কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোন কাজে লাগে?

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

কোয়ান্টাম মেকানিক্স শব্দটি অনেকে হয়তো শুনেছেন। কেউ কেউ হয়ত কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হিসেবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন। বিজ্ঞানের সবচেয়ে উদ্ভট সব ঘটনার কথা বলে এই কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে একটি বস্তুকে আপনি যদি দেয়ালে নিক্ষেপ করেন তাহলে তা দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আরও বলে বাক্সের ভিতরে রাখা একটি বিড়াল যাকে আমরা বাইরে থেকে দেখতে পারছি না তা একই সাথে জীবিত আবার মৃত অবস্থায় আছে। এসব উদ্ভট ধারণাগুলো আমাদের কমনসেন্স বিরোধী। একারণেই হয়তো আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে জানতে বেশ আগ্রহ অনুভব করি। তবে এখানে একটি শর্ত আছে। যেই বস্তুটি নিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স খাটাচ্ছি, সেই বস্তুটির আকার হতে হবে খুবই ক্ষুদ্র পারমাণবিক কণার আকারের মতো।

আলবার্ট আইনস্টাইন

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এতোটাই উদ্ভট যে এর অন্যতম একজন আবিষ্কারক আলবার্ট আইনস্টাইন নিজেই বলেছিলেন,

“কোয়ান্টাম মেকানিক্স যত বেশি সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে, এটি ততই অবাস্তব মনে হচ্ছে।”

কোয়ান্টাম মেকানিক্স উদ্ভট হলেও এর রয়েছে অনেক বাস্তবিক প্রয়োগ। আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও আপনাকে মেনে নিতেই হবে, এই আপাত দৃষ্টিতে দেখতে অবাস্তব ঘটনাগুলোর উপরেই দাড়িয়ে রয়েছে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্ব। সিলিকন চিপ থেকে ক্যানসার রোগ শনাক্তকরণে রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহার। এমনকি আপনি এখন যেই স্ক্রিনে এই লেখাটি পড়ছেন সেই স্কিনও তৈরি করা হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি মতেই। এখানে ছয়টি ইন্টারেস্টিং ও বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে তৈরি করা যন্ত্রের ব্যপারে কথা বলব।

পাখির কোয়ান্টাম কম্পাস

আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন বা দেখে থাকবেন যে একদেশ থেকে আরেকদেশে পাখিরা ভ্রমণ করে। এধরনের পাখিকে পরিযায়ী পাখি বলে। গাঙচিল নামক পরিযায়ী পাখি শীতকালের দিকে বাংলাদেশে আসে। শীতকাল শেষ হলে আবার তার পূর্বের দেশে ফিরে যায়। কখনও ভেবেছেন কি তারা কীভাবে তাদের পথ চিনে? তাদের কাছে তো কোনো ম্যাপ নেই? তারা কী হারিয়ে যেতে পারে? এর উত্তর আছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স মতে এধরনের পাখিদের চোখে বিশেষ ধরণের একটি সেন্সর রয়েছে যার সাহায্যে এরা পৃথিবীর চুম্বক-ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে। [১] ফলে এরা পৃথিবীর ঠিক কোন প্রান্তে রয়েছে ও কোথায় যেতে হবে তা অনুভব করতে পারে। এসবই সম্ভব হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে।

ইউরোপিয়ান রবিন পথ চলার সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে। সূত্র – ScienceAlert

ট্রানজিস্টার

বর্তমানের প্রায় সকল যন্ত্রপাতিগুলোতে ট্রানজিস্টার ব্যবহার করা হয়। আজকাল বিশালাকার কম্পিউটার মনিটর চিকন ল্যাপটপ হয়ে গেছে। এই যুগে মোটাসোটা টেলিফোন রূপ নিয়েছে ছোট ও চিকন আকৃতির স্মার্টফোনে। এর এসবই সম্ভব হয়েছে ট্রানজিস্টারের কারণে। ট্রানজিস্টারের কাজকর্ম ব্যাখ্যা করতে ব্যান্ড তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। এই ব্যান্ড তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ট্রানজিস্টারের দুইপ্রান্তে বিভব পার্থক্য থাকলে এদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে (ডিপ্লেশন লেয়ার) কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে ইলেকট্রন তার জায়গা বদল করে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলে যায়। [২] সুতরাং আমাদের বর্তমান ইলেকট্রনিক্সের জগৎ ঘিরেই রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।

ট্রানজিস্টার আবিষ্কারের ফলে আমাদের প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটে। সূত্র – https://www.tme.eu/

