আমরা আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান জগতের প্রাণি কিংবা উদ্ভিদ সম্বন্ধে কমবেশি জানলেও না-দেখা ক্ষুদ্র জগতের বাসিন্দাদের নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। এই ক্ষুদ্র জগতকে আমরা নাম দিয়েছি অণুজীব জগৎ; আর এই জগতের অন্যতম মহারথী হলো ভাইরাস। মজার ব্যাপার, অন্যান্য অণুজীবেরা যে অন্তত ‘জীব’ এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেও ভাইরাস জীব, না-কি জড় সে বিষয়ে তারা ঐক্যমতে আসতে পারেন নি। শেষমেশ তারা হার মেনেছেন এই বলে যে জীবও নয়-জড়বস্তুও নয়, ভাইরাসকে ভাইরাস-ই বলতে হবে। ভাইরাসের বিস্ময় এখানেই শেষ নয়, আমাদের দেখা-জানা অধিকাংশ জীবের উৎপত্তির আগে থেকে এরা পৃথিবীতে আছে।
অবশ্য শুধু ‘পৃথিবীতে আছে’ বললে ঠিক এর মর্যাদা দেওয়া হয় না; খনিজ স্ফটিক থেকে অন্ত্র-ফুসফুস, সাহারার বালি থেকে অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে বহমান হ্রদ, প্রশান্তের তলদেশ থেকে বিসুভিয়াসের অভ্যন্তর—কোথায় নেই এরা! নানারকম রোগ সৃষ্টিতে এদের ভূমিকা সবার জানা; তবে এ কথা বোধহয় সবার জানা নয় যে, আমরা যে বেঁচে-বর্তে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছি,তার পেছনেও এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আরও আশ্চর্যের কথা আমরা আমাদের জিনোমেই এদের অনেককে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এই ভাইরাসগুলোর কোনোটি আমাদের সাথে আছে আদি স্তন্যপায়ীদের থেকে, কোনোটিবা আদি হোমিনিড-পূর্বপুরুষের সময় থেকে। এমনকি যেখানে আমাদের ডিএনএ’র মাত্র ১.২ শতাংশকে ‘কোডিং রিজিওন’ (প্রোটিন তৈরি করতে পারে যে অংশটুক) বলে গণ্য করা হয়, সেখানে তার ৮ শতাংশই ভাইরাসের জিন দিয়ে ভর্তি!
এহেন ভাইরাস সম্বন্ধে আমজনতাকে অবহিত করার গুরুভার কাঁধে নিয়ে ইয়েল ইউনিভার্সিটির আণবিক জীবপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমার রচনা করেন ‘A Planet of Viruses’। বইটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। কার্ল জিমার সেই বিরলপ্রজ লেখকদের একজন যারা সাবলীল ভাষায় বিজ্ঞানের জটিলতম বিষয়গুলো নিয়ে অনায়াসে আলোচনা করতে পারেন। আলোচ্য ছোট্ট বইটির আলোচনায় ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিলো, ‘জিমার একশো পাতায় যা গুছিয়ে বলছেন, অন্যরা পাঁচশো পাতায়ও তা আবিষ্কার করতে পারবেন না।’ জিমার-প্রণীত সেই বিখ্যাত বইটির তর্জমা ‘ভাইরাসের পৃথিবী’ বইটি। তর্জমাকার সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ একজন তরুণ বিজ্ঞান লেখক ও অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র।
মোট বারোটি অধ্যায়ে সাজানো হয়েছে বইটি; আলোচনা করা হয়েছে গোটাদশ রকমের ভাইরাস নিয়ে । ভাইরাস সম্বন্ধে যে-শুধু আমরাই কম জানি তা নয়, আমাদের যারা জানান-সেই নমস্য বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন ভাইরাস সম্পর্কে তাদের জ্ঞান’ও খুব বেশি নয়, প্রতিনিয়তই তারা গবেষণা করে নিত্যনতুন তত্ত্ব-তথ্য-সত্য হাজির করছেন আমাদের সামনে। তাদের এই অভিযাত্রা শুরু হয় নেদারল্যান্ডসে তামাক-পাতায় আক্রমণকারী টোবাকো মোজাইক ভাইরাস আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এর মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা প্রথম ভাইরাসের অবস্থান, গতিবিধি, আকার-প্রকার অনুসন্ধান করে রায় দিলেন আমরা একরকম ভাইরাস-সাগরেই ডুবে আছি! বইটির প্রথম অধ্যায় ‘ছোঁয়াচে প্রাণরস : টোবাকো মোজাইক ভাইরাস এবং ভাইরাস জগতের আবিষ্কার’ সাজানো হয়েছে সেই গল্প দিয়েই। এরপর যথাক্রমে আছে আমাদের সাংবৎসরিক সর্দিজ্বরের জন্য দায়ী অবধ্য রাইনো ভাইরাস, হাঁচিকাশির জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং নানারকম প্রাণঘাতী ক্যানসারের কারণ প্যাপিলোমা ভাইরাসের কথা।
আজকের দিনে বিজ্ঞানী-চিকিৎসক-জনস্বাস্থ্যবিদ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সকলের মুখেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার কথা জোরেসোরে শোনা যাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে সংক্রামক ব্যাকটেরিয়াগুলো হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য, বিজ্ঞানের ভাষায়—’সুপারবাগ’। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই সুপারবাগের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে সুপারড্রাগ ‘ফাজ থেরাপি’—আমাদের শত্রুর শত্রু ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাস ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়া নিধন! এই ফাজ ভাইরাস থেকে তৈরি ফাজ পাউডার ও ফাজ ট্যাবলেট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত সৈন্যদের বাঁচিয়েছিলো রোগজীবাণুর সংক্রমণ থেকে। তার প্রায় শতবর্ষ পরে কী করে সেই পদ্ধতি আবারো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলো,হাজির হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক হাতিয়ার হিসেবে—সেই গল্প পাওয়া যাবে ‘আমাদের শত্রুর শত্রু : ব্যাকটেরিওফাজ’ অধ্যায়ে।
এরপরে আছে সমুদ্রে ফাজ ভাইরাসের রাজত্ব, অন্য জীবের জিনোমে ঢুকে পড়া রেট্রোভাইরাসের দীর্ঘজীবীতা,দু’বছর আগেই ঢাকা-শহরে মাথাচাড়া দেওয়া চিকুনগুনিয়া’ রোগের জন্য দায়ী ওয়েস্ট নিল ভাইরাস এবং চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া বসন্তরোগের কথা।
‘কি হতে যাচ্ছে পরবর্তী মহামারী’ এই বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি নিবন্ধ। জিমারের আশঙ্কা ইবোলা হতে পারে আগামী দিনের মহামারী। মজার ব্যাপার, ইবোলার পাশাপাশি সার্স ও মার্স বর্গের ভাইরাসও পশু থেকে মানুষে বাহিত হয়ে মহামারী সৃষ্টি করতে পারে—আজ থেকে দশ বছর আগে দাঁড়িয়ে এই দুর্ভাবনাও তাকে পীড়িত করেছিলো। আজকে আমরা জানি লেখকের প্রথম শঙ্কাটি সত্যি হয় নি, সত্যি হয়েছে দ্বিতীয়টি—চীনের উহান প্রদেশ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে সার্স-কোভ-টু ভাইরাস সৃষ্টি করেছে কোভিড নাইন্টিন অতিমারি। দুঃখ কেবল এ-ই, লেখক এই বইতে যে ‘খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকা’র তাগিদ দিয়েছিলেন, বিশ্বের হর্তাকর্তারা তা উপলব্ধি করে যদি দাঙ্গা আর যুদ্ধাস্ত্রের বদলে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্রণোদিত করতেন, তাহলে বোধহয় আজকের কোভিড অতিমারির ভয়াবহতা এতো লাগামছাড়া হতো না!
বইয়ের নিবন্ধগুলোর ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়, বড়জোড় আট কি দশ পৃষ্ঠা। তথাপি এই স্বল্প পরিসরেই যেভাবে ভাইরাসের উদ্ভব, বিবর্তন, আক্রমণের ইতিহাস, এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া, রোগসংক্রমণের ক্ষমতা, ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক গবেষণা, প্রতিষেধক আবিষ্কারের গল্প আলোচিত হয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে অণুজীব-গবেষণার সতর্কতা, জীবাণু-অস্ত্রের আশঙ্কা এবং বিজ্ঞানীদের দায়িত্ববোধের বিষয়গুলো। পাশাপাশি কয়েকটি সূক্ষ্ম বিষয় লেখক খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন—মানুষ যখনই বেপরোয়া হয়ে কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রে হানা দিয়েছে, তখনই তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেসব বাস্তুতন্ত্রের নির্দিষ্ট জায়গায় থাকা জীবাণু-যারা হয়তো কখনোই নিজস্ব বাহক ছাড়া মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণির সংস্পর্শে আসতো না, তারা নতুন প্রজাতির বাহককে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে গেছে। রোগসংক্রমণের ব্যাপারেও তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে আমাদের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ডেকে আনে নানারকম অসুখ, আর সামান্য সচেতনতা আমাদের রক্ষা করতে পারে এসব বিপদ থেকে।
বইয়ের অনুবাদ বেশ সাবলীল। গুটিকয়েক মুদ্রণপ্রমাদ মাঝেমধ্যে ভ্রুকুঞ্চন ঘটালেও তেমন জড়তা বোধ হয় নি কোথাও। ছবির ব্যবহার পকেট-বইটির সৌকর্য আরো বাড়িয়েছে। সর্বোপরি, জীববিজ্ঞান তথা অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ থাকলে এই বইটি আপনার জন্যেই,নিঃসংশয়ে সংগ্রহ করতে পারেন প্রকৃতি-পরিচয় প্রকাশিত ‘ভাইরাসের পৃথিবী’ বইটি। অনুবাদকের জন্য রইলো শুভকামনা!
Leave a Reply