাঠানোর আগে থেকেই মানুষ এলিভেটরের চিন্তা করে বসে আছে। পরবর্তীতে নভোযানের বাস্তবায়ন অনেক আগে হয়ে গেলেও স্পেস এলিভেটরের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।
উপরে হালকা কিছু আলোচনায় স্পেস এলিভেটরের প্রসঙ্গ চলে আসলো। কিন্তু কি এই স্পেস এলিভেটর? এটা খায় না মাথায় নেয়? মূলত মানুষের খাওয়া বা মাথায় দেয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। স্পেস এলিভেটর হচ্ছে একটি আনুভূমিক টাওয়ার যা পৃথিবীর ভূমির সাথে সংযুক্ত থেকে মহাশূন্য পর্ন্ত বিস্তৃত থাকবে। এই টাওয়ার বরাবর ভূমি থেকে মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করা যাবে। এর ফলে প্রচলিত পরিবহন পদ্ধতির রকেটের প্রয়োজন হবে না। বরং ব্যবহৃত হবে এলিভেটরের মতো পুলির ব্যবস্থা যার সাহায্যে ওঠা-নামার কাজটি সম্পন্ন হবে। এ ধরণের অভিযান বাস্তবায়ন করা গেলে মহাশূণ্য অভিযান এখনকার মতো ব্যয়বহুল তো হবেই না বরং প্রচুর অর্থ ও জ্বালানির সাশ্রয় ঘটবে।
স্পেস এলিভেটরের ধারণা :
স্পেস এলিভেটরের ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। তখন সোভিয়েত রকেট বিজ্ঞানী কন্সট্যানটিন সোকোলভস্কি প্রথমবারের মতো কম্প্রেসিভ স্পেস এলিভেটরের ডিজাইনের ধারণা দেন যার উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠ হতে ৩৫৮০০ কিমি।
এ পদ্ধতিতে তৈরি স্পেস এলিভেটর অন্যান্য ভবনের মতো উপর থেকে নিচে চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু এর মধ্যেও একটা সমস্যা হলো : এত সুউচ্চ কাঠামো কর্তৃক যে চাপ প্রয়োগ হবে সেটা ধারণ করার মতো কোন উপাদান পৃথিবীতে নেই। তা থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাও ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না। কারণ মানুষ এখন পর্যন্ত ১০০০ মিটার বা ১ কিমি উঁচু পর্যন্ত কোন স্থাপনা তৈরি করতে পারে নি। হাজার হাজার কিমি স্থাপনা তৈরি তো দুরেই থাক।
টানা কাঠামোর ধারণা :
স্পেস এলিভেটর নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে চলে আসে টানা কাঠামোর ধারণা। এ ধারণানুযায়ী স্পেস এলিভেটর হবে অত্যন্ত নমনীয় যাতে এটি পৃথিবীর উপর চাপ প্রয়োগ না করে। যাতে তার দ্বারা পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের দিকে একটা টান প্রযুক্ত করা যায়। ১৯৬৪ সালের একটি জার্নালে এ সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ হয় । যেমন –
১. এ টাওয়ারটি নমনীয় ফিতা বা তার দিয়ে তেরি করা হবে
২. এটি বিষুব অঞ্চলে স্থাপন করা হবে, যেখানে এটির একপ্রান্ত পৃথিবীর ভূমির সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং অপর প্রান্ত একটি ভারী বস্তুর সাথে সংযুক্ত থাকবে, যা পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে সৃষ্ট কেন্দ্রবিমূখী অভিকর্ষ বলের একটি বিপরীত বল সৃষ্টি করবে। ফলত এই স্থাপনাটি স্থিতিশীল থাকবে। উল্লেখ্য, এই ভারী বস্তুটি এমনভাবে সংযুক্ত করা হবে যাতে এর দ্বারা প্রযুক্ত কেন্দ্রবিমূখী বল পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের তুলনায় বেশি হয়। এ দুটি পরস্পর বিপরীতধর্মী বলের প্রভাবে স্পেস এলিভেটরে এক পক্ষের বলের পরিমাণ হ্রাস পাবে । যার কারণে ফিতাটি ছিড়ে যাবে না। বা ছিড়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
গবেষণা জার্নালে প্রস্তাবনাটি প্রকাশের পর চার আমেরিকান বিজ্ঞানী এটি নিয়ে আরো গবেষণা করেন। অতঃপর তারা একটি সুষম ব্যাসের স্পেস এলিভেটর ডিজাইন করেন। পাশাপাশি তারা এটাও দেখান যে, এ ধরণের এলিভেটর তৈরির বিশ্বের সবচেয়ে দৃঢ় বস্তুর (যেমন : গ্রাফাইট, হীরক ইত্যাদি) এর চেয়ে দ্বিগুণ দৃঢ় বস্তুর প্রয়োজন। সে সময়ে প্রাপ্ত দৃঢ় বস্তুগুলো চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহে এলিভেটর তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিল। কেননা এই উপগ্রহ ও গ্রহের অভিকর্ষ বল পৃথিবীর চেয়ে যথেষ্ট কম। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় স্পেস এলিভেটরের বিভিন্ন মডেল প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শিত হলেও এগুলোর কোনটিই বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য ছিল না।
কার্বন ন্যানোটিউব : এক নতুন আশা ?
নব্বই এর দশকে বিজ্ঞানীরা কার্বন ন্যানোটিউবের উদ্ভাবন করেন, যা স্পেস এলিভেটর নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। এটি পৃথিবীর যেকোন বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এমনকি দৃঢ় ইস্পাতের দড়ির চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি শক্ত। ন্যানোটিউব উদ্ভাবনের পর বিজ্ঞানীরা আবার ডিজাইন নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। এমনকি এ নিয়ে তারা প্রতিযোগিতারও ঘোষণা রাখেন যেমন Elevator 2010 ; যা নাসা কর্তৃক ২০০৫ সালে চালু করা হয় এবং বিজয়ীদের জন্য ৫০ হাজার ডলার অর্থমূল্যের পুরস্কার ঘোষিত হয়। পরবর্তীতৈ প্রতিযোগিতাটি আরো বিস্তৃতি লাভ করে এবং পুরস্কারমূল্য বৃদ্ধি করা হয়। ২০১১ সালে গুগল স্পেস এলিভেটর নির্মাণে গবেষণার ঘোষণা দেয় এবং গবেষণাগারও প্রতিষ্ঠা করে। ২০১২ সালে Obayashi Corporation নামক প্রতিষ্ঠান ২০৫০ সাল নাগাদ এ ন্যানোটিউব ব্যবহার করে নতুন স্পেস এলিভেটর নির্মাণের ঘোষণা দেয়। যা ঘণ্টায় ২০০ কিমি বেগে এর কাঠামো বরাবর চলাচল করবে এবং একবারে ৩০ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
তথ্যসূত্র :
- https://en.wikipedia.org/wiki/Space_elevator
- ফোটন : মহাবিশ্ব, ইমতিয়াজ আহমেদ
Leave a Reply