লেজার

LASER (Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation) হলো একটি এমন যন্ত্র যা সুসংগত ও উচ্চ শক্তিসম্পন্ন আলো নির্গত করতে সক্ষম। এই লেজার টেকনোলজির ভিত্তিও হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আপনি কোনো একটি শপিংমলে গেলে আজকাল খাতায় লিখে লিখে কোনো দোকানী হিসাব করে না। তার কাছে একটি যন্ত্র থাকে যাকে বলে বারকোড রিডার আর আপনার কিনতে চাওয়া পন্যের গায়ে লাগানো থাকে একটি বারকোড। ওই যন্ত্রটিকে বারকোডের উপরে ধরলে সেখান থেকে একটি লেজার বের হয় ও আপনার বারকোডে থাকা গোপন কোড পড়ে ফেলে ও কম্পিউটারে সেই অনুযায়ী দাম শো করে। আজকাল নানা সার্জারিতেও লেজারের এই শক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিভিডি ও ব্লু-রেতেও ব্যবহার হচ্ছে লেজারের নীতি। বড়ো-সরো কাঁচ কিংবা পাথর কাটতেও ব্যবহার হচ্ছে এই লেজার টেকনোলজি। ২০১৭ সালে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা হয় তার নেপথ্যেও কাজ করেছে এই লেজার টেকনোলজি। [৩] লেজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে।

লেজারের সাহায্যে ক্যানসার কোষ ধ্বংস, চোখের অপারেশনসহ আরো নানা কাজ করা হয়। সূত্র – www.wikimedia.org

কোয়ান্টাম-কম্পিউটার

আজকাল আমাদের অনেককিছুই হিসাব-নিকাশ করতে হয়। কখনো কখনো এই হিসাব-নিকাশ করতে কয়েক মাস লেগে যায়। তবে এমন কিছু হিসাব রয়েছে যেগুলো করতে হয়তো কয়েক হাজার বছর লেগে যাবে। তা বসে বসে হিসাব করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। তাই এমন ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করতে হবে তাআরো দ্রুততার সাথে এই হিসাব করতে সক্ষম। এই ধরণের ক্যালকুলেটরই হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এটি কয়েক মিলিয়ন বছরের হিসাব কয়েক বছরে করে দিতে সক্ষম আর কয়েক বছরের হিসাব কয়েক দিনে করে ফেলতে সক্ষম। এই কোয়ান্টাম-কম্পিউটার নিজেই কোয়ান্টাম সুপারপজিশন নীতির সাহায্যে কাজ করে। ইতিমধ্যেই গুগল সিকামোর নামে এমনই একটি কোয়ান্টাম প্রসেসর আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। সাধারণ কম্পিউটারে ১০০০০ বছর সময় লাগবে এমন সমস্যা সিকামোরের সাহায্যে ২০০ সেকেন্ডেই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। [৪] হয়তো নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সকলের হাতেই থাকবে একটি করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও বদলে দিবে আমাদের জগত দেখার দৃষ্টিভঙ্গী।

গুগলের সিকামোর প্রসেসরের সাহায্যে কয়েক হাজার বছরের হিসাব কয়েক সেকেন্ডে করে ফেলা যায়। সূত্র – beartai.com

সুপারকন্ডাক্টর ও ম্যাগনেটিক ট্রেন

একটি পরিবাহী তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করতে তারের রোধ ধর্মের কারণে একসময় ওই বিদ্যুৎ থেমে যাবে আর তার উত্তপ্ত হয়ে যাবে। এতে প্রচুর পাওয়া লস হয়। সাধারণভাবে ওহমের সূত্র আমাদের এটিই বলে। তবে ১৯১১ সালে হেনরি কেমারলিন ওনস নামের একজন বিজ্ঞানী দেখান এমন কিছু পদার্থ আছে যাদেরকে আমরা তাদের সংকট তাপমাত্রায় শীতল করলে তাদের মধ্যে আর রোধ থাকে না। অর্থাৎ এটিতে কোনো পাওয়ার লস হয় না। ফলে একটি ইলেকট্রিক সার্কিটের কর্মদক্ষতা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০০%। একে বলে সুপারকন্ডাক্টর। এই সুপারকন্ডাক্টরের ধর্ম ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও চলে আসে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। বর্তমানে সুপারকন্ডাক্টরের সাহায্যেই দ্রুতগ্রামী ট্রেন বানাচ্ছে উন্নত বিশ্বের নানা দেশ। চীনের সাংহাইতে ইতিমধ্যেই এমন একটি ট্রেন পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। [৫]

কোয়ান্টাম মাইক্রোস্কোপ

২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের একদল গবেষক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অ্যানটেঙ্গেলমেন্টের নীতি কাজে লাগিয়ে একটি মাইক্রোস্কোপ বানান। [৬] এই মাইক্রোস্কোপ অন্য যেকোনো মাইক্রোস্কোপের তুলনায় অধিক বিবর্ধিত করে বস্তু দেখতে সক্ষম। ১৭ শতকে সাধারণ মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার হলে তা জীববিজ্ঞানের গবেষণায় বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়। এই কোয়ান্টাম মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের ফলে জীববিজ্ঞানের আরো গভীর রহস্যগুলো খতিয়ে দেখা যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

কোয়ান্টাম মাইক্রোস্কোপের বদৌলতে বদলে যেতে পারে জীবদের আরো ভালোভাবে দেখার অভিজ্ঞতা। সূত্র – ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড।

এছাড়াও আরো বহু ব্যবহার রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। তবে লেখার কলেবর বড় হওয়ার আশঙ্কার তা আর উল্লেখ করলাম না।

তথ্যসূত্র

লেখাটি 1,115-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers