আ মরা সবাই-ই অ্যালার্জি শব্দটির সাথে কমবেশি পরিচিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫% এবং বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ৫০% মানুষ বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জিজনিত ব্যাধিতে ভুগছে ।
অ্যালার্জি কখন হয় ও কিভাবে?
আমাদের সবার দেহেই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রোগ-জীবাণু কিংবা পরিবেশের অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থের হাত থেকে আমাদের দেহকে রক্ষা করে। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি অধিকাংশ লোকের জন্যে ক্ষতিকারক নয় এমন কিছু পদার্থের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই ধরণের প্রতিক্রিয়াকেই অ্যালার্জি বলা হয়।
সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক এর প্রতি মানুষের অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই পদার্থগুলি অ্যালার্জেন হিসেবে পরিচিত। এরা বেশিরভাগই মূলত প্রোটিন। আমাদের শরীর এই প্রোটিনগুলোকে শরীরের জন্য ক্ষতিকর ভাবে। তখন শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে বিশেষায়িত আন্টিবডি (IgE ) তৈরি করে। IgE অ্যান্টিবডিগুলি আমাদের ত্বকে বসবাসকারী মাস্ট কোষের (অ্যালার্জি কোষ) সাথে আবদ্ধ হয়। মাস্ট কোষও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার একটি অংশ যা দেহের সকল সংযোজক কলায় থাকে। IgE অ্যান্টিবডিগুলি শরীরে অ্যালার্জেন খুঁজে বের করে এবং মাস্ট কোষে নিয়ে গিয়ে তাদের অপসারণ করতে সাহায্য করে। তখন মাস্ট কোষ থেকে হিস্টামিন নিঃসৃত হয়। হিস্টামিন হলো এক ধরণের জৈব রাসায়নিক যা অ্যালার্জির লক্ষণগুলির মূল কারণ।
ভিন্ন ভিন্ন অ্যালার্জেন এর প্রভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত যেসব মানুষের কোনো নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনের প্রতি অ্যাটোপিক বা হাইপারসেনসিটিভি ডিসঅর্ডার আছে, ঐ অ্যালার্জেনের উপস্থিতিতে তাদের অ্যালার্জিক প্রতিক্রয়া দেখা দেয়।
অনেক সময় কোন নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়টা বংশগত হয়ে থাকে। এইক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়ের বা একজনের যদি যে কোনো নির্দিষ্ট খাবার, ঔষূধ, ইনহেল্যান্ট (ধূলাবালি, পরাগ) বা ল্যাটেক্স পণ্য ইত্যাদিতে অ্যালার্জি থাকে, তাদের সন্তানদের মধ্যেও ঐ একই ধরনের অ্যালার্জেনের প্রতি আলার্জি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই বিষয়টাই অ্যাটোপি হিসেবে পরিচিত। তবে অ্যালার্জি ছোঁয়াচে বা সংক্রামক নয় ।
অ্যালার্জির প্রকারভেদঃ
যে ধরণের অ্যালার্জি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়ঃ
- খাদ্য অ্যালার্জি
- ইনহেল্যান্ট এলার্জি
- ওষুধ অ্যালার্জি
- ল্যাটেক্স অ্যালার্জি
- বিষজনিত অ্যালার্জি
অ্যালার্জির লক্ষণসমূহঃ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাদ্য অ্যালার্জির মধ্যে রয়েছে দুধ, ডিম, গম, সয়া, সামুদ্রিক খাবার এবং চিনাবাদামের অ্যালার্জি। এছাড়া আমাদের দেশে অনেকের ইলিশ মাছ, বেগুন, চিংড়ি মাছ ও নারিকেল ইত্যাদি খাবারে অ্যালার্জি দেখা যায়। এসব খাবার গ্রহণের ৩০ মিনিটের মধ্যে অ্যালার্জির উপসর্গগুলো দেখা দিতে শুরু করে। যেমন সারা শরীরে চুলকানি কিংবা শরীরের মাত্র একটি নির্দিষ্ট অংশে চুলকানি, বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া, আমবাত (Hives বা আমবাত এমন একটা অবস্থা যখন ত্বক বেপরোয়া ও তীব্রভাবে অনবরত চু্লকাতে থাকে) এবং গলা, জিহ্বা বা মুখসহ মুখের চারপাশে ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
ইনহেল্যান্ট এলার্জি হয় যখন বায়ুবাহিত পদার্থ বা অ্যালার্জেন শ্বাস নেওয়ার মধ্যমে দেহে প্রবেশ করে ।এদের কোনটা দীর্ঘ সময়ের জন্যে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। যেমন পোষা প্রাণীর পশম, ত্বক (খুশকি), প্রস্রাব, লালা, ডাস্ট মাইট বা ছোট মাকড়সা, তেলাপোকার মল, থুতু, ডিম এবং মৃতদেহের অংশে থাকা প্রোটিন, মোল্ড ইত্যাদি। কোনটা নির্দিষ্ট সময়ে বাতাসে থাকে। এদের বলা হয় মৌসুমী অ্যালার্জেন। যেমন ফুলের পরাগ। ইনহেল্যান্ট অ্যালার্জির লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে: সর্দি, নাক বন্ধ, নাক চুলকানো, হাঁচি, চোখ চুলকানো, নাক ও চোখ দিয়ে পানি পরা, চোখ লাল হওয়া ইত্যাদি । যদি কারো হাঁপানি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়।
কিছু ওষুধও অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs), ইনসুলিন, কেমোথেরাপির ওষুধ উল্লেখযোগ্য। এই ধরণের অ্যালার্জির উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে: ফুসকুড়ি, আমবাত, চুলকানি, দুর্বল নিঃশ্বাস, ফুলে যাওয়া, প্রদাহ ইত্যাদি ।
প্রাকৃতিক রাবারের ল্যাটেক্সের সংস্পর্শে এলে ল্যাটেক্স এলার্জি হয়। রাবারের ল্যাটেক্স থেকে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য যেমন রাবার গ্লাভস, বেলুন, কনডম, ব্যান্ডেজ, রাবার বল ইত্যাদি। ল্যাটেক্স অ্যালার্জির সবচেয়ে সাধারণ প্রতিক্রিয়া হল ত্বক জ্বালা করা (কন্টা্ক্ট ডার্মাটাইটিস)। ত্বকের যে অংশে ল্যাটেক্স স্পর্শ করেছে সেখানে ফুসকুড়ি দেখা যায়। অন্যান্য উপসর্গগুলো হচ্ছে : আমবাত, সর্দি, নাক চুলকানো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ফুলে যাওয়া ।
বিভিন্ন পোকামাকড়ের বিষেও অ্যালার্জেন থাকে। দংশনের মাধ্যমে সেগুলো আমাদের দেহে প্রবেশ করতে পারে। এসব পোকামাকড়ের মধ্যে আছে মৌমাছি, বিষ পিঁপড়া, ভীমরুল, বোলতা প্রভৃতি। এদের কামড়ের ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, আমবাত, মুখ বা গলা ফুলে যাওয়া, ঘ্রাণ নেওয়া ও গিলতে অসুবিধা হওয়া, পালসরেট বৃদ্ধি পাওয়া ও মাথা ঘোরা সহ রক্তচাপ কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হয় ।
অ্যালার্জি প্রতিরোধে করনীয়ঃ
বেশিরভাগ অ্যালার্জির ক্ষেত্রেই হালকা থেকে মাঝারি প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যা বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। তবে অল্প সংখ্যক লোক অ্যানাফিল্যাক্সিস নামে একটি গুরুতর অ্যালার্জির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অবিলম্বে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রয়োজন হয় ।
অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদে থাকতে সর্বদা অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। যে ধরনের অ্যালার্জেন অ্যালার্জি ঘটাচ্ছে তা এড়িয়ে চলতে হবে। যেসব খাবার খেলে অ্যালার্জি হয় তা কোনোমতেই খাওয়া যাবে না, যাদের ইনহেল্যান্ট অ্যালার্জিভুক্ত তারা ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য মাক্স পরিধান করা, যেখানে ঐ অ্যালার্জেন থাকতে পারে সেসব জায়গা এড়িয়ে চলা। এছাড়া, প্রয়োজন মতো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদে থাকা সম্ভব ।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply