জিন থেরাপির শুরু যেভাবে

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

বিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। গবেষকরা ক্যান্সার, হাইপারার্জিনিনেমিয়া, থ্যালাসেমিয়াসহ বিভিন্ন জিনগত রোগের চিকিৎসার কথা ভাবতে থাকেন ভিন্ন আঙ্গিকে। এসব জটিল জিনগত রোগ হয়ে থাকে নির্দিষ্ট কিছু জিনে মিউটেশন ঘটবার দরুন। গবেষকরা কোষে জিনগত পরিবর্তন সাধন করার মাধ্যমে এই জিনগত রোগ সমূহের চিকিৎসার কথা ভাবতে শুরু করেন। বিষয়টা অনেকটা একদম রোগের গোঁড়ায় গিয়ে চিকিৎসা করার মতন। আর একেই বলে জিন থেরাপি। বর্তমানে জিন থেরাপি চিকিৎসা জগতে বেশ আলোচিত এক বিষয়। বেটা-থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, অন্ধত্ব, ক্যান্সার, ADA-SCID-সহ বেশ কিছু সংখ্যক জটিল জিনগত রোগের চিকিৎসায় জিন থেরাপি সাফল্য দেখিয়েছে। তবে শুরুর দিকের পথটা মোটেও সহজ ছিল না। জিন থেরাপির যাত্রা শুরু হয় মানব কোষে নতুন জিনগত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করার প্রয়াস থেকে। 

শুরুর দিকের কথা

১৯৬১ সাল। টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেন ক্রাউস সিকেল-সেল অ্যানেমিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগীর অস্থিমজ্জা থেকে কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর টিস্যু কালচার করেন। তারপর সেই কালচারে সুস্থ মানুষের দেহ থেকে নেয়া ডিএনএ নমুনা যোগ করেন। এভাবে কিছুদিন রেখে দেবার পরে দেখা যায় রোগীর কোষ গুলোও সুস্থ হিমোগ্লোবিন তৈরি করছে। এর সাত বছর পর, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH) এর থিওডোর ফ্রিডম্যান, জে সিগমিলার এবং জন সুবাক-শার্প, সফল ভাবে লেশ-নিহান সিনড্রোম এর জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ জিনকে ঠিক করেন। তারাও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে কোষ নিয়ে কালচার করেন। তারপর কালচারের মধ্যে সুস্থ ব্যক্তির ডিএনএ যুক্ত করেছিলেন। 

ছবিঃ থিওডোর ফ্রিডম্যান, জে সিগমিলার এবং জন সুবাক-শার্প।

প্রথম সফলভাবে কোন মানুষকে জিন থেরাপি দেয়া হয় ১৯৭০ সালে। হাইপারার্জিনিনেমিয়ায় আক্রান্ত দুই  জার্মান বোন প্রথম জিন থেরাপি গ্রহণ করেন। হাইপারার্জিনিনেমিয়া একটি বিরল জিনগত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে আর্জিনেজ নামক এনজাইম উৎপন্ন হয় না। এই এনজাইম দেহ তরলে আর্জিনিন নামক অ্যামাইনো এসিডের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাঁধা দেয়। দেহ তরলে এই অ্যামাইনো এসিড জমলে মস্তিষ্কের ক্ষতি, মৃগীরোগ এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক ক্ষতি সাধনসহ পেশী সমস্যা দেখা দেয়। প্রত্যেক বোনের দেহে শপ প্যাপিলোমা নামক এক ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। এই ভাইরাস আর্জিনেজ এনজাইম তৈরিতে সাহায্য করে। আমেরিকান চিকিৎসক স্ট্যানফিল্ড রজার্স এবং জার্মান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এইচ জি টেরহেগেন এই চিকিৎসা পরিচালনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। 

পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সফলভাবে বেটা-গ্লোবিন জিন ক্লোন করতে সমর্থ হোন। এই জিন রক্তের হিমোগ্লোবিন অণুর বেটা সাবিউনিট তৈরি করে। বেটা-থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেটা-গ্লোবিন জিনে ত্রুটি থাকে। বছর তিনেক পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন ক্লাইন ও তার গবেষণা দল বেটা-থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসায় ক্লোন করা সুস্থ গ্লোবিন জিন ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। তারা রোগীর অস্থিমজ্জা থেকে কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর ভেতর সুস্থ গ্লোবিন জিন যুক্ত করেন। তারপর পুনরায় কোষ গুলোকে রোগীর দেহে প্রবেশ করান। হতাশাজনক ভাবে ক্লাইন এবং তার গবেষণা দলও ব্যর্থ হন। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনা বোর্ড থেকে অনুমতি না নিয়েই গবেষণা চালানো এবং প্রাণীর দেহে কার্যকারিতার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারায় সে সময় ক্লাইন তিরস্কৃত হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর মানুষের দেহে জিন থেরাপি প্রয়োগের ভবিষ্যৎ প্রচেষ্টার পথ অনেকটা সংকুচিত হয়ে যায় বলা যায়। 

রিচার্ড মুলিগান।  

জিন থেরাপির প্রয়োগে প্রথম সুস্থ হয়ে উঠা ব্যক্তি

১৯৮০’র দশকে রেট্রোভাইরাস আবিষ্কার জিন থেরাপির পালে নতুন হাওয়া লাগায়। এই ভাইরাস মানুষের কোষে জিন ট্রান্সফার করার জন্যে বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাস্যাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির রিচার্ড মুলিগান প্রথম জিন ট্রান্সফার এর জন্য রেট্রোভাইরাল জিন বাহক তৈরি করেন। ১৯৯০ সালে মুলিগান এর ভাইরাস জিন বাহক প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রেঞ্চ অ্যান্ডারসন। তিনি এবং তার গবেষণাদল শিশুদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার একটি জটিল রোগের চিকিৎসায় জিন থেরাপির প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। অ্যাডেনোসিন ডিঅ্যামিনেজ (ADA) জিন এর ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা খুব বেশিদিন বাঁচে না। ADA-SCID (adenosine deaminase-deficient severe combined immunodeficiency) এ আক্রান্ত আশাণ্টি ডিসিলভা নামের এক চার বছর বয়সী শিশুকে প্রথম জিন থেরাপি প্রদান করা হয়। আশাণ্টি-র শরীর থেকে রক্ত কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর জিনোমে সুস্থ ADA জিন যুক্ত করে দেয়া হয়। তারপর সুস্থ ADA জিন যুক্ত কোষ গুলোকে পুনরায় আশাণ্টি-র শরীরে প্রবেশ করানো হয়। বিষয়টা অনেকটা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করার মতো। রক্ত কোষ গুলো যেহেতু আশাণ্টি-র শরীর থেকেই নেয়া, তাই তার দেহে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যানের মতো ঘটনা ঘটে নি। আশার কথা হচ্ছে এই থেরাপির কল্যাণে আশাণ্টি সেড়ে উঠেছিল। এটাই ছিল জিন থেরাপির প্রথম সফলতার গল্প। 

জিন থেরাপি প্রয়োগে প্রথম ADA-SCID থেকে সুস্থ হয়ে উঠেন আশাণ্টি ডিসিলভা। 

জিন থেরাপি কি করে কাজ করে

জিন থেরাপির মূল বিষয়টা হয়ত এতক্ষণে ধরতে পেরেছেন। পরিব্যক্তি ঘটেছে এমন ত্রুটিযুক্ত জিন ঠিক করা। এটা বিভিন্ন ভাবে সম্ভব হতে পারে। যেমন রোগীর শরীর এর কোষে ত্রুটিযুক্ত জিন ভালো জিন এর কপি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা অথবা সরাসরি জিনোম সম্পাদনার টুলস (যেমন ক্রিস্পার ক্যাস৯) ব্যবহার করে ত্রুটিযুক্ত জিন এর ত্রুটি দূর করা। কখনো কখনো ইন-ভিট্রু পদ্ধতিতে জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর কোষকে মডিফাই করে পুনরায় রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। এছাড়াও বর্তমানে জিন থেরাপিতে আরও কিছু কৌশল ব্যবহার করা হয়। যেমন রোগীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে

এন্টিবডি, এন্টিজেন অথবা সাইটোকাইন এর জিন প্রবেশ করানো। কিংবা কোন জিনগত রোগের জন্য দায়ী জিনকে অ্যান্টিসেন্স RNA, রাইবজাইম ইত্যাদি ব্যবহার করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। নব্বই এর পর থেকে এযাবৎ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা জিনগত রোগ চিকিৎসায় জিন থেরাপি সফলতা অর্জন করেছে। 

মানুষের চোখের এক ধরণের জিনগত রেটিনাল ডিস্ট্রোফির নাম হলো Leber congenital amaurosis (LCA)। রেটিনা মানব চোখের আলোক সংবেদী অংশ। কোন বস্তু থেকে আসা আলোর উদ্দীপনা সংগ্রহ করে মগজে পাঠানোই হলো রেটিনার কাজ। মস্তিষ্ক তখন রেটিনা থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ করে ঐ বস্তুর ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে। LCA রেটিনার কাজে বাঁধা সৃষ্টি করে। সেই সাথে চোখের পিউপিল কে আলোর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া থেকে বিরত রাখে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত ৪০ বছর বয়সের মধ্যে পুরোপুরি ভাবে অন্ধ হয়ে যায়। চোখের রেটিনার সঠিক বৃদ্ধি এবং কার্যকরণ এর সাথে জড়িত ২৭ টা জিনে পরিব্যক্তি ঘটলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে একটা জিন হচ্ছে RPE65। গবেষকরা adeno-associated virus (AAV) ভাইরাস বাহক ব্যবহার করে সুস্থ RPE65 জিন এর কপি রোগীর চোখের রেটিনা কোষে প্রবেশ করান। FDA প্রথম লাক্সটার্না (Luxturna) নামের একটা ড্রাগ, LCA সহ চোখের দৃষ্টির অন্যান্য সমস্যা যেগুলো RPE65 জিন এর পরিব্যক্তির সাথে জড়িত, সেগুলোর চিকিৎসায় অনুমোদন করে। লাক্সটার্নায় মূলত সুস্থ  RPE65 জিন কপি ব্যবহার করা হয়। রোগীরা যারা দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছিলেন তাদের প্রায় সবাই-ই এই থেরাপির কল্যাণে দ্রুত ভালো দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন।

এছাড়াও রক্তের বিভিন্ন জিনগত সমস্যা যেমন হিমোফিলিয়া, সিকল সেল অ্যানেমিয়া, বেটা থ্যালাসেমিয়া প্রভৃতি চিকিৎসায় ক্রিসপার ক্যাস৯ (CRISPR-Cas9) জিন থেরাপি বেশ আশানুরুপ ফল দেখিয়েছে। রক্তের ক্যান্সার তীব্র লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়াও (acute lymphoblastic leukemia ) সাড়িয়ে তুলছে CAR-T সেল ভিত্তিক জিন থেরাপি।  

শিশুদের স্পাইনাল মাসক্যুলার অ্যাট্রোফি (SMA) নামে এক ধরণের নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ হয়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে মোটর স্নায়ুর সঠিক গঠন এর জন্য জরুরি একটা প্রোটিন তৈরি হয় না। সাধারণত কোষে প্রোটিন তৈরি হয় মেসেঞ্জার  RNA তে থাকা কোড থেকে।  মেসেঞ্জার  RNA তৈরি হয় ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় ডিএনএ থেকে। তবে প্রোটিন তৈরি আগে ডিএনএ থেকে সরাসরি তৈরি হওয়া mRNA কে স্প্লাইসিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় mRNA থেকে ইন্ট্রন অংশ গুলো কেটে বাদ দেয়া হয়। কারণ এগুলো থেকে কোন প্রোটিন তৈরি হবে না। SMA আক্রান্ত শিশুদের দেহের কোষে স্প্লাইসিং প্রক্রিয়ার সময় mRNA থেকে SMN1 নামক জিন বাদ পড়ে যায়। এই জিনটিই মোটর স্নায়ুর গঠনের জন্যে দরকারি প্রোটিন তৈরি করে। 

২০১৬ সালে FDA স্পিনরাজা (Spinraza) নামের একটা ড্রাগ SMA চিকিৎসায় অনুমোদন করে। এই ড্রাগ এর মাধ্যমে রোগীর দেহে একটা SMN2 নামে অন্য আরেকটা জিন প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। SMN2 জিনও মোটর নিউরন গঠনের জন্যে দরকারি একই প্রোটিন তৈরি করে। এযাবৎ প্রায় দশ হাজার শিশুকে এই চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এইরকম আরও নানান জটিল জটিল জিনঘটিত রোগে চিকিৎসায় জিন থেরাপি আলো দেখাচ্ছে। তবে এখনো এসব চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। সাধারণের ক্রয় সাধ্যের বাইরেই রয়ে আছে। সেই সাথে এখনো এই চিকিৎসার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আশা করা যায় ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এইসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাবে জিন থেরাপি। জিনঘটিত কোন রোগই হয়ত আর দুরারোগ্য থাকবে না।

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 200-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers