“আমি আমার এক্সপেরিমেন্টের প্রথম জেলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমার এখনও মনে পড়ে অশ্রু আমার দুচোখে টলমল করছিলো, এ এক দুর্দান্ত অনুভূতি! আমি বুঝে গেছিলাম আমরা এখন অসাধারণ কাজ করতে পারব।”
হারবার্ট বয়ার
১.
১৯৯৪ সালে হারবার্ট বয়ারের করা এই উক্তির প্রায় ৮০ বছর পূর্বে ফ্রেডেরিক টোর্ট সর্বপ্রথম ব্যাকটেরিওফাজ আবিষ্কার করেন ১৯১৫ সালে। ব্যাকটেরিওফাজ হলো ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এমন ভাইরাস। এর প্রায় চল্লিশ বছর পর, গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ওয়ার্নার আর্বার নামের একজন বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়াতে ব্যাকটেরিওফাজ প্রতিরোধী রেস্ট্রিকশন মডিফিকেশন সিস্টেম খুঁজে পান। এই সিস্টেমটি আক্রমণ করা ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাসগুলোকে মেরে ফেলতে পারত। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, এই সিস্টেমে থাকা রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাসের ডিএনএকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।
১৯৭০ সালে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজিস্ট হ্যামিলটন স্মিথ ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু থেকে সর্বপ্রথম রেস্ট্রিকশন এনজাইমকে আলাদা করতে সক্ষম হন। যার সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা এবার ভাবতে থাকেন কীভাবে এই রেস্ট্রিকশন এনজাইমকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ডিএনএ কাটাছেঁড়ার কাজে ব্যবহার করা যায়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রধান পল বার্গ প্রথমবারের মতো একটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ নিয়ে সেটাকে একটি ভাইরাসে ইনসার্ট করতে সক্ষম হন ১৯৭২ সালে। এই গবেষণাদলটি ডিএনএ এর উপর কাজ করে এমন বিভিন্ন এনজাইম আইসোলেট ও পিউরিফাই (isolate & purify) করাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলো। এতে করে ভাইরাসে একই সাথে দুইটি জীবের ডিএনএ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। তবে এটাকে ছোট গবেষণাগারের পর্যায়ে ইন-ভিট্রো রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ (in vitro Recombinant DNA) বলা চলেনা।
২.
ফ্রেডরিখ মিশারের ডিএনএ আবিষ্কার (১৮৬৯), হারশে-চেস এর ডিএনএ কে বংশগতীয় বস্তু প্রমাণ (১৯৫২), জেমস ওয়াটসন-ফান্সিস ক্রিক-রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন এর ডিএনএ ডাবল হেলিক্স স্ট্রাকচার আবিষ্কার (১৯৫৩), এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সিস ক্রিকের ‘সেন্ট্রাল ডগমা’ থিওরি (১৯৫৭), সবকিছু বিজ্ঞানীদেরকে এটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে ডিএনএকে যদি ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া এবং বদলানোর প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যায়, সেটা মানবজাতির বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে সমূলে বদলে দিবে। তবে এই প্রযুক্তি ঠিক কীভাবে মানুষ অর্জন করবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা কারোরই। এই পরিস্থিতি ১৯৭২ সালের পল বার্গের গবেষণার পরে একদম বদলে যায়।
পল বার্গ গবেষণাগারে যে ভাইরাসটি ব্যবহার করেছিলেন সেটি ছিলো সিমিয়ান ভাইরাস ৪০। এই ভাইরাসের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি সহজেই স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোষের জিনোমে যুক্ত হতে পারে। আর তাই এই ভাইরাস যদি সাথে করে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ নিয়ে স্তন্যপায়ীর কোষে প্রবেশ করে তাহলে পরোক্ষভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণীই তখন রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ বহন করবে। কিন্তু কাজটি মোটেও এতটা সহজ ছিলো না। সেসময় বেশকিছু নৈতিক উদ্বেগ পল বার্গের গবেষণা কার্যক্রমকে থামিয়ে দেয়।
৩.
