ভ্রেডাফোর্ট: গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট বৃহত্তম ক্রেটার


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

খালি চোখে চাঁদের দিকে তাকালে চাঁদের পৃষ্ঠে অনেক কালো কালো দাগ দেখা। যায় আসলে এই দাগগুলো অসংখ্য ছোট বড় গর্ত। বাইনোকুলার বা দূরবীন দিয়ে দেখলে আরো পরিস্কার  দেখতে পাবেন। বায়ুমন্ডল না থাকার কারনে প্রতিনিয়ত চাঁদের পৃষ্ঠে ছোট বড় উল্কা এবং গ্রহাণু আঘাত করে। আর এই আঘাতের ফলেই এইসব গর্তের সৃষ্টি হয়। উল্কা বা গ্রহাণু শুধু চাঁদের পৃষ্ঠেই নয়, সৌরজগতের সব গ্রহেই মাঝেমধ্যে আঘাত করে।

শিল্পীর কল্পনায় পৃথিবী পৃষ্ঠে গ্রহাণুর আঘাত।

তবে অন্য গ্রহতে বায়ুমন্ডল থাকার কারনে যদি কোন উল্কা বা গ্রহাণু সেই গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে, তখন বায়ুমন্ডলের সাথে ঘর্ষণের ফলে এইসব মহাজাগতিক বস্তুর তাপ যায় বেড়ে, আগুন জ্বলে উঠে এবং বেশীরভাগই বায়ুমন্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদি উল্কা বা গ্রহাণুর আকার বেশ বড় হয় তবে বায়ুমন্ডল এদের শরীরের সবটুকু পুড়িয়ে ছাই করতে পারে না। তখন এর বাকী অংশ গ্রহের পৃষ্ঠে আঘাত করে। এই আঘাতের শক্তি কিন্তু পারমাণবিক বোমার মত শক্তিশালী বা তার থেকেও বেশী। এর আঘাতের ফলে সৃস্ট অনেক বড় গর্ত আছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। প্রায় দুই বিলিয়ন বছর আগে, কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু পৃথিবী পৃষ্ঠে  আঘাত করেছিল। এই আঘাতটি যেখানে হয়েছিলো তা এখন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ। এই জোহানেসবার্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে এইরকম একটি গর্ত আছে। দক্ষিন আফ্রিকার জোহানেসবার্গের প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ফ্রি স্টেট প্রদেশে এর নাম ভ্রেডাফোর্ট ডোম। এর কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত ভ্রেডাফোর্ট শহর থেকে এই নামটি এসেছে। 

২৭ শে জুন ২০১৮ সালে ল্যান্ডস্যাট ৮ স্যাটেলাইটের তোলা ভ্রেডাফোর্ট ডোম।

এটি একটি বিশাল কাঠামো যা গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট। এটি পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ইমপ্যাক্ট ক্রেটার হিসেবে বিবেচিত। যা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে প্রাচীনতম গর্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত এবং সবচেয়ে জটিল উল্কাপিণ্ডের কাঠামো। ভ্রেডাফোর্ট গর্তটি ২.০২৩ বিলিয়ন বছরের বেশি বলে অনুমান করা হয়। এটি পৃথিবীর  প্রাচীনতম অ্যাস্ট্রোব্লেমি (উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতে নির্মিত বৃহৎকার গর্ত)। এবং এটি পৃথিবীর একমাত্র গর্ত যা আমাদের মেঝের নীচে একটি অ্যাস্ট্রোব্লেমির সম্পূর্ণ ভৌগলিক প্রোফাইল সরবরাহ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকার মানচিত্রে ভ্রেডফোর্ট গম্বুজের অবস্থান দেখাচ্ছে।

এটি ১০ থেকে ১৫ কি.মি. প্রশস্ত একটি গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গভীর একটি কাঠামো। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে যেই গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো এই উল্কাটি আকারে তার দ্বিগুণ। এই বিস্ফোরণটি যদি আজ হতো, তবে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জীবিত প্রাণী মারা যেতো। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক শক্তি প্রকাশের সাক্ষ্য বহন করছে। মূল ভ্রেডফোর্ট ক্রেটারটির আনুমানিক ১৮০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার ব্যাসের ছিলো, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন এর সঠিক আকার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

ল্যান্ডস্যাট ৮ থেকে তোলা ভ্রেডাফোর্ট ডোম।

রজার উইটওয়াটারসরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব প্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞ গিবসনের মতে, আঘাতের কেন্দ্রে এর প্রভাবের উত্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল যে পৃথিবীর ভূত্বকের ২৫-কিলোমিটার অংশ শেষ হয়ে গেছে। উত্থিত শিলার বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে যা আজ দৃশ্যমান এককেন্দ্রিক প্যাটার্ন তৈরি করেছে। পৃথিবীর পৃষ্ঠে গঠিত বেশিরভাগ গর্তের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। কারণ পৃথিবীর পৃষ্ঠ আংশিকভাবে জল দ্বারা আচ্ছাদিত, এবং সেইজন্য গর্তগুলি বেশিরভাগই ক্ষয় হয়েছিল বা পরবর্তী পলি জমার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়েছিল। বর্তমানে যে কাঠামোগুলি অবশিষ্ট থাকে তা সাধারণত “ভ্রেডেফোর্ট ডোম” নামে পরিচিত। সেগুলি এখন একটি কেন্দ্রীভূত রিং সিস্টেম নিয়ে গঠিত। গবেষণার বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে ভ্রেডাফোর্ট গঠনটি একটি কেন্দ্রীয় কোর নিয়ে গঠিত, যা প্রধানত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার ব্যাসের গ্র‍্যানিটিক গেনিস ভূখণ্ড দ্বারা গঠিত।

 গ্র‍্যানিটিক গেনিস ভূখণ্ড।

এই গর্তটি তৈরি করা গ্রহাণুটির আকার ছিলো প্রায় ১০ থেকে ১৫ কি.মি.। এটি প্রতি সেকেন্ডে ১১ থেকে ৭২ কিলোমিটার গতিতে ভূপৃষ্ঠে  আঘাত করে। এই আঘাতে হাজার মেঘাটন শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়। এই রকম একটি আঘাতের প্রভাবে প্রায় ৭০ ঘন কিলোমিটার শিলা বাষ্প হয়ে যাবে। প্রভাব থেকে তৈরী তাপ পৃথিবীর ভূত্বক গলে একটি ম্যাগমা হ্রদ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। বেশিরভাগ ইমপ্যাক্ট ক্রেটারের রিম এবং মেঝে উত্থাপিত হয়। যা সাধারণত তার আশেপাশের পরিবেশের তুলনায় উচ্চতায় কম থাকে। ডেটাবেস অনুসারে, পৃথিবীতে এই রকম মোট ১৯০টি গর্ত রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ইমপ্যাক্ট ক্রেটার দুটি প্রক্রিয়ার যে কোনো একটির কারণে ঘটেছিল। পৃথিবীর সাথে বৃহৎ গ্রহাণুর টুকরো নিয়ে গঠিত উল্কার সংঘর্ষ, অথবা পৃথিবীর সাথে ধূমকেতুর সংঘর্ষ (ধুলো কণা, বরফ এবং পাথুরে টুকরো নিয়ে গঠিত)।

 বিশ্বে আঘাতের ফলে সৃষ্ঠ এই রকম সম্ভাব্য প্রায় ১৯০টি গর্তের কাঠামো রয়েছে। ভ্রেডফোর্ট গম্বুজ (ছবিতে) শীর্ষ তিনটির মধ্যে রয়েছে এবং এটি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উল্কাপিণ্ডের আঘাতের স্থান।

ভ্রেডাফোর্ট নিয়ে বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করার আশা করছেন এবং আশা করি ভ্রেডফোর্ট ক্রেটার গঠনের আশেপাশের ঘটনাগুলি সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করবেন। এটি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের প্রমাণ সরবরাহ করে যা গ্রহের বিবর্তন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের উন্মুক্ত ভূত্বক পৃথিবীতে অবিশ্বাস্যভাবে বিরল, শিলাগুলি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিস্তৃত প্রায় অবিচ্ছিন্ন রেকর্ড সংরক্ষণ করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো ভ্রেডাফোর্টকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 116-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading