বাস্তব ও চিন্তা জগতের ভিতরবাহিরের সকল সংখ্যা নিয়েই জটিল সংখ্যার সেট। এই সেটে সংখ্যা জগতের সকল সংখ্যাই উপস্থিত। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমরা কিন্তু ছোটো থেকেই জটিল সংখ্যার যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ এই অপারেশনগুলো করে এসেছি!
জটিল সংখ্যা সম্পর্কে কেন জানতে হবে? বাস্তবিক জীবনে জটিল সংখ্যার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানে জটিল সংখ্যা পৌঁছে গেছে অনন্য মাত্রায়। যদিও পূর্বে ধারণা ছিল, জটিল সংখ্যা মানেই কল্পনা। কিন্তু বর্তমানে বাস্তব জীবনের জন্য এই সংখ্যার গুরুত্ব অকল্পনীয়। কল্পনা থেকে সূচনা হলেও গণিতবিদদের হাতে চলে এসেছে এর প্রায়োগিক দিক। সিগন্যাল প্রসেসিং, কন্ট্রোল থিওরি, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, ফ্রুইড ডাইনামিকস, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সসহ আরো নানা ক্ষেত্রে জটিল সংখ্যা ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই সাথে গণিতজগতেও হয়ে উঠছে ভালোবাসার মধ্যমণি।
‘জটিল সংখ্যার সমাধান’ বইটি পাঠের মাধ্যমে একজন পাঠক উপলব্ধি করতে পারবে কেন জটিল সংখ্যার বিভিন্ন অপারেশন শিখতে হবে, জানতে হবে, অপারেশনের ফলে কেন এমন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়।
বইটি মোট আটটি অনুচ্ছেদে রচিত, যেখানে জটিল সংখ্যার ইতিহাস ও পরিচয় থেকে শুরু করে এর বীজগাণিতিক ও জ্যামিতিক ব্যাখ্যা, ত্রিকোণমিতিক সম্পর্ক, ভেক্টর ও স্থিতিবিদ্যার আলোকে জটিল সংখ্যার আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
জটিল সংখ্যার ইতিহাস পাঠ করার সময় মনে হয়েছে আমি যেন রূপকথার গল্পের কোনো বই পড়ছি। লেখক সাহেব এমনভাবে তাঁর লেখনশৈলী উপস্থাপন করেছেন, “জটিল সংখ্যা” যেন বাংলা সাহিত্যেরই সম্পদ। জটিল সংখ্যাকে রূপ-রসে আকর্ষণীয় করে বুঝিয়ে দিয়েছেন গণিতের কত সৌন্দর্য, কত মাধুরি। এই অনুচ্ছেদটি এটারও ইঙ্গিত দেয়, যে বইটি কতটা ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে।
জটিল সংখ্যার বীজগণিত অনুচ্ছেদে এসে জটিল সংখ্যার পরিচয়, যোগবিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং i-এর ঘাত বের করা অত্যন্ত কৌশলের সাথে উপস্থাপন করেছেন, যেন আমি ক্লাসে বসেই শিখছি।
বইয়ের একটা ইন্টারেস্টিং চ্যাপ্টারের নাম হলো ‘প্রিয়তমার চোখে জটিল সংখ্যা’। এখানে i এর জ্যামিতিক মিনিং, মডুলাস আসলে কী, জটিল সংখ্যার যোগ ও বিয়োগ প্রকৃত ভাবে কী মিন করে ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেন সবসময় অনুভবেই আছে।
এরপরই উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন সমস্যার সহজ ও সাবলীল সমাধানের কৌশল উপস্থাপন খুবই চমৎকার হয়েছে। এখানে লেখক সাহেব একটি সমস্যাকে একাধিক উপায়ে সমাধান করার মজার মজার টেকনিক দেখিয়েছেন। যেমন: জটিল সংখ্যার বর্গমূল বের করার সহজ সূত্র, যা দিয়ে খুব দ্রুত বর্গমূল বের করা সম্ভব। চোখের পলকে ঘনমূল বের করার অভিনব কৌশল, যা আমার জন্য খুবই কার্যকর ছিল। এছাড়াও চতুর্থমূল ও ষষ্ঠমূল বের করার সহজ ব্যাকরণও এ অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়।
ত্রিকোণমিতির সাগরে জটিল সংখ্যার স্রোত” শিরোনামের অনুচ্ছেদটিও লেখক সাহেব হৃদয়ে (মূলত মস্তিষ্কে) গেঁথে থাকার মতো করে রচনা করেছেন। রেখেছেন কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ও পোলার স্থানাঙ্কর মধ্যকার রিলেশন, আর্গুমেন্টের বিস্তারিত আলোচনা, জটিল সংখ্যার পোলার আকার, দুটি জটিল সংখ্যার গুণ-ভাগ ও গুণ-ভাগ দ্বারা আসলে কী মিন করে, De Moivre এর সূত্রর মতো সুস্বাদু টপিকগুলো। এগুলো যখন অনুভবে চলে আসে তখন আর সময়-জ্ঞান থাকে না। বুঝা যায় গণিত কত মজার, কত মধুর। এজন্যই হয়তো এত এত গণিতবিদ সারাজীবন গণিত নিয়ে ব্যয় করতে পেরেছিলেন।
ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে রয়েছে “পৃথিবীর সুন্দরতম সমীকরণ” আর এই সমীকরণে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে অন্যতম বিভ্রান্ত সংখ্যা e, গণিতবিদদের খুব আদরের সংখ্যা π ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল্পনিক সংখ্যা i. এছাড়াও এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে, cosX এর মান [-1,1] এর বাইরে হওয়া কীভাবে সম্ভব, lnx এর ডোমেন ঋণাত্মক হতে পারে কি-না, ¡^i এর মান কেন বাস্তব সংখ্যা হয় ইত্যাদির মতো ইন্টারেস্টিং টপিক।
সপ্তম অনুচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে জটিল সংখ্যা ও স্থিতিবিদ্যার নিপুণ রহস্য আর নিবিড় সম্পর্কের কথা।
সবশেষে বিখ্যাত গণিতবিদদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে আলোচনা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত হলেও বেশ ইন্টারেস্টিং ও অজানা তথ্য এখানে রাখা করা হয়েছে।
সমালোচনা: বইয়ে আলোচনাগুলো সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, আরেকটু বিস্তারিত করলে ভালো হতো। তাছাড়া বাংলা বানানে সামান্য ত্রুটি বা ভুল লক্ষ্যণীয় হয়েছে।
জটিল সংখ্যার সমাধান’ হলো জটিল সংখ্যা নিয়ে লেখা বাংলা ভাষায় রচিত অত্যন্ত চমৎকার একটি বই। জটিল সংখ্যা নিয়ে যাদের জানার আগ্রহ আছে আমার বিশ্বাস বইটি তাদের খুব কাজে দিবে। আর বইটি গণিত প্রেমী সকলের কাছেও প্রিয় হওয়ার যোগ্য মনে করি।
পরিশেষে, লেখক সাহেবের জন্য অফুরান ভালোবাসা ও নিরন্তর শুভকামনা।
বইয়ের নাম: জটিল সংখ্যার সমাধান
লেখক: মোকাদ্দেস উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশক: কারুবাক
রেটিং: বেশ ভালো
Leave a Reply