সাল ১৯৭২; হারবার্ট বয়ারের ল্যাব, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ফ্রান্সিসকো।
মেজাজ হারানোর উপক্রম হয়েছে রবার্টের। ‘এ নিয়ে সত্তরবার, সত্তরবার ফর গডস সেক’ মেজাজ বিগড়ে চিৎকার করে উঠলেন রবার্ট হেলিং। তিনি এবং বয়ার চেষ্টা করছিলেন ইকো-আরওয়ান (EcoRI) রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যবহার করে ল্যাম্বডা ভাইরাসের একটি জায়গায় কাটতে। কিন্তু যতবারই তারা তাদের আকাঙ্ক্ষিত একটি জায়গা কাঁটতে যান, ততবারই রেস্ট্রিকশন এনজাইমটি ল্যাম্বডা ভাইরাসের ডিএনএর প্রায় পাঁচটি জায়গা কেটে ফেলে। কোনোভাবেই তারা এ সমস্যার কোনো কূলকিনারা করে উঠতে পারছিলেন না।
বছরটা এভাবেই শেষ হতে চললো, নভেম্বরে বয়ার গেলেন হাওয়াইতে একটি কনফারেন্সে, প্লাজমিড নিয়ে তার করা গবেষণা উপস্থাপনে। প্লাজমিড হলো ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব ক্রোমোজোমের বাইরে থাকা একটি ডিএনএ অণু, যেটা বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিংয়ে বাহক বা ভেক্টর হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। সেখানেই বয়ারের সাথে পরিচয় হয় স্ট্যানলে কোহেনের যিনি সে সময় স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু প্লাজমিড নিয়ে কাজ করছিলেন। অর্থাৎ বয়ার একদিকে ইকোআরওয়ান রেস্ট্রিকশন এনজাইম দিয়ে কীভাবে ডিএনএকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কাটা যায় সেটা জানতে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন, অন্যদিকে কোহেন সেসময় ব্যাকটেরিয়ার ভেতরের প্লাজমিড কীভাবে একটা থেকে অনেকগুলো কপি তৈরী করে সেটা আবিষ্কারে মগ্ন ছিলেন। হাওয়াইতে সাক্ষাতের পর এই দুজন বিজ্ঞানী খুব অল্প সময়েই নিজেদের গবেষণা কার্যক্রম সমন্বয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, সৃষ্টি হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার (collaboration) একটি।
কোহেনের স্ট্যানফোর্ডের ল্যাব থেকে প্লাজমিড যেত সানফ্রান্সিসকোতে বয়ারের ল্যাবে। সেখানে এই প্লাজমিডগুলোকে ইকোআর-ওয়ান রেস্ট্রিকশন এনজাইম দিয়ে কাটা হতো। তারপর এই ডিএনএ ফ্রাগমেন্টগুলোকে আবার স্ট্যানফোর্ডে পাঠানো হতো, স্ট্যানফোর্ডের সায়েন্টিস্টরা সেই ডিএনএ ফ্রাগমেন্টগুলোকে নির্দিষ্ট এক ধরনের লাইগেজ এনজাইমের সাহায্যে জোড়া লাগিয়ে সেগুলোকে ই. কোলাই (E. coli) ব্যাকটেরিয়াতে যুক্ত করতেন; এবং এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে কালচার করে সংখ্যাবৃদ্ধি করানোর চেষ্টা করতেন। তারা বিভিন্ন ধরনের প্লাজমিডে এই রেস্ট্রিকশন এনজাইম প্রয়োগ করে যেতে থাকেন। তারা প্রথম সফলতার দেখা পান ১৯৭৩ সালের বসন্তে, যখন pSC101 নামের একটি প্লাজমিডকে সম্পূর্ণ অক্ষত রেখে নির্দিষ্ট একটি স্পেসিফিক জায়গাতে কাঁটতে করতে সক্ষম হন। এটা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি গবেষণা। কিন্তু তখনো রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ তৈরী বাকি!
এরপর গবেষকদল একই রেস্ট্রিকশন এনজাইম দিয়ে আরেকটি ডিএনএ এর একই সুনির্দিষ্ট জায়গাতে কাঁটেন এবং যখন এই ফ্রাগমেন্টটিকে সদ্য কাঁটা pSC101 প্লাজমিডের সংস্পর্শে নিয়ে আসেন, সাথে সাথে এরা পরিপূরকভাবে লেগে যায়। এরপর তারা লাইগেজ এনজাইম দিয়ে এই ডিএনএ এবং প্লাজমিডকে পুরোপুরিভাবে জোড়া লাগিয়ে দেন। ব্যাস! ল্যাবরেটরিতে তৈরী হয়ে গেলো রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ। এখন দরকার এর ক্লোন তৈরী করে বড় পরিসরে ব্যবহার করা। এজন্য রিকম্বিনেন্ট ডিএনএটিকে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াতে যুক্ত করানো হলো। তারপর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বিশেষ কালচার মিডিয়ামে দেয়া হলো সংখ্যাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডটি ব্যাকটেরিয়াতে যুক্ত হয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে ব্যাকটেরিয়াগুলোকে টেট্রাসাইক্লিন সমৃদ্ধ কালচার মিডিয়াতে সংখ্যা-বৃদ্ধি করতে দেয়া হলো। যেহেতু pSC101 প্লাজমিডটি টেট্রাসাইক্লিন এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (রেজিস্ট্যান্ট), তাই যে ব্যাকটেরিয়াগুলো রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিড নিতে পেরেছে শুধুমাত্র তারাই বেঁচে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করতে সক্ষম হলো। আর বাকিরা মারা পড়লো।
গবেষণার উপর্যুপরি সাফল্য এই গবেষকদলটিকে বিভিন্ন প্রজাতির ডিএনএর ফিউশন ঘটাতে অনুপ্রাণিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা সাউথ আফ্রিকান ব্যাঙ এর ডিএনএকে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করাতে সক্ষম হন। পৃথিবীর যেকোনো জীবের ডিএনএকে যে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব তারই ইঙ্গিত দেয় এই গবেষণাটি।
আমরা হয়ত এখনো ধরতে পারিনি যে, এই রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজির ব্যবহার আসলে কোথায় বা কীভাবে এগুলো মানুষের কাজে আসতে পারে? বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও এপ্লিকেশনস অনেক আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন, এমন কি এই প্রযুক্তি আবিষ্কারেরও আগে থেকেই!
৪.
রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি হচ্ছে যেকোনো একটি জীবের ডিএনএ এর একটি অংশ কেঁটে নিয়ে অন্য একটি জীবের ডিএনএতে জোড়া লাগিয়ে ট্রান্সজেনিক জীব তৈরীর প্রক্রিয়া। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোনো জীবের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতাকে আরেকটি জীবে প্রবেশ করানো যায়। হারবার্ট বয়ার এই প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াতে মানুষের ইনসুলিন তৈরীর জিন প্রবেশ করিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে ক্লোন করান। যার ফলে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক উপায়ে ইনসুলিন তৈরী সম্ভব হয়।
কয়েকবছর আগে, জেব্রাফিশে গ্রিন ফ্লোরেসেন্ট প্রোটিন তৈরীর জিন (ডিএনএ এর অংশ) প্রবেশ করিয়ে গ্লো-ফিশ তৈরী করা হয়েছে যারা অন্ধকারে সবুজ আলো বিচ্ছুরিত করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত তৈরীতে, ভ্যাকসিন উৎপাদনে, পরিবেশ দূষণ রোধে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মানুষ তাদের নিজেদের ডিএনএকেও ম্যানিপুলেট করতে শুরু করবে। শতবর্ষ আয়ু, নীরোগ জীবন, এগুলো তখন আর হয়ত দুর্লভ থাকবেনা। হয়ত একদিন আমরাই আমাদের বিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করব, নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করব আমাদের জেনেটিক ভাগ্যকেও।
ক্রিসপার, জিনোম এডিটিং, ডিজাইনার বেবি শব্দগুলোর সাথে তো মানুষ ইতোমধ্যেই পরিচিত হতে শুরু করেছে।
তথ্যসূত্র:
01. (Book) Genentech – The Beginnings of Biotech (Synthesis) by Sally Smith Hughes
02. The Science History Institute: Herbert W. Boyer and Stanley N. Cohen
Leave a Reply